১০ জানুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১:০১

অনেক রহস্য আর বিতর্কের জালে আটকে পড়ে আছে এক এগারোর মূল উৎস

আসিফ আরসালান : প্রত্যেক জাতির জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যেসব ঘটনা সেই জাতি বা সেই রাষ্ট্রের জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটায়। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহের সমস্যা হলো এই যে সেই ঘটনার নেপথ্যে যেসব নায়ক থাকে, এমনকি বিদেশীদেরও যদি কোনো হাত থাকে, তাহলে নির্মোহভাবে সেইসব নায়কদের চিহ্নিত করা হয় না এবং আনুপূর্বিক ঘটনা প্রবাহ বস্তুনিষ্ঠভাবে বর্ণনা করা হয় না। আর তার ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণও এমনভাবে করা হয় যা দল বিশেষের বা মহল বিশেষের পক্ষে যায় অথবা দল বিশেষ বা মহল বিশেষের বিপক্ষে যায়। আবার কোনো কোনো সময় এমন সব ব্যক্তিকে দিয়ে ইতিহাস লেখা হয় যারা, বাহ্যিকভাবে নিরপেক্ষ মনে হলেও, ইতিহাসকে এমন জায়গায় এনে শেষ করেন যে পাঠক সমাজ দল বা মহল বিশেষের পক্ষে এবং দল বা মহল বিশেষের বিপক্ষে চলে যান। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি, যা সাধারণ্যে এক এগারো নামে সমধিক পরিচিত, তেমনই একটি ঘটনা। তেমনি একটি বই হলো ‘এক এগারো (বাংলাদেশ ২০০৭-২০০৮)’। একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকার প্রকাশনী সংস্থা থেকে বইটি প্রকাশ করা হয়েছে বলে বইটি বহুল প্রচার পেয়েছে। কিন্তু বইটি নির্মোহ নয়। এক এগারোর প্রধান নায়ক জেনারেল মঈনের সাথে দেখা করার জন্য আলোচ্য গ্রন্থের লেখক সুদূর আমেরিকা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি একটি প্রথম শ্রেণির হোটেলে বেশ কয়েকদিন ছিলেন। একটি বই লেখার জন্য এত বিরাট প্রস্তুতির পেছনে যারা অর্থায়ন করেন তারা নিরপেক্ষ বর্ণনার জন্য করেন না।

যাই হোক, উক্ত গ্রন্থ ছাড়াও জেনারেল মঈন নিজেই একটি স্মৃতিচারণমূলক বই লিখেছেন। নাম ‘শান্তির স্বপ্নে-সময়ের স্মৃতিচারণ’। ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি বিবিসি বাংলা সার্ভিসে কাদির কল্লোল একটি রিপোর্ট সম্প্রচার করেন। এগুলো ছাড়াও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজ উদ্দিনের প্রেস উপদেষ্টা মুখলেছুর রহমান একটি সাক্ষাৎকার দেন। এই সাক্ষাৎকারে অনেক চাঞ্চল্যকর অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ পায়। কিন্তু এই সাক্ষাৎকারটি, বলতে গেলে, বাংলাদেশে কোনো প্রচারই পায়নি। প্রচার পেলে প্রথমে বর্ণিত এক এগারো- ২০০৭-২০০৮, মঈনের গ্রন্থ, কাদির কল্লোলের রিপোর্ট এবং মুখলেছুর রহমানের সাক্ষাৎকার - সবগুলি মিলিয়ে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা যেত।

এক এগারোর কূশীলব বলতে যাদের নাম শোনা যায় তাদের মধ্যে জেনারেল মঈনুদ্দিন ছাড়াও ছিলেন নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ডিজিএফআইয়ের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার ফজলুল বারী ও মেজর জেনারেল আমিন উদ্দিন। দুই ব্যক্তিকে এই চক্র থেকে বাদ দেওয়া যায়। এরা হলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াজ উদ্দিন এবং জরুরি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর ফখরুদ্দিন আহমদ। অনুঘটকের ভূমিকায় আরেক জন ছিলেন। তিনি হলেন ডক্টর ইফতেখারুদ্দিন চৌধুরী। ইয়াজ উদ্দিনকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে অপসারণই করা হয়েছিল। আর ডক্টর ফখরুদ্দিনকে জেনারেল মঈন মধ্যরাতে টেলিফোন করে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন এবং প্রধান উপদেষ্টার পদ অফার করেন।

