৭ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৭

ট্রানজিটের নামে কুলিগিরি

ভারতের কলকাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বন্দর থেকে চার কন্টেইনার ট্রানজিট পণ্য নিয়ে ‘এমভি সেঁজুতি’ গত ২১ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। এসব পণ্য সড়কপথে পরিবহন করা হয় ত্রিপুরা ও আসামে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ট্রানজিটের প্রথম ট্রায়াল রান শুরু হয়। এর মধ্যদিয়ে ট্রানজিট সুবিধা লাভে ভারতের ইচ্ছা-অভিলাষ পূরণ হলো। অথচ বাংলাদেশের প্রাপ্য রাজস্ব, বন্দর-চার্জ, মাসুল, লেভি, ট্যাক্স মোদ্দা কথায় ‘লাভে’র খাতা শূন্য! চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনীত ভারতের ট্রানজিট পণ্যসামগ্রী চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে আখাউড়া দিয়ে পরিবহন করা হয় ত্রিপুরা-আসাম ও অন্যান্য স্থানে।

২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফরম ইন্ডিয়া’ চুক্তি এবং উক্ত চুক্তির আওতায় প্রণীত এসওপি অনুযায়ী ট্রানজিট পণ্যবাহী চারটি কন্টেইনারের প্রথম ট্রায়াল রান সম্পন্ন করা হয়।

গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলন শেষে ৩৯ দফা যৌথ ঘোষণা দেয়া হয়। এতে ২৩ নম্বর ঘোষণায় বলা হয়েছে- ‘দুই নেতা চলমান দ্বিপাক্ষিক সংযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নেন এবং পিআইডব্লিওটিটির অধীনে কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে আগরতলায় ভারতীয় পণ্যের পরীক্ষামূলক পরিবহন, সোনামুড়া-দাউদকান্দি প্রোটোকল রুট চালু এবং অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ও বাণিজ্য (পিআইডব্লিওটিটি) প্রোটোকলে দ্বিতীয় সংযোজন স্বাক্ষরসহ সা¤প্রতিক উদ্যোগগুলিকে স্বাগত জানান। দুই নেতা শিগগিরই চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য পরিবহন চালু করতে সম্মত হন’।

উক্ত শীর্ষ সম্মেলনের পরই বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সফরকালে চিটাগাং চেম্বারের ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নেতৃবৃন্দ এবং চট্টগ্রাম বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। এতে তিনি বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম। বন্দরের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে সহযোগিতায় আগ্রহ ব্যক্ত করেন তিনি। কলকাতা-চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সড়কপথে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট কার্গো চালানের কন্টেইনারগুলোর সুষ্ঠু পরিবহনের জন্য ভারতীয় হাই কমিশনার সন্তোষ প্রকাশ করেন।

কেন একতরফা কুলিগিরির সার্ভিস?
অন্যদিকে কথিত ‘ট্রানশিপমেন্ট’ কিংবা ‘কানেকটিভিটি’র নামে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর দিয়ে ভারতকে করিডোর বা ট্রানজিট সুবিধার বিনিময়ে বাংলাদেশের আয় তথা লাভের দিক মস্তবড় ফাঁকি- একথা বলছেন পোর্ট-শিপিং-পরিবহন বিশেষজ্ঞগণ। তাদের কথা একতরফা ট্রানজিটের নামে ভারতকে কেনইবা কুলিগিরির সার্ভিস দিতে হবে? একতরফা করিডোর কিংবা ট্রানজিটের মূল দিকটি হচ্ছে- ‘টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’। অর্থাৎ ভারতের মালামাল ভারতেই চলে যাবে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত হরেক ধরনের পণ্যসামগ্রী, সেবা ও আইটি খাতের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘দ্য সেভেন সিস্টার্স’ হিসেবে পরিচিত সাতটি রাজ্যে। যেমন- আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, অরুণাচল, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড এবং সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার উত্তর প্রদেশ, এমনকি তামিলনাডু-উড়িষ্যাসহ দেশটির অনেক অঞ্চলের সাধারণ মধ্যবিত্ত থেকে বিত্তবান জনগণের মাঝে রয়েছে বাংলাদেশের উৎকৃষ্ট বেশকিছু ভোগ্যপণ্য, শিল্পপণ্যের।
অথচ ট্যারিফ নন-ট্যারিফ (শুল্ক ও অশুল্ক) বাধা-প্রতিবন্ধকতার বেড়াজালে বাংলাদেশের পণ্য প্রতিবেশী দেশটিতে ঢোকার ক্ষেত্রে যেন অঘোষিত নিষেধাজ্ঞাই ‘নিয়মে’ পরিণত হয়েছে। আখাউড়া-আগরতলা সীমান্ত স্থলবন্দর কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভারতের মালামাল ট্রানজিট সুবিধায় পরিবহনের কারণে বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের পণ্য রফতানি সম্ভাবনার অবশিষ্টটুকু ভেস্তে যাচ্ছে। এরজন্য আখাউড়ার ব্যবসায়ী মহলও হতাশ। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের ক্যাপাসিটি ‘ঠাঁই নেই’ অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে। বছরের অধিকাংশ সময়েই কন্টেইনারসহ সাধারণ কার্গোজট ও অনেক সময় জাহাজের জট তৈরি হয়। দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানির স্রোত সামাল দিতেই হিমশিম অবস্থা।

সেখানে ভারতকে ট্রানজিট বা করিডোর সুবিধাদানের অর্থ দাঁড়ায় প্রবীণ অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহম্মদ সিকান্দার খানের মতে- ‘নিজে না খেয়ে বন্ধুকে খেতে দেয়া’। এছাড়া দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার লাইফ লাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, আখাউড়া এলাকার সড়ক আঞ্চলিক মহাসড়কসমূহের মাত্রাতিরিক্ত ভারী ট্রাক-লরিবহর চলাচলের ভার বহনের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। এ অবস্থায় ভারতের ট্রানজিটের পণ্যভারে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে যোগাযোগ ব্যবস্থা।

https://www.dailyinqilab.com/article/348405