১২ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:৩৮

বিশ্বজুড়ে প্রাণ গেল ১৯ লাখ ৩৪ হাজার মানুষের

আক্রান্ত ৯ কোটি ২ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি # দেশে আরও ২২ জনের মৃত্যু
ইবরাহীম খলিল : চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি সেখানে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এরপর থেকে এক বছর পার হলো গতকাল সোমবার। এ সময় পর্যন্ত পুরো পৃথিবীতে ১৯ লাখ ৩৪ হাজার ৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনা ভাইরাসে। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা পেরিয়ে গেল নয় কোটি ২লাখ ৩৭ হাজারের বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের টালিতে হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ সময় সোমবার সকাল সোয়া ৮টা পর্যন্ত বিশ্বে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ২ লাখ ৩৭ হাজার ৪৬৯ জন। আর আক্রান্তদের মধ্যে ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৬৩ হাজার ৫৪৫ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

প্রসঙ্গত, চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি সেখানে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। চীনের স্বাস্থ্য বিভাগ ওই সময় জানায়, অজানা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৬১ বছর বয়সী এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। পরে জানা যায়, ওই ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তবে চীনের উহান শহর বর্তমানে সম্পূর্ণ নিরাপদ। ৬৬ বছর বয়সী জিয়ং লিয়ানশেং নামের এক বাসিন্দা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, চীনের মধ্যে উহান এখন নিরাপদ শহর। এমনকি সারাবিশ্বের মধ্যে উহান এখন নিরাপদ বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে উহান শহরের মানুষের সচেতনতা অনেক উচ্চমানের। এমনকি আমার দুই বছরের নাতি বাড়ির বাইরে গেলে মাস্ক পরে বের হয়। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার ব্যাপারে সমালোচিত হয়েছে চীন। এমনকি শুরুতে ভাইরাসের ব্যাপারে চুপ থেকে সচেতন হওয়ার সুযোগ তৈরির পথ রোধ করারও অভিযোগ রয়েছে দেশটির বিরুদ্ধে। ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পর লকডাউনে চলে যায় উহান শহর। এখন পর্যন্ত চীনে করোনায় মোট শনাক্তের সংখ্যা ৮৭ হাজার পাঁচশ ৩৬ জন এবং মারা গেছে চার হাজার ছয়শ ৩৪ জন। সে দেশে আক্রান্তদের মধ্যে সেরে গেছে ৮২ হাজার দু'শ ২৯ জন এবং বর্তমানে আক্রান্ত অবস্থায় রয়েছে ছয়শ ৭৩ জন।

এমন এক সময়ে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৯ কোটির ঘর ছাড়াল যখন যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের অতি সংক্রামক দুটি নতুন ধরন নিয়ন্ত্রণে লড়তে হচ্ছে বিভিন্ন দেশকে। একই সঙ্গে ভাইরাসের প্রকোপ কমিয়ে আনতে বিশ্বজুড়ে চলছে বড় আকারে টিকাদানের প্রস্তুতি। জনস হপকিন্সের তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে শনাক্ত রোগী দ্বিগুণ হতে সময় লেগেছে মাত্র ১০ সপ্তাহ। অক্টোবরের শেষ দিকে যেখানে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল সাড়ে চার কোটি, এখন তা পৌঁছেছে নয় কোটির ঘরে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন এই করোনাভাইরাস ঠিক কোথা থেকে প্রথম ছড়াল, তা হয়তো কোনোদিনও জানা যাবে না। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। যার অন্যতম করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা। এছাড়া, সার্বিক তথ্যও প্রকাশ করেনি চীন।

বিজ্ঞানীদের প্রাথমিক ধারণা, ২০১৯ সালের শেষ দিকে উহানের হুয়ানান সামুদ্রিক খাবারের বাজার থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে। ওই বাজারে বন্য প্রাণী বিক্রি করা হতো। অজ্ঞাত প্রজাতির বাদুড় থেকে ভাইরাসটি কোনোভাবে মানবদেহে এসেছে বলেই অনুমান করছেন বিশেষজ্ঞরা। চীনের কর্তৃপক্ষ প্রথমে বলেছিল, উহানের সামুদ্রিক খাবারের বাজার থেকেই করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। কিন্তু দেশটির প্রকাশিত গত বছরের জানুয়ারি মাসের তথ্য ভিন্ন কিছুরই ইঙ্গিত দিয়েছে। এতে দেখা গেছে, ওই বাজারের সঙ্গে করোনার খুব একটা যোগ নেই। ভাইরাসের উৎস অন্য কোথাও। এরপর চীন আর তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেনি।

ভাইরাসের উৎস সন্ধানে সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একদল বিশেষজ্ঞ চীন সফরের পরিকল্পনা করেন। তবে রোববার পর্যন্ত তাঁদের ভিসা দেয়নি চীনা কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগতত্ত্ববিদ ডেনিয়েল লুসি বলেন, বেইজিং হয়তো বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে তথ্য গোপনের চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে উহানে দ্রুতগতিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছিল। তার মানে দাঁড়ায়, করোনার সূত্রপাত হয়তো আরও আগে থেকে। কেননা একটি ভাইরাস ব্যাপক সংক্রামক হয়ে ওঠার আগে কয়েক মাস বা কয়েক বছর ধরে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়।

