শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
১৩ জানুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১১:৪৪

কেনাকাটায় অস্বাভাবিক দাম, অক্সিমিটার সাড়ে ৫ লাখ টাকা!

অনুসন্ধানে মন্ত্রণালয়-দুদক

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্প

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও পণ্য অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটার ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি এ দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সূত্র জানায়, ওই প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে। এটি পর্যালোচনা করতে গিয়েই ভয়াবহ অনিয়মের চিত্র বেরিয়ে আসে। বিশেষ করে একটি পালস অক্সিমিটার (শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা নিরূপণ যন্ত্র) কেনা হয়েছে ৫ লাখ ৫২ হাজার টাকায়।

যেটির বাজার মূল্য প্রকার ভেদে ৭০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকার মধ্যে। প্রকল্পের অন্যান্য কেনাকাটায় দেখা যায় বাজার মূল্যের তুলনায় অতিরিক্ত দাম। শুধু তাই নয়, ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি বা প্রজেক্ট ইভালুয়েশন কমিটি) সভায় পর্যালোচনার পর দেখা গেছে, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন ছাড়াই কেনা হয়েছে অনেক পণ্য।

এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের সুপারিশ না দিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সেটি ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন।

পিইসি সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে ফুল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ইউনিট প্রতি মূল্য ধরা হয় ২০ হাজার টাকা। সেখানে এ টেবিল কেনা হয়েছে সোয়া লাখ টাকায়। এছাড়া সোফা সেট কেনায় বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার টাকা, কিন্তু কেনা হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার টাকায়। হাফ সেক্রেটারিয়েট টেবিলের জন্য ধরা ছিল ৭ হাজার টাকা, কিন্তু কেনা হয়েছে ৫৭ হাজার টাকায়।

এছাড়া মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব বা ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) হাসপাতালের যন্ত্রপাতির আওতায় ইলেক্ট্রোফোরেসিস হিমোগ্লোবিনের মূল্য ধরা ছিল ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। কিন্তু কেনা হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকায়। ফ্যাকো ইমালনিফায়ারের জন্য ধরা ছিল ২০ লাখ টাকা, কেনা হয়েছে ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকায়। অ্যানেস্থেশিয়া ভেন্টিলেটরের জন্য ধরা ছিল ৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা। কিন্তু কেনা হয়েছে ৫৭ লাখ ২৯ হাজার টাকায়।

সভার কার্যবিবরণীতে আরও উল্লেখ করা হয়, মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে কতিপয় যন্ত্রপাতির জন্য কোনো বরাদ্দ না থাকা সত্ত্বেও উক্ত যন্ত্রপাতি ইতোমধ্যেই ক্রয় করা হয়েছে।

উদাহরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, টেবিল ফর গাইনোকোলজি কেনা হয়েছে ৩১ লাখ ৮৯ হাজার টাকায়। এছাড়া কালার ডপলার আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন উইথ ফোরডি কেনা হয়েছে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা এবং ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ইউএলটি ফ্রিজার কেনা হয়েছে ১৭ লাখ ৯৪ হাজার টাকায়।

একটি পালস অক্সিমিটার কেনা হয়েছে ৫ লাখ ৫২ হাজার টাকায়। অনুমোদিত ডিপিপিতে সংস্থান না থাকার সত্ত্বেও সম্পূর্ণ আর্থিক বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ইএসআর ল্যাব অটোমেশন বাবদ ৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয় কার্যবিবরণীতে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর যুগান্তরকে জানান, এসব কেনাকাটার বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই তদন্তও শুরু হয়েছে। নিজেরাই তদন্ত করার পাশাপাশি আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) তথ্য পাঠিয়েছি।

এ প্রসঙ্গে দুদকের পরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য মঙ্গলবার যুগান্তরকে জানান, তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কেনাকাটার বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

অক্সিমিটার বিষয়ে জানতে চাইলে পিইসি সভায় অংশ নেয়া পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান ডা. মহিউদ্দিন ওসমানী বলেন, অক্সিমিটার বিভিন্ন ধরনের রয়েছে।

তবে যেটি আঙুলে লাগিয়ে পরীক্ষা করা হয় সেটির দাম ৭০০ থেকে দেড় হাজার টাকার মধ্যে। এটির সবচেয়ে বেস্ট কোয়ালির অক্সিমিটারের দাম তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার মধ্যে। তবে টেবিল টেক অক্সিমিটার (যেটি মনিটরসহ থাকে) সেটির দাম এক লাখ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তারা কোনো ধরনের পালস অক্সিমিটার কিনেছে সেটি জানা যায়নি। সেজন্যই আমরা তদন্ত করার সুপারিশ দিয়েছি।

