১১ জানুয়ারি ২০২১, সোমবার, ৭:৩৯

রাজধানীতে ২ বছরে রেকর্ড বায়ুদূষণ

রাজধানীর বায়ুদূষণ দুই বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল। গতকাল রাজধানীতে বায়ুদূষণের মানমাত্রা ছিল ৫০২, যা গত দুই বছরের সর্বোচ্চ। সর্বশেষ গত বছরের ৬ ডিসেম্বর ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল ৪৩০ মাইক্রোগ্রাম। যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে সাত গুণ বেশি। এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা শহরের বাতাসে দূষিত বস্তূকণার পরিমাণ ছিল সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাইবিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজুয়াল’-এর বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী গতকাল বেলা ১১টা থেকে বেলা পৌনে ১টা পর্যন্ত গড়ে ঢাকা প্রথম স্থানেই আছে এবং দূষণের মাত্রা গড়ে ৫০২ পর্যন্ত উঠেছিল।
বায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আবহাওয়াকে তারা দুর্যোগপূর্ণ বলে মনে করেন। এখনই দূষণ কমাতে পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার নিতে পারে। বেলা ১টার পরে কিছুটা কমে এখন ২২১-এ এসে দাঁড়িয়েছে। তারপরও ঢাকা এখনো প্রথম স্থানেই আছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে ঢাকায় দূষণের মাত্রা সম্প্রতি অনেক বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম দুই দশমিক পাঁচের কারণেই ঢাকায় দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেলেই পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠছে।

এর সাথে একমত পোষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতের শুরু থেকেই এ পর্যন্ত ঢাকার বাতাসে দূষিত বস্তুকণা যে পরিমাণ মিলেছে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর। তাদের মতে, মেট্রোরেলসহ নির্মাণকাজ, ইটভাটা, অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল এসব কারণেই ঢাকা দূষণের ভয়াবহ অবস্থানে চলে গেছে। অন্য দিকে বৃষ্টি না থাকায় ধুলাবালি নিচে চলে আসে। শীতের কারণে বাতাসে জলীয়বাষ্প আটকে গিয়ে বায়ুদূষণ বাড়ে।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের বায়ুমান বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, আবহাওয়াগত কারণেই শীতে বায়ুদূষণ বাড়ে। কারণ এ সময়ে সাধারণত সব নির্মাণকাজ চালু থাকে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে দূষণের বড় উৎস ইটভাটা, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বড় ভবন ও অবকাঠামো তৈরির কাজ। এসব কারণে বাতাসে জলীয়বাষ্প আটকে গিয়ে বায়ুদূষণ বাড়ে।

তিনি জানান, বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা প্রতিদিনের একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত সে বিষয়টি নির্ধারণ করে। সে হিসেবে একিউআই সূচকে বাতাসের মান ৫০ এর নিচে থাকলে তা স্বাভাবিক বলেই বিবেচিত হয়। আর সূচকে তা যদি ১০০ স্কোরের মধ্যে থাকে তবে তা অস্বাভাবিক হলেও ক্ষতিকর মাত্রায় পড়ে না। তবে তা ১০১ থেকে ১৫০ এ অবস্থান করলে তা শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ রোগীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। আর স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা সব মানুষের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। একিউআই স্কোর ৩০১ থেকে ৫০০ বা তারও বেশি হলে বাতাসের মান প্রত্যেক নগরবাসীর জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
দূষণের উৎসগুলো দমন করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘কতগুলো শিল্পকারখানা থাকবে, দূষণ কতটুকু হবে এগুলোর পরিকল্পনা সরকারের নেই। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে রাজধানীসহ দেশের প্রধান শহরগুলোর বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা নেয়া উচিত। শিল্পকারখানার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক বর্জ্যনিষ্কাশন প্রক্রিয়া নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, তাতে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হলেও সম্ভব হবে।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে বিশিষ্ট নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব নয়া দিগন্তকে বলেন, নগরীকে বাসযোগ্য রাখতে হলে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের নির্মাণকাজ পরিবেশবান্ধব করে চালাতে বাধ্য করতে হবে। ঢাকার চারিদিকে বিস্তৃত ইটের সব ভাটা বন্ধের পাশাপাশি প্রতিটি নির্মাণস্থল ঢেকে রাখা উচিত। শুকনো মওসুমে অবশ্যই নগরিতে পানি ছিটানো ও নগরীজুড়ে বনায়ন বাড়ানোসহ কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে বায়ুদূষণ রোধ সম্ভব বলে জানান তিনি।

কেন দূষণের মাত্রা এত বেশি জানতে চাইলে বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, দূষণের মাত্রা অনেক বেশি এখন। এটা আরো ক’দিন এমনই থাকবে। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, এতদিন আমরা বাইরে থেকে আসা বাতাসের সাথে ধুলোবালিকেই দায়ী করেছি বেশি। আজ বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। আজ পুরো দূষণের কারণ আমাদের নিজেদের দূষণ। বড় প্রকল্পের কাজ, যানবাহনের ধোঁয়া, আবর্জনা পোড়ানোর ধোঁয়াই মূলত দায়ী। এগুলো বন্ধ করে দ্রুত বড় রাস্তাগুলোতে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা দরকার এখনই। নইলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহীসহ সভাপতি আব্দুল মতিন বলেন, দূষণ কেন হয়, দূষণ রোধে কী কী করতে হবে তা আমরা যেমন জানি, সরকারও জানে। গণমাধ্যমে বহুবার বহুদিন এসব নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। আসল বিষয় হচ্ছে সরকার এটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে কি না। নইলে সবই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সরকার চাইলেই রোধ করা সম্ভব। বায়ুদূষণ রোধে অগ্রাধিকার দিয়ে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। এর বিকল্প আর কিছু নেই।
সরকারের পক্ষ থেকে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো: মনিরুজ্জামান বলেন, আমরা ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি। টিম করে সেই টিমের মাধ্যমে মনিটরিং করা হচ্ছে। দূষণ রোধে প্রায় প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দূষণ রোধে শুধু পরিবেশ মন্ত্রণালয় কাজ করলে হবে না, তাই দুই সিটি করপোরেশনের সাথেও কয়েক দফা সভা করেছি আমরা। রাস্তায় পানি দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়েও কাজ চলছে। দূষণ শুধু আমাদের জন্যই হয় তা নয়, বাইরে থেকেও বাতাসের সাথে ধূলিকণা আসে। এতেও আমাদের দূষণ বেড়ে যায়। আমরা দূষণ কমিয়ে আনতে যা যা করার দরকার তা করছি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/554981/