আক্রান্তের সংখ্যায় সবার উপরে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত ২ কোটি ২৩ লাখের বেশি মানুষের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। মৃত্যুর সংখ্যাতেও যুক্তরাষ্ট্র সবার চেয়ে এগিয়ে, এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৭৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে সেখানে। সংক্রমণের সংখ্যায় ভারত এখন বিশ্বে দ্বিতীয়, সেখানে এক কোটি সাড়ে চার লাখ রোগী শনাক্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে দেড় লাখ মানুষের। মৃতের সংখ্যায় বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ব্রাজিল, সেখানে ২ লাখ ৩ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এ ভাইরাস। সরকারি হিসাবে আক্রান্ত হয়েছে ৮ কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষ।

দুই মাস আগে যুক্তরাজ্য থেকে করোনাভাইরাসের যে নতুন ধরনটি ছড়াতে শুরু করেছিল, সেটি মেক্সিকো, ফ্রান্স ও রাশিয়াতেও পৌঁছে গেছে। ২০১৯ সালের শেষে চীনের উহান থেকে নতুন করোনাভাইরাস পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে তা মহামারীর রূপ পায়। ব্যাপক বিধিনিষেধের মাধ্যমে চীন সরকার গতবছর এপ্রিলের পর থেকে সংক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। ১০ জানুয়ারি চীনে ৮৫ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ে, যা গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে রয়টার্স। সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাস টিকাদানের গতি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। যুক্তরাজ্যে সোমবার চালু করা হচ্ছে সাতটি বড় আকারের টিকাদান কেন্দ্র।
এখন সেখানে প্রতিদিন দুই লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের টিকা দেয়া শেষ করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে যুক্তরাজ্য সরকার। সেই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে সপ্তাহে ২০ লাখ মানুষকে টিকা দিতে হবে।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ : এদিকে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে গত এক দিনে আরও ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে, নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে আরও ৮৪৯ জন। সোমবার বিকালে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির এই সবশেষ তথ্য জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, সকাল ৮টা পর্যন্ত শনাক্ত ৮৪৯ জনকে নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৩০২ জন হয়েছে। আর গত এক দিনে মারা যাওয়া ২২ জনকে নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে মোট মৃতের সংখ্যা ৭ হাজার ৮০৩ জনে দাঁড়িয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে বাসা ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ৯১৭ জন রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন গত এক দিনে। তাতে এ পর্যন্ত সুস্থ রোগীর মোট সংখ্যা বেড়ে ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৭১৮ জন হয়েছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল গত ৮ মার্চ; তা ৫ লাখ পেরিয়ে যায় ২০ ডিসেম্বর। এর মধ্যে গত ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২৯ ডিসেম্বর তা সাড়ে সাত হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে ৩০ জুন এক দিনেই ৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ মৃত্যু। বিশ্বে শনাক্ত কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে সাড়ে ৯ কোটি ২ লাখ পেরিয়েছে, মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১৯ লাখ ৩৫ হাজার। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বিশ্বে শনাক্তের দিক থেকে ২৭তম স্থানে আছে বাংলাদেশ, আর মৃতের সংখ্যায় রয়েছে ৩৭তম অবস্থানে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১১৪টি আরটি-পিসিআর ল্যাব, ২৮টি জিন-এক্সপার্ট ল্যাব ও ৫১টি র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ল্যাবে অর্থাৎ সর্বমোট ১৯৩টি ল্যাবে ১৪ হাজার ৯৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ৩৩ লাখ ৭১ হাজার ৪১৬টি নমুনা। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ৬ দশমিক ০২ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় এ পর‌্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ২৬ লাখ ৫৮ হাজার ৬৪৪টি। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হয়েছে ৭ লাখ ১২ হাজার ৭৭২টি। গত এক দিনে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ১৫ জন পুরুষ আর নারী ৭ জন। তাদের মধ্যে ২১ জন হাসপাতালে ও ১ জন বাড়িতে মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ১৫ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ৫ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে এবং ১ জন করে মোট ২ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ ও ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ছিল। মৃতদের মধ্যে ১৮ জন ঢাকা বিভাগের, ২ জন চট্টগ্রাম বিভাগের এবং ১ জন করে মোট ২ জন রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন। দেশে এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ৭ হাজার ৮০৩ জনের মধ্যে ৫ হাজার ৯২৭ জনই পুরুষ এবং ১ হাজার ৮৭৬ জন নারী।

তাদের মধ্যে ৪ হাজার ২৮৪ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি। এছাড়াও ১ হাজার ৯৭০ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, ৯০৭ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, ৩৮৬ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে, ১৬১ জনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, ৫৯ জনের বয়স ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এবং ৩৬ জনের বয়স ছিল ১০ বছরের কম। এর মধ্যে ৪ হাজার ৩১৬ জন ঢাকা বিভাগের, ১ হাজার ৪৩৩ জন চট্টগ্রাম বিভাগের, ৪৪৮ জন রাজশাহী বিভাগের, ৫৩৯ জন খুলনা বিভাগের, ২৩৯ জন বরিশাল বিভাগের, ২৯৬ জন সিলেট বিভাগের, ৩৫০ জন রংপুর বিভাগের এবং ১৮২ জন ময়মনসিংহ বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন।

https://dailysangram.com/post/440320