॥ দুই ॥
সেজন্যই বলেছিলাম যে ইয়াজ উদ্দিন এবং ফখরুদ্দিনকে এই চক্র থেকে বাদ দেওয়া যায়। এছাড়া প্রেসিডেন্ট ইয়াজ উদ্দিন আহমদ ২০১২ সালে মারা গেছেন। ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার পদ ছাড়ার পর ঐ যে দেশ ছেড়ে আমেরিকা গেছেন, আজ পর্যন্ত আর ফেরেননি। ব্রিগেডিয়ার ফজলুল বারী আমেরিকা আছেন বলে জানা যায়। জেনারেল আমিন মধ্যপ্রাচ্যের কোনো একটি দেশে, সম্ভবত দুবাইয়ে, অধ্যাপনা করছেন বলে শোনা যায়। ড. ইফতেখারুদ্দিন চৌধুরীও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি দেশে আছেন। সুতরাং ওয়ান ইলেভেনের প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য এদের কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে একজন আছেন। তিনি লে: জেনারেল (অব) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। তিনি ২০০৮ সালে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসাবে অষ্ট্রেলিয়া গমন করেন। তারপর একাধিকবার বর্তমান সরকারের আমলে এক্সটেনশন পেয়ে এক টানা ৬ বছর অর্থাৎ, ২০১৪ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় হাইকমিশনার ছিলেন। ২০১৮ সালের মধ্যরাতের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন। ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবদের মধ্যে একমাত্র তিনিই দেশে আছেন। একমাত্র তাঁর কাছ থেকেই প্রকৃত ঘটনা জানা যেতে পারে। কারণ ঐ সময় তিনি নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। এছাড়া তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াজ উদ্দিনকে দিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য যে সব সামরিক অফিসার বঙ্গভবনে যান তাদের মধ্যে সেনা প্রধান জেনারেল মঈন আহমেদের সঙ্গে জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীও ছিলেন।

এই কলামটি লেখার মাঝ পর্যায়ে যখন এসেছি তখন নিউজ পোর্টাল ‘আমাদের সময় ডট কমের’ একটি খবরের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। ৬ জানুয়ারি প্রকাশিত ঐ খবরের শিরোনাম, “ওয়ান ইলেভেনের সময় শেখ হাসিনার পাশে থাকার কথাও আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন প্রণব মূখার্জী।” খবরে বলা হয়, “ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত প্রণব মুখোপধ্যায়ের আত্মজীবনীমূলক বই, ‘মাই কোয়ালিশন ইয়ার্স’ এর চতুর্থ পর্ব এমাসে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।” এই বইয়ের ‘দি কোয়ালিশন ইয়ার্স’ নামে একটি অধ্যায়ে তিনি একথা লিখেছেন।

তিনি লিখেছেন, “২০০৭ সালে যখন বাংলাদেশে সেনা বাহিনীর সমর্থনে একটি তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকার গঠিত হয়, তখন তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৮ সালে সেনা প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ ভারত সফরে যান। তখন প্রণব মূখার্জীর সাথে একটি বৈঠক হয়েছিল মঈন ইউ আহমেদের। ঐ ঠৈকে বাংলাদেশের সেনা প্রধান তার কাছে চাকরির নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন। তখন প্রণব মূখার্জী কারাগারে বন্দী আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার জন্য মঈন ইউ আহমেদকে বলেছিলেন। প্রণব মূখার্জী জানান, মঈন ইউ আহমেদের আশঙ্কা ছিল, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। তখন মঈন ইউ আহমেদকে প্রণব মূখার্জী বলেছিলেন যে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তার চাকরির কোনো সমস্যা হবে না।”

প্রণব মূখার্জী তার বই কোয়ালিশন ইয়ার্সে লিখেছেন, তার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশে ২০০৮ সালে কারাগারে বন্দী সব রাজনীতিবিদদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এবং বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল।” এই পুস্তকে প্রণব আরো লিখেছেন যে শেখ হাসিনা ছিলেন তাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। এক এগারোর সময় যেসব আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন না, তাদেরও সমালোচনা করেন প্রণব মূখার্জী।

