৭ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৮

ভিকারুননিসার খ্যাতি নষ্ট

দুর্নীতি-অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ

রাজধানীতে মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। প্রতিষ্ঠানটির এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতি-অনিয়ম প্রবেশ করেনি। ফলে দিন দিন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। সম্প্রতি নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষকে সরিয়ে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত আংশিক এমপিওভুক্ত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল ক্যাম্পাস সিদ্ধেশ্বরী এলাকার বেইলি রোডে। এ ছাড়া ধানমণ্ডি, আজিমপুর, বসুন্ধরাসহ তাদের মোট চারটি শাখা রয়েছে। সব শাখা মিলিয়ে শিক্ষার্থী আছে প্রায় ২৭ হাজার। আর শিক্ষক-কর্মচারী আছেন প্রায় ৮৫০ জন।

কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা যায়, গত দুই বছরে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণিতে ৭৫০ জন শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে ভর্তি করা হয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ভর্তির জন্য নেওয়া হয় চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। চলতি শিক্ষাবর্ষেও অবৈধ ভর্তির পাঁয়তারা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষক, কর্মচারী ও শাখাপ্রধান নিয়োগে দুর্নীতি চলছে। সবচেয়ে বেশি টাকা লেনদেন হয় শাখাপ্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে। টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীরা শিফট বা শাখা পরিবর্তন করতে পারে।

প্রায় এক যুগ ধরে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে কোনো স্থায়ী অধ্যক্ষ নেই। প্রায় দুই বছর আগে স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ৪০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে সেই প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। দেড় বছর আগে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা অধ্যাপক ফওজিয়াকে অধ্যক্ষ হিসেবে প্রেষণে পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর প্রতিষ্ঠানটির ১২ সদস্যের গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি মাঝেমধ্যে অনিয়ম প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও সফল হননি। অধ্যক্ষ গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে দুর্নীতির মহোৎসবে মেতে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত গত ২৯ ডিসেম্বর অধ্যাপক ফওজিয়াকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে শিক্ষা ক্যাডারের অন্য কর্মকর্তা কামরুন নাহারকে অধ্যক্ষের নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের আদেশের পরও দায়িত্ব হস্তান্তরে গড়িমসি করছিলেন অধ্যাপক ফওজিয়া। গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্যও চলতি শিক্ষাবর্ষের ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে দায়িত্বে রাখতে চেষ্টা চালান। কিন্তু গত রবিবার গভর্নিং বডির সভাপতির হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব হস্তান্তরে বাধ্য হন অধ্যাপক ফওজিয়া।

অবশ্য অনিয়মের ব্যাপারে জানতে সদ্যঃসাবেক অধ্যক্ষ ফওজিয়াকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি।

গভর্নিং বডির সদস্য ওহেদুজজামান মন্টু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর ভিকারুননিসা নূন স্কুলে কোনো অনিয়ম হয়নি।’ তাহলে অধ্যক্ষকে কেন সরানো হলো—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কোনো কথা বলব না।’

নতুন অধ্যক্ষ কামরুন নাহার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি সবেমাত্র দায়িত্ব নিয়েছি। প্রতিষ্ঠান পরিচালনাসংক্রান্ত যে আইন ও বিধি-বিধান রয়েছে সে অনুসারেই আমি চলব। চলতি শিক্ষাবর্ষের ভর্তিসংক্রান্ত সব বিষয় গভর্নিং বডির সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আগের কোনো সমস্যা থাকলে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব আমার নয়।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ব্যাপারগুলো আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। যদি আমাদের কাছে কোনো অনিয়মের অভিযোগ আসে, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শুধু ভিকারুননিসা নূন স্কুলই নয়, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে চাই।’

অবৈধ ভর্তি : ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ২০১৯ শিক্ষাবর্ষে অবৈধভাবে ৪৪৩ জন ছাত্রী ভর্তি করা হয়, যা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, পূর্বঘোষণা ছাড়া কোনো আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না। অথচ ২০১৯ শিক্ষাবর্ষে এক শাখায় শূন্য আসন দেখিয়ে অন্য শাখায় ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে এমন কয়েকজন রয়েছে যারা আবেদনও করেনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাউশি অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে অবৈধ ভর্তির সঙ্গে জড়িত পাঁচজন শিক্ষকের নাম এসেছে। শাস্তি হিসেবে ২০১৯ সালের আগস্টে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের এমপিও বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলেও আদালতের আদেশে তা স্থগিত রয়েছে। এই অবৈধ ভর্তিতে সে সময়ের গভর্নিং বডির সদস্যরা মূল ভূমিকা পালন করলেও তাঁদের কোনো শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। শাস্তি হয়নি কোনো শিক্ষকের।

অবৈধভাবে ভর্তি করা ৪৪৩ জনের মধ্যে ৩৬৮ জনের তথ্য জানা গেছে। প্রথম শ্রেণিতে ১৬৫ জন, দ্বিতীয়তে ৫৬, তৃতীয়তে ৯৫, চতুর্থতে ৩৯, পঞ্চমে ৩১, ষষ্ঠে ১১, সপ্তমে ২৬, অষ্টমে দুজন এবং নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে সাতজনকে ভর্তি করা হয়।