পিইসি সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়, পরিকল্পনা কমিশনসহ সভার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতির পরিমাণ ও মূল্য অত্যাধিক। মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে নির্ধারিত মূল্যের সঙ্গে ইতোমধ্যেই ক্রয়কৃত আসবাবপত্র এবং যন্ত্রপাতির মূল্যে মারাত্মক অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কেউ দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তাই এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে দেখা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সভার পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় একনেকে অনুমোদন ছাড়া এরকম ব্যয় গুরুতর আর্থিক অনিয়ম এবং সরকারের অর্থ তছরুপের পর্যায়ে পড়ে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণের দায়িত্বে ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদ্য সাবেক হওয়া সদস্য (সচিব) আবুল কালাম আজাদ। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। রোববার তিনি যুগান্তরকে বলেন, আপনারা সাংবাদিক অনুসন্ধান করে যা পাবেন তাই লিখুন। আমি কোনো কথা বলতে পারব না।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের যে সুপারিশ তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। পিইসি সভায় যেভাবে ‘পয়েন্ট টু পয়েন্ট’ উল্লেখ করা হয়েছে এতে গতানুগতিক তদন্ত কমিটি করার দরকার নেই। এখন শুধু যাচাই-বাছাই করে দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক এনায়েত হোসেন বলেন, তারা কোন ধরনের অক্সিমিটার কিনেছে সেটি আমার জানা নেই। তবে পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পিইসি সভায় অংশ নেয়া স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. কাজী আফজালুর রহমানের কাছে অক্সিমিটার ক্রয় এবং প্রকল্পে নানা অনিয়ম বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখানে একেবারেই নতুন।

তাই কিছু বলতে পারব না। তাছাড়া আপনাকে চিনিও না। আপনার চায়ের দাওয়াত থাকল অফিসে আসেন সামনাসামনি কথা বলা যাবে। আমি ঢাকা মেডিকেলের অধ্যাপক ছিলাম। সুতরাং পিইসি সভায় থাকলেও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব না। পিইসি সভায় অংশ নেয়া এসইআইডির উপপ্রধান আমজাদ হোসেন বলেন, পালস অক্সিমিটার ৭০০ টাকা থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত আছে। কিন্তু প্রকল্পের আওতায় কি ধরনের অক্সিমিটার কেনা হয়েছে সেটি জানা নেই।

ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে আরও জানা গেছে, পিইসি সভার সভাপতি পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) বর্তমানে অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা আবুল কালাম আজাদ একনেকের অনুমোদন ছাড়াই শত শত আইটেমের আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতি অত্যাধিক দামে কেনা এবং সরকারের বহু কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে জানতে চান। উত্তরে প্রকল্প পরিচালক জানান, প্রয়োজনীয়তা অনুসারে উক্ত আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে।

অতিরিক্ত খরচের টাকা কোথায় পেয়েছেন জানতে চাইলে, তিনি (প্রকল্প পরিচালক) জানান, প্রকল্পের অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হয়েছে। বরাদ্দ না থাকা সত্ত্বেও অনিয়মের আওতায় বিলগুলো হিসাব বিভাগ কিভাবে অনুমোদন করে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে সবাই একমত পোষণ করেন। এ অবস্থায় প্রকল্পটির সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন না দিয়ে উক্ত আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। সেই সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাই কমিটির সভায় আলোচনা করে যথাযথভাবে বস্তুনিষ্ট সংশোধিত প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর সুপারিশ দেয়া হয়েছে।

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. হাফিজ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমি প্রশাসন দেখি তাই কোন ধরনের অক্সিমিটার কেনা হয়েছে সেটি বলতে পারছি না। তবে আইসিইউ ও সিসিইউতে যেসব পালস অক্সিমিটার ব্যবহার করা হয় সেগুলোও হতে পারে। বিষয়টি আইসিইউ-সিসিইউ সংশ্লিষ্টরাই বলতে পারবেন।

সূত্র জানায়, গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুমোদন দেয় একনেক। ব্যয় ধরা হয়েছে ৯২৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় ৭ তলা হাসপাতাল ভবনকে ১৫ তলা পর্যন্ত সম্প্র্রসারণ, কলেজের একাডেমিক ভবন ও শিক্ষার্থীদের জন্য ডরমিটরি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল।

জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। এরই মধ্যে প্রকল্পের সময় আরও ২ বছর এবং ব্যয় বাড়িয়ে ১ হাজার ৯৬ কোটি টাকা ধরে প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/383331