৫ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১১:২২

সততা স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হোক

সুশাসন

ছেলেবেলায় পঞ্চম শ্রেণীতে অধ্যায়নকালীন বাংলার শিক্ষক অসুস্থতার কারণে একদিন শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত হতে পারেননি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ক্লাসের নির্ধারিত সময়ের মিনিট দশেক পরে শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত হয়ে ছাত্রছাত্রীদের আধা ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে ২০০ শব্দের মধ্যে ‘চরিত্র’ বিষয়ে একটি রচনা লিখতে বলেন। প্রধান শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের দায়িত্বটি দেয়ার আধাঘণ্টা পর শ্রেণীকক্ষে আবার আসবেন, এ কথা বলে চলে যান। আধা ঘণ্টা পর প্রধান শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত জনা ত্রিশেক ছাত্রছাত্রীর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি রচনা লেখার কাজ শেষ করতে পারেনি। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে অবশিষ্ট ছাত্রছাত্রীদের রচনা লেখা বন্ধ করতে বলেন। এরপর সবার খাতা নিয়ে নিজের টেবিলে রেখে প্রতিটিতে চোখ বুলাতে লাগলেন। ৮-১০টি খাতায় চোখ বুলানোর পর তিনি দেখতে পেলেন একটিতে একটি ইংরেজি প্রবাদ দিয়ে রচনাটি লেখার সূচনা করা হয়েছে। প্রবাদটি হলো- গড়হবু রং ষড়ংঃ হড়ঃযরহম রং ষড়ংঃ, বিধষঃয রং ষড়ংঃ ংড়সবঃযরহম রং ষড়ংঃ, নঁঃ পযধৎধপঃবৎ রং ষড়ংঃ বাবৎুঃযরহম রং ষড়ংঃ. এবার প্রধান শিক্ষক খাতা দেখা বাদ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বলতে থাকেনÑ দেখো একজন মানুষের জীবনে চরিত্র হচ্ছে অমূল্য সম্পদ। তোমরা যদি নিজেদের চরিত্র গঠনে আত্মপ্রত্যয়ী হও এবং যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সততা আঁকড়ে ধরে থাকতে পারো, তাহলে কখনো সাময়িক অসুবিধা হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে দেখবে সফল ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছো।

সততা একজন ব্যক্তির চরিত্রে আরোপিত গুণ। গুণটি যখন একজন ব্যক্তির চরিত্রের ওপর আরোপিত হয় বা চরিত্রের সংশ্লেষে ব্যবহৃত হয় তখন তাকে বলা হয় সৎ। সততার অস্তিত্ব চিন্তা বা মননে। সততার শারীরিক বা ব্যবহারিক অভিব্যক্তি চরিত্রের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। একজন ব্যক্তির মানসিক অথবা নৈতিক চরিত্র ভালো হলে তিনি সচ্চরিত্রের অধিকারী হন। অন্যদিকে মানসিক বা নৈতিক চরিত্র খারাপ হলে সে দুশ্চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকে। ইহলৌকিক জীবনে সমাজে আত্মসম্মান নিয়ে বসবাসের জন্য সততা একটি অপরিহার্য গুণ, যা সবার থাকা উচিত।

রাজনীতিক, বিচারক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী, পেশাজীবী, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী সবার জন্য সৎ হওয়া অপরিহার্য। বিচারকদের ক্ষেত্রে অনেককে বলতে শোনা যায়, তিনি একজন সৎ বিচারক। একজন বিচারকের অসৎ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। একজন বিচারক অসৎ হলে তার বিচারিক কাজ পরিহার করাই শ্রেয়। সততা একজন বিচারকের সহজাত প্রবৃত্তি হওয়ায় যেকোনো প্রতিকূলতায় তাকে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে হবে, তাই অসততা কখনো একজন বিচারকের কাছে প্রত্যাশিত হতে পারে না।

