১০ জানুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১:০৪

২০২০ সাল বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ছিল ভয়ংকর অভিজ্ঞতা

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : ভাগ্যের অন্বেষণে গ্রাম থেকে শহরমুখী হয় মানুষ। কিন্তু মহামারি করোনা সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। একসময় গ্রাম থেকে একটু ভালো করে বাঁচার আশায় যারা শহরে এসেছিল, তারা আবার হয়েছে গ্রামমুখী। করোনা পরিস্থিতিতে রাজধানীতে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে। নেমে গেছে দরিদ্রের কাতারে। অবস্থার চাপে অনেকেই বাসা ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দিয়েছে রাজধানীও। বিদায়ী বছরের আগস্টে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে করোনাকালে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে অন্তত ১৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। যারা রাজধানী ছেড়েছেন তাদের অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের পরিবার। যাদের বেতন করোনায় অর্ধেক করে দিয়েছে মালিক পক্ষ। করোনা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় পরিবারের ব্যয় মেটাতে না পেরে রাজধানী ছেড়েছেন তারা। ফলে ২০২০ সাল ছিল বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।

ভাড়াটিয়া পরিষদের নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, ২০২০ সালে করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে তিন মাসের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে দেড় লাখের বেশি পরিবার গ্রামে চলে গেছে। চাকরি হারিয়ে কিংবা অন্য কোনো পেশার লোকজনের আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই অনেকে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকে আবার ঢাকা ছেড়েছেন সন্তানদের স্কুল বন্ধের কারণে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ঢাকায় ফিরবেন তারা।

বিদায়ী বছরে বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বি আইজিডি) এর গবেষণার তথ্য বলছে, করোনাকালে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে অন্তত ১৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা খরচ, যোগাযোগের ব্যয় এবং অন্য নানামুখী ব্যয় মেটাতে না পেরেই এসব মানুষ ঢাকা ছেড়েছে। সভায় ‘লাইভলিহুড, কোপিং অ্যান্ড রিকভারি ডিউরিং কোভিড-১৯’ শীর্ষক জরিপভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদন বিদায়ী বছরের আগস্টে তুলে ধরা হয়। জরিপে দেখা গেছে, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে এপ্রিল মাসে ৬ শতাংশ শহুরে দরিদ্র মানুষ শহর থেকে গ্রামে চলে যায়। জুনে এসে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। জুন মাসে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসে শহুরে দরিদ্র মানুষের আয় কমে গেছে ৪৩ শতাংশ, গ্রামের মানুষের আয় ৪১ শতাংশ আর পার্বত্য চট্টগ্রামের দরিদ্র মানুষের আয় কমেছে ২৫ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে ১৭ শতাংশ জুনে এসে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির প্রভাবে শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ। আর গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় ৭৯ শতাংশ কমেছে।

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতেন হাফিজুর রহমান। বেতন পেতেন ৩০ হাজার টাকা। করোনা শুরুর পর থেকে তিনি আর পূর্ণ বেতন পাননি। এপ্রিলে, মে, জুনে পেয়েছিলেন অর্ধেক বেতন। পরবর্তিতে অর্ধেক পেলেও তা হয়ে যায় অনিয়মিত। ঈদের সময় স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়াতে রেখে এসেছিলেন। ১২ হাজার টাকা বাড়িভাড়া দিতে হতো তার। বেতন অনিয়মিত হওয়ায় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। হাফিজুর রাজধানীতে টিকতে না পেরে গ্রামে চলে গেছেন। শুধু তিনি নন, রাজধানীর অনেক বেসরকারি চাকরিজীবীর একই অবস্থা। চরম সংকটে পড়েছেন তাঁরা। বাড়িভাড়া দিতে না পেরে অনেকেই তাঁদের পরিবার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই কম টাকার বাসায় উঠছেন। আবার কেউ কেউ একেবারেই গ্রামে ফিরে গেছেন।

করোনা সংক্রমণের শুরুতে ৬৬ দিন ছিল সাধারণ ছুটি। এ সময়ে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিস ও বেশির ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্যই বন্ধ ছিল। ফলে নিয়মিত বেতন-ভাতা পাননি বেসরকারি চাকরিজীবীরা। আর করোনার পুরো বছর ধরেই বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কষ্টে ছিলেন বেসরকারি শিক্ষকরা। অনেকাংশেই আয় কমেছে শ্রমজীবীদের। আগের মতো কাজ নেই। এ ছাড়া অনেক দোকান ও মার্কেট বন্ধ থাকায় কর্মচারীরাও বেতন পাচ্ছেন না। তবে ভালো ছিলেন সরকারি চাকরিজীবীরা। অফিসে যেতে না হলেও নিয়মিত বেতন-ভাতা পেয়েছেন তাঁরা। এমনকি তাঁরা করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন।

বিদায়ী বছরে করোনা পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে, নেমে গেছে দরিদ্রের কাতারে। অবস্থার চাপে অনেকেই বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বলেন, করোনার সময়ে শুধু রাজধানী থেকে এক লাখের বেশি পরিবার চলে গেছে। যারা আছে তারাও কম টাকায় থাকার পথ খুঁজছেন।

বেসরকারি চাকরিজীবীরা শঙ্কায় দিন কাটালেও সরকারি চাকুরেদের জন্য গ্রেডভেদে প্রণোদনা আছে ৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা। আগামী অর্থবছরের (২০২০-২১) বাজেটে তাঁদের জন্য বাড়তি বরাদ্দ থাকছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। করোনার কারণে ১ম-৯ম গ্রেডের কোনো কর্মকর্তা মারা গেলে পেনশন সুবিধার বাইরেই তাঁর পরিবার অন্তত ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা পাবে।

