১২ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:৩৯

টিসিবির ট্রাকে পেঁয়াজ ছাড়া অন্য কোনো পণ্য না থাকায় আগ্রহ নেই ক্রেতাদের

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পেঁয়াজ। নিম্ন আয়ের মানুষের ভরসাস্থল ছিল টিসিবির পণ্য। দুই মাস আগেও খোলাবাজারে টিসিবির পণ্য কিনতে ট্রাকের সামনে ছিল দীর্ঘ লাইন। কিন্তু টিসিবির ট্রাকে এখন তেল, মশুর ডাল, ছোলা, চিনি কিছুই বিক্রি হচ্ছে না। শুধু পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। টিসিবির ট্রাকে পেঁয়াজ ছাড়া অন্য কোনো পণ্য না থাকায় আগ্রহ নেই ক্রেতাদের। আবার আমদানি করা এসব পেঁয়াজে বড় বড় গাছ হয়ে গেছে। পচন ধরেছে পেঁয়াজের গায়ে। অন্যদিকে বাজারে দাম বেশ কমে গেছে। এছাড়া দাম কম হলেও শুধু পেঁয়াজ কিনতে কেউ যাচ্ছেন না। ফলে বিক্রেতারা ট্রাকে অলস সময় পার করছেন।

জানা গেছে, দাম কেজি প্রতি ২০ টাকা, যা বাজারের দেশি পেঁয়াজের তুলনায় অর্ধেক। এরপরও ক্রেতাদের চাহিদা কম। কয়েকদিন আগেও ট্রাকের সামনে লম্বা লাইন দেখা গেলেও এখন আর নেই কোনও ভিড়। অনেক স্থানেই ডেকে ডেকে পেঁয়াজ বিক্রির চেষ্টা করছেন পরিবেশকরা। হাঁকডাকে দু-একজন ক্রেতা এলেও তাদের আগ্রহ ডাল অথবা তেলে। কিন্তু পরিবেশকদের শর্ত শুনেই ফিরে যাচ্ছেন বেশিরভাগ ক্রেতা। কারণ, নির্দিষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ না নিলে অন্য কোনও পণ্য বিক্রি করছেন না পরিবেশকরা। অর্থাৎ যেকোনও পণ্য কিনলে সঙ্গে পেঁয়াজ নিতে বাধ্য করছেন তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রামপুরা এলাকার টিসিবির ডিলাররা জানান, পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে না। পেঁয়াজ নিয়ে আমরা লোকসানে পড়ে গেছি। আর বরাদ্দের পেঁয়াজ শেষ না হলে টিসিবি থেকে অন্য পণ্য দেয়া হচ্ছে না।

গতকাল সোমবার বিভিন্ন এলাকায় টিসিবির ট্রাকসেল ঘুরে দেখা গেল, ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট থেকে কেউ পেঁয়াজ উঠিয়েছেন তিনদিন কেউবা পাঁচদিন আগে। এরপরও বিক্রি করতে পারেননি। ফলে কারও কারও পেঁয়াজে পচন ধরেছে। অপেক্ষাকৃত ভালো পেঁয়াজ বাছাই করে তা অন্য পণ্যের সঙ্গে ‘প্যাকেজ আকারে’ বিক্রি করছেন পরিবেশকরা। ক্রেতারা জানান, টিসিবির পেঁয়াজগুলোতে পচন ধরেছে, মানও ভালো না। অন্যদিকে বাজারে দেশি পেঁয়াজের ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। ফলে টিসিবির ট্রাক থেকে পেঁয়াজ কিনতে আগ্রহ হারাচ্ছেন ক্রেতারা। এদিকে, পেঁয়াজের পাশাপাশি টিসিবির ট্রাকে মাঝারি দানার এক কেজি ডালের দাম ৫০ টাকা, যা বাজারের চেয়ে ৩০ টাকা কম। পাঁচ লিটারের এক বোতল তেলের দাম ৪০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে ক্রেতার সাশ্রয় ১৫০ টাকার মতো। এছাড়াও এখন নেই চিনির সরবরাহ। অন্যদিকে অধিকাংশ ট্রাকসেলে এসব পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে না। তবেক যাদের কাছে ডাল আছে সেই ডালের সঙ্গে আড়াই কেজি এবং যেসব পরিবেশকের কাছে তেল রয়েছে তারা কমপক্ষে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ গছিয়ে দিচ্ছেন। এ জন্য ওই সব পণ্যও বিক্রি কমে গেছে।

