৫ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১১:২৭

দেশে প্রতিবছর বায়ু দূষণ জনিত রোগে এক লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু

মুহাম্মদ নূরে আলম : রাজধানী ঢাকা এখন দুনিয়ার সবচেয়ে দূষিত নগরগুলোর শীর্ষে। এখানকার মাটি, পানি, বায়ু চরম দূষিত। বাতাসে ভারি ধাতুর উপস্থিতি মাত্রা ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। বাংলাদেশে প্রতিবছর বায়ু দূষণের কারণে সৃষ্ট রোগে এক লাখ ২৩ হাজার মানুষ মারা যায়। এবং প্রতি ১০ জনের একজনের মৃত্যুর কারণ দূষিত বায়ু। দূষিত বায়ুর কারণে দেশের প্রতিটি শিশুর আয়ু কমছে কমপক্ষে ৩০ মাস। গত রোববার দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-এর প্রকাশিত রিপোর্টে (২০২০) এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। গত রোববার বিশ্বজুড়ে একযোগে প্রকাশিত বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০২০ শীর্ষক এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন বলছে, বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫। এত দিন এই উপাদান সবচেয়ে বেশি নির্গত করত চীন। গত দুই বছরে চীনকে টপকে ওই দূষণকারী স্থানটি দখল করে নিয়েছে ভারত। চীন ও ভারতের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে জাপানের টোকিও শহর। প্রতিবেদনটিতে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বায়ুদূষণের পরিমাণ পরিমাপ করা হয়েছে। মূলত যান্ত্রিক উৎস থেকে সৃষ্টি হওয়া ধোঁয়া ও ধুলা থেকে বাতাসে ক্ষুদ্র কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। কয়লা ও জৈব জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর কণার সৃষ্টি হয়। ইটভাটা, শিল্প-কারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া এবং সড়ক ও ভবন নির্মাণসামগ্রী থেকে তৈরি ধুলায় এগুলো সৃষ্টি হয়। নির্মাণ কাজ থেকে প্রচুর ধুলা ও ধোঁয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। শুস্ক মৌসুমে বাতাসে ওই ক্ষুদ্র কণাগুলো এমনিতেই বেশি পরিমাণে পরিবাহিত হয়। আর এই সময়ে বেশি নির্মাণ কাজ চলায় এবং সব ক'টি ইটভাটা চালু থাকায় দূষণের পরিমাণ বেড়ে যায়।

বায়ু দূষণের প্রভাব নিয়ে শিউরে ওঠার মতো তথ্য দিয়েছে দূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর দূষণে মারা যায় এক লাখ ২৩ হাজার মানুষ। আর প্রতি ১০ জনের একজনের মৃত্যুর কারণও এটি। দূষিত বায়ুর কারণে দেশের প্রতিটি শিশুর আয়ু কমছে কমপক্ষে ৩০ মাস।

জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় শীত শুরুর পর তাদের হাসপাতালে ফুসফুসে প্রদাহ ও শ্বাসকষ্ট রোগীর সংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে। শীত এলেই ধুলার শহরে পরিণত হয় মেগাসিটি রাজধানী ঢাকা। বায়ু দূষণে ধুকতে থাকে পুরো নগর। হাঁসফাঁস অবস্থা হয় নাগরিকদের। সাধারণ মানুষ বলেন, শরীরে এলার্জি হচ্ছে। ডাক্তার দেখানোর পর বলেছে এটি যাবে না। চুল পড়ে যাচ্ছে আর মাথা ব্যথা হচ্ছে। এছাড়াও ঠাণ্ডা লাগে কিছুদিন পরপর। রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বছরের এই সময়টিতে শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীর চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. জিয়াউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, তিন চার মাস আগে রোগী সংখ্যা কম ছিল। এখন হাজারের কাছাকাছি রোগী চলে আসছে। এই মাস্ক যদি আগে থেকেই ব্যবহার করা হতো, তাহলে বায়ু দূষণ থেকে মুক্ত থাকা যেতো।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর পরিচালক ড. কামরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, বায়ু দূষণ রোধে শহরের বিভিন্ন সড়কে দিনে দুবার করে পানি দিতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, বায়ু দূষণ রোধে নিয়মিত পানি ছিটাতে নগর উন্নয়নের সাথে জড়িত সব সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছেন তারা। পরিবেশ অধিদপ্তর এর পরিচালক মো. জিয়াউল হক গণমাধ্যমকে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, সিটি কপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ সকলে মিলে যাতে একটি সমাধান করে। তবে রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোকে সুস্থ ও নির্মল বায়ুর নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে বলা হয়েছে। আর বায়ুদূষণের কারণে শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকে পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। পিএম ২.৫ ছাড়াও বায়ুর অন্যান্য দূষণকারী পদার্থের উপস্থিতির দিক থেকে সামগ্রিক দূষণের একটি চিত্র ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। তাতে শীর্ষ বায়ুদূষণকারী দেশ হিসেবে চীন, ভারত পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুদূষণবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক আবদুস সালাম গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মোট পরিমাণ চীন ও ভারতের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তবে বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে দ্রুত বায়ুদূষণ বাড়ছে, তার মধ্যে অবশ্যই বাংলাদেশ প্রথম সারিতে থাকবে।

