১২ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:৩৪

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিন

ড. মো. নূরুল আমিন : গত এগার মাস ধরে পর্যায়ক্রমে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট সবকিছুই কার্যত বন্ধ। বেসরকারি প্রাথমিক ও কেজি স্কুলগুলো উদ্যোক্তারা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। হাজার হাজার শিক্ষক এখন বেতন পান না, যারা পান তারা অর্ধেক বা তারও কম পান। স্কুল বন্ধ থাকায় ছাত্রবেতনও বন্ধ। অনলাইনে ক্লাস নেয়ার নাম করে এখন সকল প্রতিষ্ঠানেই বেতন পরিশোধ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেয়ার প্রক্রিয়া কিছুটা সহজ হয়েছে। কিন্তু তথাপিও এই খাতের সামগ্রিক অবস্থা ভয়াবহ।

উল্লেখ্য যে, আমাদের প্রি-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্কুলসমূহের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা এবং ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটসমূহের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২ কোটি ৭৬ লাখ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে আমাদের মোট ছাত্র জনসংখ্যার পরিমাণ হচ্ছে ৪ কোটি ৪৬ লাখ যা মোট জনসংখ্যার (সাড়ে ১৬ কোটি) প্রায় ২৭ শতাংশ। এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। আগামী দিন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তাদেরই। তারা এই দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পারবে তা নির্ভর করছে আমরা তাদের কতটুকু শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারছি। গত ১১ মাসের হিসাব হতাশাব্যঞ্জক। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে কয়েক মাস গেছে লকডাউনে। তখন মানুষ ছিল ঘরবন্দী; স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত বন্ধ। লকডাউন প্রত্যাহার হয়েছে তিন-চার মাসেরও বেশি সময় আগে। গণপরিবহণ চলছে, হাটবাজার, অফিস ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শপিং সেন্টার, সিনেমা হল সব কিছুই চালু, কোথাও যেতে বাধা নেই। বাধা শুধু এক জায়গায়, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলো বন্ধ। কিন্তু কেন? সব জায়গায় যদি যাওয়া যায় তাহলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাওয়া এবং পড়ালেখা করা হারাম হবে কেন? ছাত্রছাত্রীদের সাথে আমার মাঝেমধ্যে ইন্টারেকশান হয়। তারা হতাশ, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠিত। তাদের মধ্যে বর্তমানে যত উৎকণ্ঠা দেখছি তা বোধ হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসেও ছিল না। তারা জানেনা তাদের আগামী দিন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তাদের ক্যারিয়ারের কি হবে! যে ছেলেটি মাস্টার্স পাস করে চাকরির বাজারে আজ প্রবেশ করার কথা ছিল সে এখন জানে না তর অনার্স পরীক্ষাটা আদৌ হবে কিনা। অনেক চিন্তা গবেষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঠিক করলেন এইচএসসি পরীক্ষা হবে না, আগের পাবলিক পরীক্ষাসমূহের গড় রেজাল্টের ভিত্তিতে তারা অটোপ্রমোশন পাবে এবং ২৯ শে ডিসেম্বর রেজাল্টের তারিখ ঠিক হলো। ডিসেম্বর চলে গেলো, জানুয়ারিও চলে যাচ্ছে কিন্তু রেজাল্টের কোনও খবর নেই।

এদিকে আরেকটি মজার ঘটনা ঘটেছে। আমাদের সরকার করোনার ভয়ে এইচএসসি পরীক্ষা নিলেন না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই এইচসির সমপর্যায়ের একটি পরীক্ষা আছে, এ-লেভেল যা ব্রিটিশ কাউন্সিল দুনিয়াব্যাপী পরিচালনা করে। এই পরীক্ষাটি তারা বন্ধ করেনি। সম্প্রতি শারীরিক উপস্থিতিতেই তা শুরু হয়েছে এবং বাংলাদেশের কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী তাতে অংশগ্রহণ করছে। এখানে এইচএসসির ছাত্রছাত্রীরা মার খেয়ে গেলো। ক্যারিয়ারের বাকী জীবনগুলোতে তারা তা উপলব্ধি করবে। ও-লেভেল এ লেভেল পরীক্ষা Physical attendencc-এর ভিত্তিতে হতে পারলে ঐঝঈ পরীক্ষা হতে পারলো না কেন, এর জবাব কি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে? Medical education নিয়ে অনেকেই উদগ্রীব। এই শিক্ষার সাথে মানুষের জীবন মরনের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। এই শিক্ষার থিওরেটিক্যাল এবং প্র্যাকটিক্যাল ক্ষেত্রে যদি সামান্য গড়বড় হয় তা হলে মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে। এর উভয় ক্ষেত্রই এখন বন্ধ। অনলাইন শিক্ষার যে ব্যবস্থা সম্প্রতি চালু করা হয়েছে তা অপ্রতুল ও ত্রুটিপূর্ণ। অনেক ইন্টার্নি ডাক্তারের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। নতুনভাবে এমবিবিএস পাস না করলে নতুন ইন্টার্নিরাও যোগ দিতে পারবেন না। ফলে হাসপাতালগুলোতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। একই অবস্থা Physio-therapistদের বেলায়ও। গরীব অভিভাবক যারা ছেলে মেয়ে পাস করে চাকরিতে ঢোকার আশায় বসে থাকেন তাদের অবস্থা যে কি তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