রামপুরাসহ রাজধানীর তোপখানা রোডে অবস্থিত জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এবং মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক ছেড়ে কিছুটা দূরে অবস্থানকারী টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রির ট্রাক দেখা গেলেও ক্রেতাদের কোনও লাইন ছিল না। অলস সময় কাটাচ্ছেন পরিবেশকরা। অথচ মাত্র কয়েকদিন আগেও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে টিসিবির পেঁয়াজ স্বল্পমূল্যে কেনার জন্য বিশাল লাইন থাকত। টিসিবির ট্রাকসেলের পাশেই রামপুরা বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা সালমা খাতুন বলেন, আগেও লাইনে দাঁড়িয়ে ভিড় ঠেলে মাত্র এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে পারতাম। এখন চাহিদা অনুযায়ী পেঁয়াজ কিনতে পারছি বাজারে। বাজারে বিক্রি হওয়া দেশি পেঁয়াজের দামও কম, মানও ভালো।

এদিকে পরিবেশকদের প্যাকেজ সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এনামুল হক নামের এক ক্রেতা বলেন, জোর করে অন্য পণ্যের সঙ্গে পেঁয়াজ গছিয়ে দিচ্ছে। আমার পেঁয়াজের কোনও প্রয়োজন ছিল না। তবে তেলের জন্য পেঁয়াজ কিনতে হলো। যতটুকু পেঁয়াজ দিয়েছে এর মধ্যে বেশির ভাগ পচা বলে মনে হচ্ছে। প্রেসক্লাবের সামনে টিসিবির ট্রাক থেকে পেঁয়াজ কিনতে আসা শামছুল মিয়া বলেন, এখান থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজ কিনেছি এতদিন। আজ অবশ্য লাইনে দাঁড়াতে হয়নি।

জানতে চাইলে আরেক ডিলার আকবর আলী বলেন, প্রতিদিন আড়াই টন করে বরাদ্দ পাচ্ছি। কিন্তু বিক্রি হয় ৩০০-৪০০ কেজি। যা অবিক্রীত থেকে যায়, তা কয়েকদিনে বিক্রি করি। তাই বরাদ্দ পাওয়া পেঁয়াজ পুরোটা বিক্রি করতে সময় লাগছে। এ সময়ের মধ্যে কিছু পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বরাদ্দের পেঁয়াজ বিক্রি না হলে টিসিবি অন্য পণ্য সরবরাহ দিচ্ছে না।

টিসিবির পরিবেশকেরা যাদের কাছে তেল ডাল আছে তারা এখন নতুন কৌশল নিয়েছেন। ক্রেতাদের ভোজ্যতেল ও ডালের সঙ্গে পেঁয়াজ কিনতে বাধ্য করছেন। রাজধানীর বেগুনবাড়িতে দেখা যায়, ট্রাকে করে বোতলজাত সয়াবিন তেল, ডাল ও পেঁয়াজ বিক্রি করছে টিসিবির পরিবেশক প্যারাডাইস এন্টারপ্রাইজ। ক্রেতার কোনো ভিড় নেই। মাঝে মাঝে দু-একজন গেলে পেঁয়াজ কেনার শর্ত দেওয়া হয়। তা শুনে বেশির ভাগ ক্রেতাই ফিরে যান। কেউ কেউ অন্য পণ্যের সঙ্গে পেঁয়াজের পরিমাণ কম দেওয়ারও অনুরোধ করেন।

