১২ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:৪০

চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পে লাগামহীন ব্যয়

৪ বছর মেয়াদি প্রজেক্ট ১০ বছরেও শেষ হচ্ছে না

উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন খরচে কোনো লাগাম নেই। একইভাবে প্রকল্প কবে শেষ হবে তার সময়সীমাও ঠিক নেই। মেগা প্রকল্পের চেয়েও মাঝারি প্রকল্পগুলোর খরচে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রকল্প অনুমোদনের পর সেগুলো যেন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। নিয়ন্ত্রণহীন খরচের বাতিকে আক্রান্ত চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্প। ৪ বছরের প্রকল্পটির ইতোমধ্যে ১০ বছর পার হয়ে গেছে। খরচ দফায় দফায় বাড়িয়ে ৮৫৬ কোটি টাকা থেকে এখন ২ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকায় নতুন করে অনুমোদন পেয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঢিলেমির কারণে প্রকল্পের খরচ ও মেয়াদ বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, উপকূলীয় বাঁধ শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে বাঁধের ওপর চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড নির্মাণের জন্য ৮৫৬ কোটি ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প অনুমোদন পায় ২০১১ সালের ২৯ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়। ৪ বছরে অর্থাৎ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (চউক) প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ সমাপ্ত করার কথা ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করছে জাইকা। তৃতীয় সংশোধনে এসে জাইকার অর্থায়ন কমেছে। বাড়াতে হয়েছে সরকারি অর্থায়নের পরিমাণ।

প্রকল্পের মূল কার্যক্রমে রয়েছে, ১৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ কোস্টাল রোড, ১ দশমিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার রোড-১ এবং শূন্য দশমিক ৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার রোড-৩ নির্মাণ। ৯টি রাউন্ড অ্যাবাউট। ৩টি ইন্টারচেঞ্জ। বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যারিয়ার, গার্ড রেল, সাইন সিগন্যাল এবং লাইন মার্কিং। পুনর্বাসন স্থান-১ এবং ২ উন্নয়ন, সি বিচ এলাকায় সৌন্দর্য বর্ধন কাজ ও ঢেউ প্রতিরোধক দেয়াল নির্মাণ। প্রতিটি সংশোধনীতেই নতুন করে কাজ যুক্ত করে খরচ বাড়ানো হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ ২২ হেক্টর বৃদ্ধি পেয়েছে।

দফায় দফায় মেয়াদ ও খরচ বৃদ্ধি
প্রকল্পের বাস্তবায়ন পর্যায়ে জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি, মৌজা দর বৃদ্ধি এবং স্ট্রাকচারের ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ২ বছর পরই ব্যয় ১ হাজার ৪৯৬ কোটি ৩৫ লাখ ৭১ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়; যা একনেক ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর অনুমোদন দেয়। তখন বাস্তবায়ন মেয়াদ আড়াই বছর বাড়িয়ে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। তাতেও প্রকল্পের কাজে অগ্রগতি নেই। আবারও জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বাড়িয়ে সে খাতে খরচ বৃদ্ধি, মাটি ভরাটের পরিমাণ বৃদ্ধি, প্রকল্পে ১০.২০ কিলোমিটার বাঁধের ঢাল বরাবর সিসি ব্লক দ্বারা পিচিং কাজ যুক্ত করা, নির্মীয়মাণ রাস্তার মধ্যে সমুদ্রসংলগ্ন অংশে ওয়েভ ডিফ্লেকটেড ওয়াল নির্মাণ, সড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণ এবং সমুদ্রতীরে সৌন্দর্যবর্ধন অন্তর্ভুক্ত করায় খরচ আরো বৃদ্ধি পায়। আর এই ব্যয় ৩ বছর পর বাড়ানোর প্রস্তাব একনেকে ২০১৬ সালে দেয়া হয়। একই বছরের ২২ ডিসেম্বর একনেক সভায় সেটিও অনুমোদন দেয়া হয়। মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি কাজ শেষ করার জন্য বলা হয়। তাতেও প্রকল্পটি সমাপ্তির মুখ দেখেনি। এর পর আরো দুই দফা খরচ বাড়ানো ছাড়া মেয়াদ বাড়ানো হয়। এখন এই প্রকল্পের মেয়াদ আরো ৬ মাস বাড়িয়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের খরচ আরো ১০.২৩ শতাংশ বা ২৪৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা বাড়িয়ে বাস্তবায়ন ব্যয় ২ হাজার ৬৭৪ কোটি ২৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকায় উন্নীত করার বিষয়টি অনুমোদন পায় সম্প্রতি একনেকে। এখন জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ৪৫.৯৬ হেক্টর থেকে ৬৭.০৭৬ হেক্টরে, ওয়েভ ডিফ্লেকটেড ওয়ালের দৈর্ঘ্য সাড়ে ৫ কিলোমিটার থেকে ১২০ মিটার বাড়ানো হয়েছে। কমানো হয়েছে রাউন্ড অ্যাবাউট নির্মাণ ৯ থেকে ৭টিতে। তবে এক কিলোমিটার দীর্ঘ প্লাজা, ৫.৬২০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ইপিজেড সংযোগ সড়ক নির্মাণ নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে।

কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, যে প্রকল্পটি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা, ২০১৯ সালের জুন অর্থাৎ সাড়ে ৯ বছরে অগ্রগতি হয়েছে ৮৭ শতাংশ। আর চউক ওয়েবের তথ্যানুযায়ী এই অগ্রগতি আগস্ট পর্যন্ত ৯২ শতাংশ।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ভরাট কাজের জন্য সাগর পাড়ের মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। সাগর পাড়ের মাটি সহজেই ধসে যাবার আশঙ্কা রয়েছে, যা এই প্রকল্পের জন্য ঝুঁকি বলে পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি মনে করছে।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বলছে, ইপিজেড সংযোগ সড়কের কারণে ৪০ কোটি ৫৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, বাড়তি ১২০ মিটার ওয়েভ ডিফ্লেকটেড ওয়ালের কারণে ১২৩ কোটি ৬ লাখ টাকা, ঠিকাদারের ভ্যাট-ট্যাক্স ফেরত ও মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয়ে ১৩৭ কোটি ৮ লাখ টাকা, কংক্রিট প্লাজা ও ওয়াকওয়েতে ৬৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, বক্স কালভার্ট নির্মাণে ৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ঋণের টাকা ছাড় না করায় সরকারি খাত থেকে ৫৭ কোটি ৭৬ লাখ ৫১ হাজার টাকা বাড়তি খরচ যুক্ত করে প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, সমীক্ষা সঠিকভাবে করা না হলে প্রকল্পের অগ্রগতি দফায় দফায় বাধাগ্রস্ত হবে। প্রকল্পের খরচও অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়বে। নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্প সমাপ্ত করা না গেলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি কম হতে পারে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/555233