১১ জানুয়ারি ২০২১, সোমবার, ৭:৪৩

কতো মানুষ ভ্যাকসিন নেবে?

করোনা ভ্যাকসিন কবে আসবে সেই অপেক্ষায় গোটা বিশ্ব। করোনা নির্মূল করতে ভ্যাকসিনেই ভরসা খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু এবার সেই ভ্যাকসিন থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অসংখ্য মানুষ। বাংলাদেশেও ভ্যাকসিন গ্রহণ না করার ব্যাপারে অনেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ও সঠিক প্রচারণার অভাবে মানুষের মধ্যে এমন নেতিবাচক প্রবণতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই নেতিবাচক প্রবণতা শুধু পল্লী এলাকার মানুষের মধ্যে নয়। শহরের সচেতন মানুষ এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও ভ্যাকসিন নিয়ে অনাগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। জাতিংসংঘে কর্মরত একজন চিকিৎসক জানান, তিনি কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন গ্রহণ করবেন না।

তার ধারণা, ইতিমধ্যে তিনি হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করে ফেলেছেন। তাই তার ভ্যাকসিনের প্রয়োজন নেই। তবে পরিবারের সদস্যদের অবশ্যই ভ্যাকসিন দেবেন। একই মত দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের একজন শিক্ষক। তিনিও ভ্যাকসিন গ্রহণ না করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গত শনিবার রাজধানীর বিএমএ মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ জানতে চান কারা কারা ভ্যাকসিন গ্রহণ করবেন না। সেখানে উপস্থিত অনেকেই হাত তুলে জানান দেন যে, তারা ভ্যাকসিন গ্রহণ করবেন না। এরমধ্যে নারীদের সংখ্যাই বেশি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান কেকেএফ-এর এক জরিপে দেখা গেছে, পল্লী এলাকার খুব কম সংখ্যক মানুষ ভ্যাকসিন গ্রহণের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের পল্লী এলাকার ৩১ শতাংশ বাসিন্দা নিশ্চিত ভ্যাকসিন নিবেন। ভ্যাকসিন গ্রহণের সম্ভাব্যতার কথা জানিয়েছেন ৩৩ শতাংশ মানুষ। ১৫ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তারা ভ্যাকসিন হয়তো গ্রহণ করবেন না। আর ২০ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন না নেয়ার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শহর এলাকায় ৪২ শতাংশ মানুষ নিশ্চিত ভ্যাকসিন গ্রহণ করবেন। আর ১৫ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন গ্রহণ না করার পক্ষে। বাকিরা এখনও নিশ্চিত নন।

ভারতে প্রায় ৬৯ শতাংশেরও বেশি মানুষ ভ্যাকসিন নিতে দ্বিধায় রয়েছেন। অক্টোবরে এই টিকা অনিচ্ছুকদের সংখ্যা কিন্তু আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাথমিকভাবে সেই হার ছিল ৬১ শতাংশ। কমিউনিটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম লোকাল সার্কেলস জানাচ্ছে, সারা দেশের ২৪২টি জেলার ১৮ হাজার জনেরও বেশি লোকের ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয়। এদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৪ শতাংশ মহিলা। প্রথম সমীক্ষা ১৫ থেকে ২০শে অক্টোবরের মধ্যে করা হয়েছিল, দ্বিতীয়টি ১০ থেকে ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছিল। অন্যদিকে, আরেকটি সমীক্ষায় স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের ৪৫ শতাংশ জানিয়েছেন তারা করোনা ভ্যাকসিন নিতে ইচ্ছুক। ৫৫ শতাংশ কর্মীরা এখনও ঠিক করে উঠতে পারেননি। যদিও এই তথ্য উদ্বেগ বাড়াচ্ছে দেশে- এমনটাই মত গবেষক মহলের।