টিসিবির ১৫ জন পরিবেশকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা প্রায় সবাই দাবি করেন, টিসিবি যে বিদেশি পেঁয়াজ দিচ্ছে, বাজারে তার চাহিদা নেই। পচন ধরার পাশাপাশি পেঁয়াজে চারা গজিয়েছে। ভারত গত সেপ্টেম্বরে রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর বাজার সামাল দিতে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করে টিসিবি। গত অক্টোবর-নভেম্বরে টিবিসির পেঁয়াজ কিনতে ট্রাকের সামনে দীর্ঘ লাইন ছিল। দেশে মৌসুম শুরু হওয়া এবং ভারত গত ১ জানুয়ারি থেকে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় বাজারে পেঁয়াজের দাম একেবারেই কমে গেছে। সংস্থাটির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির জানান, তাঁরা মোট দেড় লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তবে কিছু পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ বাতিল করা হয়েছে। ৭০ হাজার টনের মতো পেঁয়াজ আগামী মার্চ পর্যন্ত আসবে। এগুলো কেনার প্রক্রিয়া বাতিলের সুযোগ ছিল না। তিনি আরও বলেন, পেঁয়াজ বিক্রির জন্য প্যাকেজ ব্যবস্থাকে এই মুহূর্তে বেশি কঠোরভাবে দেখা হচ্ছে না।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দেখা যায়, ভালো মানের বিদেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৩০ টাকার আশপাশেই পাওয়া যাচ্ছে। দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫-৪০ টাকা কেজিতে। পেঁয়াজের আড়তমালিক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানান, মৌসুমের সময় ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে কৃষক, ব্যবসায়ী, এমনকি টিসিবিও বেঁচে যেত। এদিকে বন্দরে পেঁয়াজের স্তূপ বাড়ছে। এসব পেঁয়াজের ভবিষ্যৎ কী, কেউ বলতে পারছে না। ডিলাররা বলছেন, পচা পেঁয়াজ নিতে গড়িমসি করলে ফেলে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে টিসিবি। ক্রেতারা বলছেন, দোকান থেকে কিনলে তাও ভালো-মন্দ দেখে কেনা যায়, কিন্তু ট্রাক থেকে সে সুযোগ নেই। আগে থেকে পলিব্যাগে ভরে রাখা পেঁয়াজ গছিয়ে দিচ্ছেন বিক্রেতারা। এর অর্ধেকই খাওয়ার অনুপযুক্ত। বাকিগুলোও স্বাদ-গন্ধহীন ঘাসপাতার মতো। বাজার থেকে কেনা পেঁয়াজগুলো ওপর থেকে দেখে ভালো মনে হলেও বেশির ভাগই ভেতরে পচন ধরেছে।

গতকাল রাজধানীর মুগদা, মালিবাগ, বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, টিসিবির পেঁয়াজবোঝাই ট্রাকগুলোতে বিক্রেতারা সময় কাটাচ্ছেন পলিব্যাগে পেঁয়াজ পোঁটলা তৈরি করে। অনেকে অবসর কাটাচ্ছেন ট্রাক থেকে নেমে কিছুটা দূরে। বেশির ভাগ ট্রাকে বিক্রি হচ্ছে দুই দিন আগে টিসিবির গুদাম থেকে ওঠানো পেঁয়াজ। নিম্ন আয়ের মানুষ ও হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোই এসব পেঁয়াজের মূল ক্রেতা এখন।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে দেশের বাজারে হু হু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। বাজার সামলাতে বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেয় সরকার। টিসিবির মাধ্যমে ট্রাক সেলের জন্য সরকার নিজেও আমদানি করে। গত ২৮ ডিসেম্বর ভারত আবার রপ্তানির বাজার খুলে দিলে আমদানির পেঁয়াজের চাহিদা একেবারেই কমে যায়। তবে এর আগে থেকেই নতুন মৌসুমের দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসায় চাহিদা কমছিল। চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে দামও কমে অর্ধেকে। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, এসব পেঁয়াজ হিমায়িত কনটেইনার থেকে নামানোর পর বেশি দিন ভালো থাকে না, পচে যায়।

https://dailysangram.com/post/440323