১১ জানুয়ারি ২০২১, সোমবার, ৭:৩৯

করোনা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে

সতর্ক থাকার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

বাংলাদেশে গত এক সপ্তাহে করোনা শনাক্ত ছিল হাজারের নিচে। কিন্তু গতকাল রোববার তা হাজার ছাড়িয়ে যায়। গতকাল ১২ হাজার ৯২০টি নমুনা পরীক্ষা করে এক হাজার ৭১ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে করোনা পজিটিভ হিসেবে। এর আগে প্রায় সপ্তাহব্যাপী নতুন শনাক্তের সংখ্যা হাজারের নিচে ছিল। মোট নমুনা পরীক্ষার চেয়ে গত ৮ জানুয়ারি শনাক্তের হার পাঁচ দশমিক ৭৪-এ নেমে আসে। গতকাল নমুনা পরীক্ষার চেয়ে শনাক্তের হার আট দশমিক ২৯ শতাংশ। এতে যে কেউ মনে করতে পারে বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণের কাছাকাছি চলে এসেছে। হয়তো করোনার প্রথম ঢেউ এখানেই শেষ হচ্ছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী কয়েক দিন ধরে করোনা শনাক্ত বেশ কম হলেও তাতে আত্মতুষ্টিতে ভুগতে চান না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা: এম মোজাহেরুল হক। তিনি বলেন, শনাক্ত কম হলেও করোনা নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। করোনা এমন একটি ভাইরাস যাতে একজন আক্রান্ত থাকলেও কেউ নিরাপদ থাকতে পারে না। সে কারণে করোনা নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে সবাইকে। হাত ধোয়া, মুখে মাস্ক ব্যবহার করা, ভিড়ের মধ্যে না যাওয়ার কাজটি করে যেতে হবে। তিনি বলেন, করোনার ব্যাপারে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, বাংলাদেশে করোনা কমছে এতে স্বস্তি প্রকাশের সুযোগ নেই, বরং সতর্কতা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে গত এক সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন মারা গেছে ২৩ জন, যা জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মহামারীর প্রথম ওয়েভের পিক সময়ে মৃত্যু সংখ্যার অর্ধেক। ৮ জানুয়ারিতে নতুন করোনা শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৭৮৫ জন। এটি ২০২০ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ কম। এতে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে। এমনটি দেখা যাচ্ছে ভারতেও। ভারতে এখন দৈনিক নতুন করোনা শনাক্তের সংখ্যা এবং দৈনিক মৃত্যু সংখ্যা প্রথম ওয়েভের পিক সময়ের চেয়ে পাঁচ গুণ কম। দুই দেশের জন্যই এটি মহামারীর প্রথম ওয়েভ (ঢেউ) সম্পন্ন হওয়ার ইঙ্গিত।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম এ বিষয়ে আরো বলেন, তবে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে করোনা মহামারীর চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। ৮ জানুয়ারি, পৃথিবী দেখল এক দিনে সর্বোচ্চ করোনা সংক্রমণ। ওই দিন সারা পৃথিবীতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে আট লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। আক্রান্তের এ সংখ্যাটি গত বছরের মধ্য-এপ্রিলের প্রথম ওয়েভের পিক সময়ের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। গত ৮ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী মোট মৃত্যু ছিল প্রায় ১৫ হাজার। এটাও এ যাবৎকালের একটি রেকর্ড। অর্থাৎ গোটা বিশ্বে করোনা সংক্রমণ এবং তা থেকে মৃত্যু উভয়ই বাড়ছে হু হু করে।

গত বছরের মার্চের পর থেকে করোনার দ্রুত বিস্তারের সাথে ভাইরাসটির ডি-৬১৪-জি মিউটেশনকে দায়ী করা হয়। মূলত এখন বিশ্বব্যাপী যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হচ্ছে তার ৯৯ শতাংশই এই রূপান্তরিত বা মিউটেটেড ভাইরাস। এর ওপর সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হয়েছে আরো একটি নতুন মিউটেটেড বা রূপান্তরিত করোনাভাইরাস। এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসের ১৭টি মিউটেশন হয়েছে এর স্পাইক প্রোটিনে। এতগুলো মিউটেশন একসাথে এর আগে কখনো হয়নি। যুক্তরাজ্যে প্রথম এই চলমান মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব কমতে শুরু করেছে। এটি স্বস্তিকর খুব বেশি স্বস্তির খবর নয়।