দেশে সরকারি চিকিৎসকরা নানা ধরনের সুবিধা পেলেও সম্মুখভাগে কাজ করেও বঞ্চিত হয়েছেন বেসরকারি চিকিৎসকরা। তাঁদের অনেকেই করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকলেও কোনো প্রণোদনা ছিল না। এমনকি অনেক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক ছাঁটাই, বেতন কমানোসহ নানা ঘটনা ঘটছে। করোনার কারণে গত বছর বন্ধ ছিল দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই অবস্থায় সংকটে রয়েছেন ১০ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী। প্রায় সাত হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী নন-এমপিও। এ ছাড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার ২৫ হাজার শিক্ষকও তেমন বেতন-ভাতা পান না। একই অবস্থা বেসরকারি কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষকদের। দেশের প্রায় ৫০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ছয় লাখ শিক্ষক কর্মরত। অনেক স্কুলের বেতন, নানা ধরনের বিল বাকি পড়ায় তারা আর এসব স্কুল ধরে রাখতে পারেনি। বাধ্য হয়ে এ সব প্রতিষ্ঠানের কর্মরতরা রাজধানী ছেড়েছেন।

করোনা চলাকালীন সময়ে রাজধানী ছেড়ে বাড়ি ফেরাদের অবস্থা ছিল আরও ভয়ংকর। মাছের খালি ড্রামে বাড়ির উদ্দেশে রওনার একটি ছবি ভাইরাল হয় ফেইসবুকে। করোনাভাইরাসের কারণে দেশজুড়ে গণপরিবহন বন্ধ থাকার বাধা উপেক্ষা করে বাড়িতে আবার কর্মস্থলের দিকে ছুটতে থাকে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে ফেরি চলাচল শুরু হলে গার্মেন্ট শ্রমিকদের এ দুর্গতির দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টুয়েন্টিফোর। কোনো প্রণোদনাতেই তৈরি পোশাক খাতের কর্মী ছাঁটাই থামেনি। বিভিন্ন কৌশলে ছাঁটাই করা হয়। শ্রমিকদের জীবনের শঙ্কা, চাকরির শঙ্কা এবং চাকরিতে টিকে থাকলেও মজুরি পাওয়ার শঙ্কায় কেটেছে বিদায়ী বছর। কর্মচ্যুতির ঘটনায় সামাজিক অস্থিরতা ছিল এবং শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভও দানা বাঁধে। শ্রমিক বিক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়। করোনার ভীতিকর এই পরিস্থিতিতে কর্মহীন শ্রমিকরা কেউ অন্য কোনো কাজ পাননি।

সে সময় তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক বলেছিলেন, সারা বিশ্ব কভিড-১৯ মহামারিতে টালমাটাল, জনজীবন বিপর্যস্ত, ঠিক এমন এক অভূতপূর্ব সংকটের মধ্যে সরকার দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাতকে সংকট মোকাবেলায় সম্ভাব্য সব ধরনের সুযোগ দিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৈরি পোশাক খাত আবারও ঘুরে দাঁড়াবে।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) সূত্র জানায়, করোনার শুরুতে প্রায় ১৮ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হওয়ার খবর তাদের কাছে আসে। অবশ্য শ্রমিক সংগঠনগুলোর হিসাবে এই সংখ্যা অনেক বেশি। ছাঁটাইয়ের এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিল্প পুলিশের এক নিজস্ব প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বিদায় বছরে বছরের পরবর্তী ছয় মাস অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় এক হাজারের বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ১০ লাখের বেশি শ্রমিক চাকরি হারাবেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বর মাসে করা এক জরিপের দেখা গেছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশে পরিবার প্রতি গড়ে ৪ হাজার টাকা করে আয় কমে গেছে। মহামারির এই সময়ে আয় কমে যাওয়ায় খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমে গেছে ৫২ শতাংশের মত পরিবারের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ৬ই অক্টোবর যে জরিপের ফল প্রকাশ করেছে তাতে করোনাভাইরাস বাংলাদেশে মানুষের আয়ের উপর কী ধরনের আঘাত হেনেছে তার একটি উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে উঠে। তাতে মহামারির কারণে ৬৮ শতাংশ মানুষ কোনও না কোনোভাবে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরীপে অংশগ্রহণকারীরা যা বলেছেন তাতে দেখা যায়, মার্চ মাসে পরিবার প্রতি যে গড় আয় ছিল, আগস্ট মাস পর্যন্ত তা ২০ শতাংশ কম ছিল।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলছেন আয় কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে তার ব্যয়ও কমে যাওয়া। যার প্রভাব চক্রাকারে পড়বে সার্বিকভাবে অর্থনীতি ও দেশের প্রবৃদ্ধির উপর। কেননা মানুষের আয় কমে যায় তাহলে বাজারে গিয়ে সে ব্যয় করতে পারবে না। তার যে দৈনন্দিন চাহিদা সেটা পূরণ হবে না। সে যদি উৎপাদন কমিয়ে দেয় তাহলে যতগুলি লোক তার অধীনে চাকরি করে তত লোক তার লাগবে না। তখন কিছু লোক কর্মসংস্থান হারাবে। এইভাবে একটা চেইনের মতো কাজ করে আয় কমে যাওয়ার বিষয়টা। পরবর্তীতে সেটা জিডিপি প্রবৃদ্ধির উপরে আঘাত করবে।

https://dailysangram.com/post/440123