॥ তিন ॥
এক এগারো কেন এসেছিল, কারা এনেছিল সেটা যথার্থভাবে অনুধাবনের জন্য কোয়ালিশন ইয়ার্সে বিধৃত প্রণব মূখার্জীর বয়ান অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক। মঈন ইউ আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান। ডক্টর ফখরুদ্দিন ছিলেন তত্ত্বাবধায়কের প্রধান উপদেষ্টা। অর্থাৎ সরকার প্রধান। তাহলে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আটক হাসিনা খালেদা ও অন্যান্য বন্দীর মুক্তির জন্য বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে বলেন কেন? তাহলে প্রকৃত রাষ্ট্র ক্ষমতা কার হাতে ছিল? এখানে এটি স্পষ্ট যে প্রকৃত রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিল সেনাবাহিনী তথা তার প্রধান জেনারেল মঈনের হাতে।

কিন্তু প্রকৃতই কি তাই? প্রবাদ বাক্যের মত একটি কথা আছে। আর সেটি হলো, ‘সেরের ওপর সোয়া সের’। অর্থাৎ এক সেরের ওপর সোয়া সের। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান তার তাঁর চাকরির নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মূখার্জীর কাছে। তাহলে তার চাকরির নিরাপত্তা ছিল কি ভারতের হাতে? ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে জেনারেল মঈনের চাকরির কোনো সমস্যা হবে না। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিচ্ছেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে চাকরির নিশ্চয়তা। তাহলে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে প্রকৃত রাষ্ট ক্ষমতা কার হাতে ছিল? খালেদা হাসিনাসহ রাজনীতিবিদদের মুক্তি চেয়েছিলেন প্রণব মূখার্জী। এবং রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং এক এগারোর শেকড়ে যেতে কি খুব অসুবিধা হয়?

ওয়ান ইলেভেনে কিভাবে কি ঘটেছিল সে সম্পর্কে ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি বিবিসির বাংলা বিভাগ থেকে একটি রিপোর্ট সম্প্রচারিত হয়। ঐ রিপোর্টে জেনারেল মঈনের পুস্তকের একটি অংশের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। ঐ উদ্ধৃতিতে জেনারেল মঈন বলেছেন, “এক সময় ক্ষমতাধর কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি আমার সাথে দেখা করে জানালো, সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে সেনাবাহিনী নির্বাচনে সহায়তা করলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করার জন্য তারা জাতিসংঘকে অনুরোধ জানাবে। প্রচ্ছন্ন এ হুমকির পরিণতি অনুধাবন করতে আমার অসুবিধা হলো না।” এই সময় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় একটি কথা চাউর হয়ে গিয়েছিল। তখন ড. ইফতেখারুদ্দিন চৌধুরী নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি নাকি এই মর্মে একটি পত্র এনেছিলেন যে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াজ উদ্দিন যদি ২২ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানে অটল থাকেন তাহলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করা হবে। জেনারেল মঈনের পুস্তকে এ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে এবং ড. ইফতেখার চৌধুরী কথিত পত্র নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তীব্র বিতর্ক রয়েছে। অনেকে এই ঘটনা বা বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করেন।

প্রশ্ন ওঠে, ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনে সব দল অংশ গ্রহণ না করলে জাতিসংঘ ব্যবস্থা নেবে বলে যদি হুমকি দিয়ে থাকে তাহলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াত সহ ৩২ টি দল নির্বাচন বর্জন করলেও তখন জাতিসংঘ বা পশ্চিমা দুনিয়া আওয়ামী সরকারের এক তরফা নির্বাচন ঠেকাবার কোনো চেষ্টা করেনি কেন? ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয়পার্টিসহ সব দল অংশগ্রহণে সম্মত ছিল। ৩রা জানুয়ারি হঠাৎ তারা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত দিল কেন? সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই ঐ দিনই ৩০০ টি আসন থেকেই তারা মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করলো কেন? আর তার ৮ দিন পর ইয়াজ উদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া এবং জরুরি অবস্থা জারী করতে সেনাপ্রধান বাধ্য করলেন কেন? এসব “ কেন’র” উত্তর ইতিহাসের গর্ভে নিহিত আছে। কবে সেই উত্তর বেরিয়ে আসবে সেটি সময় বলে দেবে।

asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/440114