এরপর ২০২০ শিক্ষাবর্ষে ৮৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৩৫০ শিক্ষার্থী অবৈধভাবে ভর্তি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও আদালতে রিট থাকায় ওই শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। পরে আদালত বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডকে নির্দেশ দেন। বোর্ডের অনুমতি পাওয়ায় করোনার মধ্যেই গত ২৪-২৯ অক্টোবর শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এমনকি গত সপ্তাহেও দুজন শিক্ষার্থী অবৈধভাবে ভর্তি করা হয়েছে, যার একজন বসুন্ধরা শাখার দ্বিতীয় শ্রেণিতে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, অবৈধ ভর্তিতে শিক্ষার্থীপ্রতি নেওয়া হয় চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। সাধারণত প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে গভর্নিং বডির সদস্যদের প্রত্যেককে ১০ জন করে শিক্ষার্থী অবৈধভাবে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। এ অনিয়মের কারণে প্রতি শিফটে সর্বোচ্চ ৬০ জন শিক্ষার্থী থাকার কথা থাকলেও এখন ৯০ থেকে ৯৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এমনকি ইংলিশ ভার্সনে ১১০ থেকে ১১৫ জন পর্যন্ত শিক্ষার্থী রয়েছে।

২০২১ শিক্ষাবর্ষে গত ২৫ ডিসেম্বর ভর্তির আবেদন শেষ হয়েছে। ভর্তির জন্য লটারি হবে আগামী ১০, ১১ ও ১২ জানুয়ারি।

এবার অবৈধ ভর্তির নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে শূন্য আসনের সংখ্যা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়নি। জানা গেছে, সিদ্ধেশ্বরী এলাকার একাধিক কোচিং সেন্টার থেকে অবৈধ ভর্তির জন্য টাকা সংগ্রহ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে অধ্যক্ষকে সরিয়ে দেওয়ায় একজন অভিভাবকের কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া দুই লাখ টাকা ফেরত দিয়েছেন একজন শিক্ষক। এবার মোট ভর্তির ১০ শতাংশ গভর্নিং বডির সদস্যদের জন্য ‘বরাদ্দ’ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

শাখাপ্রধান নিয়োগে অনিয়ম : গত নভেম্বরে স্কুলের চার ক্যাম্পাসের ১১টি শাখার ছয়টিতে স্থায়ী শাখাপ্রধান নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মূল ক্যাম্পাসের সিনিয়র মর্নিং, ইংলিশ ভার্সন মর্নিং ও ইংলিশ ভার্সন ডে শাখায় একজন করে প্রার্থী আবেদন করেন। অভিযোগ রয়েছে, অন্য কোনো প্রার্থীকে আবেদন করতে দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে ইংলিশ ভার্সন মর্নিং শাখাপ্রধানের পদ আগামী জুনে শূন্য হবে, তার পরও সেখানে আবেদন করানো হয় সাবেক অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠজন ও শিক্ষক প্রতিনিধি ফাতেমা জোহরা হককে। এ ছাড়া বসুন্ধরা মর্নিং শাখার ভারপ্রাপ্ত শাখাপ্রধান সাবিনা করোনা আক্রান্ত হলেও ওই শাখায় পরীক্ষা নিয়ে শাহীন চৌধুরীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আজিমপুর শাখায় ছয় বছর ধরে দায়িত্বে থাকা শামসুন আরা সুলতানাকে সরিয়ে দিয়ে নন-এমপিও শিক্ষক শাহরিমা চৌধুরীকে শাখাপ্রধান নিয়োগ দেওয়া হয়। শামসুন আরা ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি লিখে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শাখাপ্রধান নিয়োগে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। যেসব ভারপ্রাপ্ত শাখাপ্রধান আর্থিক লেনদেনে রাজি হননি, তাঁদের সরিয়ে দিয়ে নতুন প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের আগেই প্রশ্ন দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

শামসুন আরা সুলতানা কালের কণ্ঠকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক শাখাপ্রধানের দায়িত্ব পাবেন, কিন্তু সে নিয়ম মানা হচ্ছে না। বর্তমানে ১১ জন শাখাপ্রধানের মধ্যে সাতজনই নন-এমপিও শিক্ষক। ২৬ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে এ শিক্ষক বলেন, এমন এক পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে, যা কোনো বিধি-বিধানের মধ্যেই পড়ে না।

শিক্ষার্থীদের শাখা বা শিফট পরিবর্তন : গত দুই বছরে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী শাখা বা শিফট পরিবর্তন করেছে বলে জানা যায়। বিশেষ করে ডে শিফট থেকে নিয়মিতই শিক্ষার্থীদের মর্নিং শিফটে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্য শাখা থেকে মূল ক্যাম্পাস বেইলি রোডে অহরহই শিক্ষার্থীদের আনা হচ্ছে। শাখা বা শিফট পরিবর্তনের জন্য শিক্ষার্থীপিছু এক লাখ টাকা লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।

প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল মজিদ সুজন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নীতিমালায় আছে, শিক্ষার্থীরা শাখা পরিবর্তন করতে পারবে না। অথচ নিয়মিতই এই কাজ হয়েছে। সেটা যে এমনি এমনি হয়নি তা সবারই জানা। সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়া এবং গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্য প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের অনিয়মে জড়িত ছিলেন। আমরা এ ব্যাপারে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগও জমা দিয়েছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চাই, প্রতিষ্ঠানটি তার হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করুক।’

শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম : গত ৭ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পরীক্ষা হয়। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের সময় শিক্ষক প্রতিনিধি ফাতেমা জোহরা হক দুজন প্রার্থীর নম্বর বাড়িয়ে দেন, যদিও চাপের মুখে পরে সেটা সংশোধন করেন। এ অভিযোগ পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের সভাপতি তাঁর প্রতিনিধি সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. মাজহারুল ইসলামকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়।

জানা যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে পাঁচ থেকে আট লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। আর শিক্ষক নিয়োগে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অবৈধ লেনদেন হয়।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/01/07/992879