ক্ষুদ্র কণার উৎস: অধ্যাপক আবদুস সালাম ১০ বছর ধরে ঢাকা ও বাংলাদেশের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ করছেন। তার হিসাব অনুযায়ী মূলত যান্ত্রিক উৎস থেকে সৃষ্টি হওয়া ধোঁয়া ও ধুলা থেকে বাতাসে ক্ষুদ্র কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। মূলত কয়লা ও জৈব জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর কণার সৃষ্টি হয়। ইটভাটা, শিল্পকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া এবং সড়ক ও ভবন নির্মাণসামগ্রী থেকে তৈরি ধুলায় এগুলো সৃষ্টি হয়।
অধ্যাপক সালামের নেতৃত্বে পরিচালিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে কয়লা পোড়ানো হয় এমন শিল্পকারখানার সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশে যে নির্মাণকাজ হচ্ছে, তাতে প্রচুর ধুলা ও ধোঁয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে বাতাসে ওই ক্ষুদ্র কণাগুলো এমনিতেই বেশি পরিমাণে পরিবাহিত হয়। আর এই সময়ে বেশি নির্মাণকাজ চলায় এবং সব কটি ইটভাটা চালু থাকায় দূষণের পরিমাণ বেড়ে যায়।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বে যেসব কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে বায়ুদূষণ রয়েছে পঞ্চম স্থানে। ২০১৫ সালে প্রায় ৪২ লাখ মানুষের অকালমৃত্যুর কারণ এই বায়ুদূষণ। আর এসব অকালমৃত্যুর অর্ধেকের বেশি ঘটেছে চীন ও ভারতে। এসব দেশে প্রতি ১০ জনে মাত্র ১ জন নির্মল বায়ুর এলাকায় বসবাসের সুযোগ পান। প্রতিবেদন অনুসারে বায়ুদূষণের কারণে ২০১৫ সালে চীনে বছরে ১১ লাখ ৮ হাজার ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় এই সংখ্যা ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০, পাকিস্তানে ১ লাখ ৩৫ হাজার ১০০ ও যুক্তরাষ্ট্রে ৮৮ হাজার ৪০০।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে যে নির্মাণকাজগুলো হচ্ছে, তাতে সকাল ও বিকেল দুই বেলা নির্মাণসামগ্রী, বিশেষ করে বালু ও ইট পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু রাজধানীর বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রেখে ধুলা সৃষ্টি করছে।

মনুষ্যসৃষ্ট নির্গমন: গবেষকেরা মানুষের কারণে হওয়া দূষণ এবং প্রাকৃতিক কারণে হওয়া বায়ু দূষণ - যেমন মরুর লু হাওয়া এবং দাবানলের কারণে হওয়া দূষণ- দুটোই পরীক্ষা করে দেখেছেন।
বয়স্ক মানুষ বেশি ঝুঁকিতে: গবেষকেরা দেখেছেন বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বিপদে পড়েন বয়স্ক ব্যক্তিরা। সারা দুনিয়ায় এ কারণে যত মৃত্যু হয় তার ৭৫ শতাংশই ঘটে যাদের বয়স ৬০ এর ওপরে। গবেষণার ফলাফলের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রোগ-তত্ত্ববিদ স্যামুয়েল চাই বলেছেন, এই গবেষণা প্রমাণ করছে যে বায়ু দূষণ পুরো বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্যই কতো বড় হুমকি সৃষ্টি করেছে। বায়ু দূষণ যে নতুন ধূমপান এ তো আর গোপন কথা নয়, সুতরাং জনস্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের এখন এ নিয়ে সিরিয়াস হবার সময় এসেছে। এখন বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে নতুন নীতি তৈরি করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শুস্ক মৌসুমে যেসব নির্মাণ কাজ হচ্ছে, তাতে সকাল ও বিকেল দুই বেলা নির্মাণসামগ্রী, বিশেষ করে বালু ও ইট পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু রাজধানীর বেশিরভাগ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রেখে ধুলার সৃষ্টি করছে।

https://dailysangram.com/post/439588