লোকাল-সার্কেলস পরিচালিত জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রশ্ন করা হয়, ভারতে প্রথম কোভিড-১৯ টিকা এখন অনুমোদন পেয়েছে। এ টিকা গ্রহণের বিষয়ে আপনার মতামত কী? মোট ৮ হাজার ৭২৩ জনের কাছ থেকে উত্তর এসেছে। তাদের মধ্যে মাত্র ২৬ শতাংশ বলেছেন, টিকা পাওয়ামাত্রই তারা গ্রহণ করবেন। করোনার টিকা নিয়ে সংস্থাটি জনসাধারণের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আসছে গত বছরের অক্টোবর থেকে। এর মাধ্যমে তারা বোঝার চেষ্টা করছে, টিকা গ্রহণে অনীহা বা দ্বিধাগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, কমছে নাকি অপরিবর্তিত থাকছে। অক্টোবর মাসে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, তখন কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণ নিয়ে দ্বিধায় থাকা ভারতীয়র সংখ্যা ছিল ৬১ শতাংশ। পরে ফাইজার ও মডার্না তাদের উদ্ভাবিত টিকার ব্যাপক কার্যকারিতার ফল প্রকাশ করলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। নভেম্বরে টিকা গ্রহণ নিয়ে দ্বিধায় থাকা ভারতীয়র সংখ্যা ৫৯ শতাংশে নেমে আসে। সিরাম ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরির খবরে ভারতে নতুন আশার সঞ্চার করে। কিন্তু লোকাল-সার্কেলসের জরিপে দেখা যাচ্ছে, এ খবর টিকা নিয়ে ভারতীয়দের দ্বিধা আরো বাড়িয়েছে। এখন করোনার টিকা নেবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় ৬৯ শতাংশ ভারতীয়। টিকা নিয়ে এ অনীহার পেছনে বিভিন্ন কারণ সামনে আসছে। বড় দু’টো কারণ হচ্ছে, টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও পরীক্ষামূলক প্রয়োগে টিকার কার্যকারিতার ফল নিয়ে সংশয়। জনসাধারণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীরাও এ দু’টো কারণকে বড় করে দেখছেন। গত ২৭শে ডিসেম্বর থেকে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা প্রদান শুরু করেছে ফ্রান্স। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য সদস্যরাও একই সময়ে তা শুরু করে। অডোক্সা পোলিং গ্রুপ এবং লা ফিয়াগোরো সংবাদপত্রের সামপ্রতিক এক জরিপ অনুযায়ী, ফ্রান্সের ৫৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী কোভিড-১৯ এর টিকা নিতে আগ্রহী নয়। যুক্তরাজ্যে এই সংখ্যা ৩৩ শতাংশ আর যুক্তরাষ্ট্রে ৪১ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরাম ১৫টি দেশের ১৮ হাজার ৫২৬জন মানুষের ওপর জরিপ চালিয়েছে। জরিপের ফলে দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন গ্রহণের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতিমধ্যে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন বিতরণ পরিকল্পনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। এ পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে মাসওয়ারি ভ্যাকসিন প্রদানের ছক তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই ছকে দেখা যায়, প্রতি মাসে ২৫ লাখ ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা ভাবছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকার মোট ৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার পরিকল্পনা করেছে। প্রথমে ৩ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হবে। এদের মোট সংখ্যা দেড় কোটির মতো। এরপর ভ্যাকসিন পাওয়া মানুষের হার পর্যায়ক্রমে ৭, ১০, ২০ ও ৪০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। ভ্যাকসিন বিতরণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটিও করেছে সরকার। তবে কত মানুষ ভ্যাকসিন গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহী না সেই সংখ্যা সরকারের কাছে নেই। এ নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো গবেষণাও হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক কোনো মন্তব্য করেননি। তবে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ডা. মোশতাক হোসেন মানবজমিনকে বলেন, ভ্যাকসিন নিয়ে অনাগ্রহের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা দরকার। বতর্মানে আমাদের কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই ঠিক কত মানুষ ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী না। তবে বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষণা চলছে। খুব শিগগিরই হয়তো জানা যাবে। এটা জানতে পারলে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=258146