২৪ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৪৬

ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে!

তদন্তের পর তদন্ত, শাস্তি হয়নি কারও

মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি, এরপর অধিকতর তদন্ত কমিটি। এর বাইরে সংসদীয় কমিটির তদন্ত। আর থানায় মামলা। এত কিছুর পরও সোনায় খাদ কে মেশাল, সেটা নির্দিষ্ট করে আর চিহ্নিত করা গেল না তিন বছরেও। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে দেওয়া ক্রেস্টে সোনা জালিয়াতির ঘটনায় কাউকে সাজার মুখ দেখতে হলো না।
‘ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে!’ শিরোনামে ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল প্রথম আলোয় খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে চলছে তদন্তের পর তদন্ত।
ক্রেস্টে সোনা জালিয়াতির জন্য প্রথম তদন্ত কমিটি সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীসহ ১৩ জন কর্মকর্তা এবং দুটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে প্রতিবেদন দেয়। তবে বিভাগীয় কমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তাকে দিয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অভিযোগের তদন্ত করানো নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
এই আপত্তির সূত্র ধরে অধিকতর তদন্তের জন্য অর্থসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল-মামুনকে প্রধান করে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু এই কমিটি দুই বছর তদন্ত করার পর বলা হলো, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যেহেতু একই বিষয়ে তদন্ত করে আগে প্রতিবেদন দিয়ে দিয়েছে, ফলে সেটাই চূড়ান্ত। মন্ত্রণালয়ের কমিটির প্রতিবেদন আর দরকার নেই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এতগুলো কমিটি করার অর্থ হচ্ছে বিচারের প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করা। এতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাওয়ার মতো ফাঁকফোকর তৈরি হতে পারে।
স্বার্থের সংঘাত
এদিকে কাহিনিতে নতুন মোড় হিসেবে সংসদীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন নিয়েও দেখা দিয়েছে আরেক জটিলতা। প্রশ্ন উঠেছে স্বার্থের সংঘাতের (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট)। যে সংসদীয় কমিটি এই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে, সেই কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলাম, যিনি ছিলেন এই কেলেঙ্কারির সময়কার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রণালয়ের প্রথম দফার তদন্ত প্রতিবেদনে তাঁকে দায়ী করা হয়েছিল। এবার তাঁরই অধীন উপকমিটি তদন্ত করে তাঁর হাতেই প্রতিবেদন তুলে দিয়েছে, যাতে দায়ী ব্যক্তিদের তালিকায় তাঁকে আর রাখা হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই কেলেঙ্কারিতে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, তৎকালীন সচিব মিজানুর রহমানসহ অন্য কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে সংসদীয় কমিটির প্রধানই অভিযুক্ত ব্যক্তি, সেখানে সংসদীয় তদন্ত কমিটি তাঁকে কতটা দায়ী করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদীয় কমিটির তদন্তসংক্রান্ত উপকমিটির প্রধান আফছারুল আমীন বলেন, ‘তদন্তে যা এসেছে, আমরা তা-ই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি।’
অধিকতর তদন্ত থামিয়ে দেওয়া হলো যে যুক্তিতে
সংসদীয় কমিটির একজন সদস্য বলেন, মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মে অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ উঠলে সেটা তদন্ত করার এখতিয়ার সংসদীয় কমিটিকে দেওয়া আছে জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে। যেহেতু সংসদ সদস্যরা জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত, তাই তাঁদের দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ওপর প্রাধান্য পাবে। এর জন্য অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
অধিকতর তদন্তের জন্য গঠিত কমিটির প্রধান ও অর্থসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল-মামুন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিবেদনটি গ্রহণ করা হয়নি। ফলে তা অকার্যকর হয়ে গেছে। বিষয়টি তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের আধা সরকারি পত্র দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন।
জানতে চাইলে হেদায়েতুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ঢাকার তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার জিল্লার রহমানকে প্রধান করে দেওয়া প্রথম তদন্ত আর তাঁদের তদন্তের মধ্যে তেমন ফারাক নেই। তবে প্রশাসনের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত সচিবের ওপরই এসব ঘটনার দায় বর্তায়।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব নিয়ে নথিপত্র জব্দ করেছে। দুদকের উপপরিচালক শেখ আবদুস ছালামকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল বলেন, অনুসন্ধান এখনো চলছে। মামলা করার ব্যাপারে আইনের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।
সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দায়
আলোচিত এই ক্রেস্ট জালিয়াতির ঘটনায় সরবরাহকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত ক্রেস্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এমিকনের মালিক মীর দাউদ আহমেদ ওরফে নাজিম এবং শান্তিনগরের মেসার্স মহসিনুল হাসানের স্বত্বাধিকারী মো. মোহসিনুল হাসান। সেই মামলারও তেমন অগ্রগতি নেই।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা করার পর এ বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ কিছু জানতে চায়নি। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গঠন করা অধিকতর তদন্ত কমিটির কোনো প্রতিবেদনও পাইনি। তাই পুরো বিষয়টি থমকে আছে।’

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1118338/