৬ জানুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১১:০৭

ভ্যাকসিনে অনিশ্চয়তা কাটেনি

রফতানিতে কোনো বাধা নেই, সময়মতোই হাতে পাব : স্বাস্থ্যমন্ত্রী চুক্তিতে কী আছে, পরিষ্কার করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

‘বাংলাদেশ কবে ভ্যাকসিন পাবে?’ এই প্রশ্নের এখনো কোনো ‘যথাযথ’ উত্তর পাওয়া যায়নি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ যথাসময়েই ভ্যাকসিন পাবে। কিন্তু, সরাসরি ভারতের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে তা নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। চুক্তিটা বাণিজ্যিক নাকি জিটুজি (সরকার থেকে সরকার), এ নিয়েও রয়েছে বিপরীত বক্তব্য। ‘ভারত যখন ভ্যাকসিন পাবে, আমরাও তখন পাব’; ‘জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে আমরা ভ্যাকসিন পাব।’ কিন্তু, গত সোমবার এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য সচিব বলেছেন, ‘আমরা চুক্তি অনুযায়ী টিকা পাব’; ‘চুক্তির ভিত্তিতে কথা বলছি’। যদিও চুক্তিতে কী আছে, সেটা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। আর তাই ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি।

অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফর্মুলায় তৈরি ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড গত রোববার মানবদেহে প্রয়োগের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ভারত। এর আগে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় যুক্তরাজ্য। সেরাম ইনস্টিটিউটের ওই ভ্যাকসিন প্রতিবেশী দেশে অনুমোদন পাওয়ার পর আশার আলো দেখছিল বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে গত ৫ নভেম্বর চুক্তি করে। এতে বাংলাদেশও দ্রুত ভ্যাকসিন পাচ্ছে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু সেরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিন চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার দিনেই রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারত সরকার। তাই ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। গত দু’দিন দেশে এবং ভারতে ভ্যাকসিন নিয়ে চলছে নানা ধরণের আলোচনা-সমালোচনা ও বক্তব্য। ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন গতকাল বলেছেন, ভ্যাকসিন রফতানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা নেই। ভ্যাকসিন নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে এক টুইট বার্তায় সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইনডিয়ার প্রধান নির্বাহী আদর পূনাওয়ালা বলেছেন, ভারত থেকে সব দেশেই ভ্যাকসিন রফতানির অনুমোদন আছে। এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ইনকিলাবকে বলেছেন, তিনি সোমবার দিনে এবং রাতে ভারতের সরকারি পর্যায়ে কথা বলেছেন। তারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করছে ভ্যাকসিন রফতানিতে কোন বাধা নেই। সময়মতো জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে ভ্যাকসিন আমরা হাতে পাবো বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। জাহিদ মালেক বলেন, ভ্যাকসিন পেতে নানামুখী তৎপরতা চলছে। এমনকি অক্সফোর্ডের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা এবং ভ্যাকসনি পেতে অন্যান্য উৎসও খোঁজা হচ্ছে।

এছাড়া গতকাল পাঁচ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকায় করোনা ভ্যাকসিন ক্রয়, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পে অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। তার মধ্যে ভারতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা হবে তিন কোটি ডোজ। এতে ব্যয় হবে ৪ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। কোভিশিল্ড নামে ওই ভ্যাকসিনের তিন কোটি ডোজ কিনতে গত ৫ নভেম্বর সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার ও বেক্সিমকোর ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। এর মাধ্যমে সেরাম থেকে টিকা এনে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেবে বেক্সিমকো। ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন ক্রয়ে ৬০০ কোটি টাকা ভারতকে দেয়াও হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর গত সোমবার এই ভ্যাকসিন আমদানি ও জরুরি ব্যবহারের অনুমোদনও দিয়েছে। ভারত থেকে আমদানি করা সেরামের এসব ভ্যাকসিন প্রতি ডোজ সরকারের ক্রয় মূল্য দুই ডলার।

সূত্র মতে, ভ্যাকসিন নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী আদর পূনাওয়ালা বলেছেন, ভারত থেকে সব দেশেই ভ্যাকসিন রফতানির অনুমোদন আছে। এর আগে এক সাক্ষাৎকারে তার বক্তব্য নিয়ে দু’দিন ধরে বিভ্রান্তি চলার পর গতকাল মঙ্গলবার এক টুইট বার্তায় এ কথা জানিয়েছেন সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান। টুইটে তিনি লিখেছেন, যেহেতু সাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, তাই তিনি বিষয়টি স্পষ্ট করতে চান। তিনি বলেন, সব দেশে ভ্যাকসিন রফতানির অনুমোদন রয়েছে। আর ভারত বায়োটেক নিয়ে সা¤প্রতিক যে ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে, তা দূর করতে একটি যৌথ প্রকাশ্য বিবৃতি দেয়া হবে।

বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ‘এক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’ বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোভিশিল্ড ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার এক মাসের মধ্যে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন প্রথম চালান পাঠানোর কথা সেরাম ইনস্টিটিউটের। অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যে প্রথম চালানের ৫০ লাখ ডোজ পাবে বাংলাদেশ।

সূত্র মতে, ভারত গত রোববার সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত ভ্যাকসিন ব্যবহারের চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দিলে বাংলাদেশেও তা দ্রুত পাওয়ার আশা তৈরি হয়। কিন্তু সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদার পূনাওয়ালার বরাত দিয়ে গত রোববার রাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, রফতানি শুরুর আগে আগামী দুই মাস তারা ভারতের স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতেই জোর দেবে। ওই খবরে বাংলাদেশের টিকা পাওয়া বিলম্বি^ত হতে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়।

গত সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং বেক্সিকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান দফায় দফায় একই বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন, চুক্তি অনুযায়ী সেরাম ইনস্টিটিউট ভ্যাকসিন দিতে বাধ্য। একই সঙ্গে ভ্যাকসিন আমরা সময় মতোই পাব।

ভ্যাকসিন বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আওতায় দুই দেশের সেরাম-বেক্সিমকো এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। তাই দুই সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত। অন্যথায়, বিভ্রান্তি আরও বাড়তে পারে। যা উদ্বেগের বিষয় হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

চুক্তির বিষয়টি পরিষ্কার করা নিয়ে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, সরকারকে জনসম্মুখে এটা নিয়ে কথা বলতে হবে। এতে জনগণের মনে কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না, তাদের মনে আস্থা তৈরি হবে এবং তারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ধরে রাখাটা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, ভ্যাকসিন নিয়ে ইতোমধ্যেই বিশ্বে অনেক ধরনের পলিটিসাইজেশন হয়ে আছে। ভ্যাকসিন ইস্যু নিয়ে যাতে কোনো ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি না হয়, এর জন্য সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন, ভ্যাকসিন নিয়ে চুক্তির বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জিটুজি বলছে, বেক্সিমকো বলছে বাণিজ্যিক, এটা আসলে কী? কিন্তু, চুক্তির বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। আর তাই সবমিলিয়ে অনেক বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে যেহেতু এটা একটা জাতীয় সংকট, তাই চুক্তিটার বিষয়ে পরিষ্কার করে বলা উচিত ছিল বলেই মনে করেন প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম।

https://www.dailyinqilab.com/article/348155/