বাচ্চারা যাতে উচ্ছন্নে যেতে না পারে সে জন্যে মুরুব্বীরা তাদের হাতে মোবাইল দিতে নিষেধ করেন। Android মোবাইল সেট তো মোটেই না। কিন্তু এখন অবস্থা হচ্ছে কি?
একজন অভিভাবক তার সপ্তম শ্রেণীর মেয়ের অনলাইন ক্লাসের একটি রুটিন আমার কাছে পাঠিয়েছেন। তার ক্লাস শুরু হয় সকাল ৮টায়, চলে ১১:৪৫ মি. পর্যন্ত। এরপর গোসল, দুপুরের খাবার ও নামাজের জন্য ১ ঘণ্টা ১৫ মি. বিরতি। পুনরায় ১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত টানা ক্লাস। তার কেজি শ্রেণীর পুত্রেরও একটা রুটিন আছে। সকাল ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত তার ঝুম ক্লাস হয়, বাস্তব অবস্থা হচ্ছে উভয় ছেলেমেয়েই অনলাইন ব্যবস্থায় ভারাক্রান্ত। Sound সমস্যায় ঝুমে ঠিক মত আওয়াজ শোন যায় না, ছবি ভাল আসে না। রুমের দরজা লাগিয়ে ক্লাস করতে হয়। এতে অভিভাবকের তত্ত্বাবধান থাকে না। ক্লাস চলাকালে অনেক ছেলেমেয়ে Facebook id খুলে, group chatting করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল ব্যবহারের ফলে মাথাব্যথা নিত্যরোগে পরিণত হয়েছে। মোবাইল নিয়ে বসে থাকায় পিঠে ব্যথার উপসর্গও দেখা দিচ্ছে। আবার কিছু কিছু ছেলেমেয়ে এই সুযোগে উচ্ছন্নেও যাচ্ছে। ইন্টারনেটের খারাপ জিনিসগুলোর প্রতি তারা আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। মোবাইল না পেলে তাদের ম- মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যারা শ্রেণীকক্ষের শারীরিক হাজিরার পরিবর্তে অনলাইনভিত্তিক ঝুম ক্লাসের ডিজাইন করেছেন তারা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চিন্তাভাবনা করেছেন কিনা আমি জানি না।

তবে ইতোমধ্যেই অভিভাবকরা এগুলো উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। এর প্রতিকার হওয়া দরকার। নিয়ন্ত্রণহীন ঝুম ক্লাস নৈতিক দেউলিয়াপনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এতে দরিদ্র পিতামাতা এনড্রয়েড মোবাইল ও ইন্টারনেট ক্রয় বাবদ যে ব্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন তা বলাইবাহুল্য। কয়জনই বা এই ব্যয় বইতে পারে? প্রশ্ন উঠতে পারে এর বিকল্প কি? আমার স্থির বিশ্বাস স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার মধ্যেই এর একমাত্র সমাধান নিহিত রয়েছে। যদি আমাদের দেশে সকল সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান খোলা থাকতে পারে তা হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলায় বাধা কোথায়? করোনার ভয়? সেই ভয় তো আল্লাহর রহমতে অনেক আগেই আমরা জয় করে ফেলেছি। কিছু কিছু মাদরাসা ইতোমধ্যে খুলে দেয়া হয়েছে। কই সেখানে তো সমস্যা হচ্ছে না? কেউ কেউ বলেন, ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে না। আমার মনে হয় এই আশংকাটি সত্যি নয়, যেসব সামাজিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে, এমন কি মাদরাসাও, করোনা প্রসারের উপর সেগুলোর প্রভাবের উপর একটি Study হতে পারে। এ ধরনের একটা Quick Study করে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবিলম্বে খুলে দেয়া জরুরি বলে আমি মনে করি। এই Study’র ফলাফল পজিটিভ হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

https://dailysangram.com/post/440315