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ক্রমেই কমছে এটি ভালো খবর, কিন্তু বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট এবং করোনা মহামারীর গতি-প্রকৃতি বিচারে এতে স্বস্তির কিছু নেই। করোনা মহামারী একটিমাত্র ওয়েভে সীমাবদ্ধ নয়। একটির পর আরেকটি ওয়েভ আসবে, এটিই স্বাভাবিক। আর উপরের উদাহরণ থেকে দেখা যায় প্রতি ক্ষেত্রেই প্রথম ওয়েভের চেয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ওয়েভ মারাত্মক।

ড. মেহেদী আকরাম বলেন, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি প্রথম ওয়েভে বেশ নিয়ন্ত্রণের ভেতরেই ছিল। কিন্তু তার মানে এটি নয় যে পরবর্তী ওয়েভেও তা নিয়ন্ত্রণের ভেতরে থাকবে। মহামারীর প্রথম তাণ্ডবের সময় ইউরোপের সব দেশ যখন নাস্তানাবুদ, তখন জার্মানি বেশ ভালোভাবেই তাদের প্রথম ওয়েভকে নিয়ন্ত্রণের ভেতরে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ওয়েভে দেশটির অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। এখন প্রতিদিন ওখানে করোনায় মারা যাচ্ছে গড়ে এক হাজার মানুষ, যেখানে প্রথম ওয়েভের পিকে মারা যেত ২৫০ জন। এ ছাড়াও করোনাভাইরাসের মিউটেশন হচ্ছে নিয়মিত।

তিনি আরো বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার সাম্প্রতিক মিউটেশনও ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এসব রূপান্তরিত করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন দেশে। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও যুক্তরাজ্যের মিউটেটেড ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এসব কারণেই আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ কমলেও স্বস্তির কোনো অবকাশ নেই। বরং সতর্ক হতে হবে এবং ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে পরবর্তী ওয়েভ মোকাবেলা করার জন্য।
গতকাল সারা দেশে করোনায় আরো ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে পুরুষ ১৭ ও নারী আটজন। সবাই হাসপাতালে মারা গেছেন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল সাত হাজার ৭৮১ জনে। গতকাল ১৮১টি ল্যাবরেটরিতে ১২ হাজার ৯৭৯টি নমুনা সংগ্রহ ও ১২ হাজার ৯২০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ নিয়ে মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়াল ৩৩ লাখ ৫৭ হাজার ৩১৯টি। গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত হন আরো এক হাজার ৭১ জন। দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচ লাখ ২২ হাজার ৪৫৩ জন।

এ দিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ও বাড়িতে উপসর্গবিহীন রোগীসহ সুস্থ হয়েছেন ৭৩৭ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন চার লাখ ৬৬ হাজার ৮০১ জন।

ভ্যাকসিন কূটনীতি : গত বছর আগস্টে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন ঢাকার সাথে শীতল হতে থাকা সম্পর্কে গতি আনার জন্য ঘোষণা করেছিলেন যে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেয়া হবে। ঢাকায় সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন, ‘এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে যখন ভ্যাকসিন উৎপাদিত হবে তখন প্রতিবেশী, বন্ধু-দেশ এবং অন্যরাও এর অংশীদার হবে।’

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি জানায়, শ্রিংলার ঢাকা সফরের আরেকটা উদ্দেশ্যও ছিল। সেটা হলো চীনের প্রভাব বলয় থেকে বাংলাদেশকে বাইরে রাখা। এ ধরনের প্রতিশ্রুতি ভারত শুধু বাংলাদেশকেই দেয়নি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশ হিসেব প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানকেও ভারত অগ্রাধিকার দেবে বলে ঘোষণা করেছে। এরই মধ্যে গত মাসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে দিল্লিতে দায়িত্বরত ৬৪ জন বিদেশী কূটনীতিক হায়দরাবাদে দু’টি ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী কোম্পানি-বায়োলজিক্যাল-ই এবং ভারত বায়োটেক ঘুরে এসেছেন। তবে দ্য প্রিন্ট নামে দিল্লিভিত্তিক খবরের ওয়েবসাইট সরকারি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, প্রতিবেশীদের কাছে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সরবরাহের কাজে ভারত ‘তাড়াহুড়ো’ করবে না।

হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন (এইচসিকিউ) উৎপাদন এবং সরবরাহের সময় ভারত যেমন সাবধানী ছিল, করোনার টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রেও সেই ‘এইচসিকিউ মডেল’ ব্যবহার করা হবে বলে ওয়েবসাইটটি জানিয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/554989