ন্যায়ের বিপরীত হচ্ছে অন্যায়। ন্যায়ের পরিপন্থী যেকোনো কাজ অসৎ কর্ম হিসেবে বিবেচ্য। আইনের অপব্যাখ্যা, বিচারিক রায়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা, বিচারিক রায়ে বিচার্য বিষয়ের বাইরে মামলার বিষয়বস্তুর সাথে সংশ্লেষহীন বিষয়ের অবতারণা এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিজেদের ক্ষমতার হানির আশঙ্কায় ইচ্ছাকৃতভাবে প্রাসঙ্গিক বিষয় পরিহার, আইন ও বিধিবিধান দ্বারা অসমর্থিত কার্য, জ্যেষ্ঠের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কাজ, জনস্বার্থের পরিপন্থী কর্ম, মামলার শুনানি শেষে বিচারিক রায় প্রদানে কালক্ষেপণ, উৎকোচ গ্রহণ বা প্রদান, অন্যায় সুবিধা গ্রহণ বা প্রদান, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ বা স্বার্থের বিনিময়ে কিছু করা, দুর্নীতিতে লিপ্ত হওয়া বা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া, অপরকে ঠকানো, মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যার আশ্রয় নেয়া, সিদ্ধান্ত প্রদানে অযথা কালক্ষেপণ, গল্প-গুজবে অফিস সময় কাটানো, ব্যক্তিগত কাজে সরকারি সুবিধাদি ও অফিস সময়ের ব্যবহার, অধীনস্থদের সরকারি কাজের ব্যাঘাতে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার প্রভৃতি অনৈতিক বিধায় অন্যায় বা অসৎ কাজ।

অন্যায় বা অসৎ কাজ স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে যে কোনো সমাজ বা দেশের মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে মানসিক যাতনা ও বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দেখা দেয়। মানবিক মূল্যবোধহীন ব্যক্তির পক্ষে কখনো অপরের মানসিক যাতনা ও বিপর্যয় উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সৎ থাকা নৈতিক দায়িত্ব বিধায় এটিকে মুখ্য বিবেচনায় অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও অপারগতাকে উপেক্ষা করে কোনো কর্মকর্তাকে উচ্চ পদে সমাসীন করার যৌক্তিকতা কখনো সমাদৃত হয় না। একই সাথে আশানুরূপ ফল দিতেও ব্যর্থ হয়।

যেকোনো সভ্য সমাজে জ্যেষ্ঠতা, সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সামর্থ্য এই পাঁচটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে অব্যবহিত উচ্চপদে বা সর্বোচ্চ পদে পদায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে কখনো কখনো অন্যায়ের শিকার ব্যক্তিদের আত্মসম্মান রক্ষায় চাকরি হতে ইস্তফাপত্র দিতে দেখা যায়। যেমনটি দেখা গিয়েছিল আমাদের পাশের দেশ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব নিয়োগের ক্ষেত্রে। চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুসারে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে পররাষ্ট্র সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হয়ে আসছিল। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের প্রথম মহিলা হাইকমিশনার বিনা সিক্রির স্বামী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। তাকে পররাষ্ট্র সচিব না করে সপ্তম জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে পররাষ্ট্র সচিব করা হয়। এর প্রতিবাদে তিনি একাই চাকরি থেকে ইস্তফা দেননি; তার স্ত্রীও ইস্তফা দিয়েছিলেন। ঘটনাটি ভারতের বিবেকবান প্রতিটি নাগরিকের মূল্যবোধে নাড়া দিলেও যে মহলটি এ অন্যায়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিল পরবর্তী সময়ে তাদের এ জন্য খেসারত দিতে হয়েছিল। আমাদের দেশেও এ ধরনের দু-একটি নজির আছে। আত্মপ্রচার পরিহার্থে সে সংক্রান্ত আলোচনা না হয় না-ই করলাম।
বিশ্বস্ত ও অনুগত ভেবে জ্যেষ্ঠকে অতিক্রান্ত করে কনিষ্ঠকে মূল্যায়ন পরবর্তী সময়ে যে সুখকর হয় না এর উদাহরণ উপমহাদেশে বিরল নয়। যেমন- ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সামরিক বাহিনী দ্বারা তার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেন ব্যাহত না হয় ওই বিবেচনায় তিনি কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙ্গিয়ে জিয়াউল হককে সেনাপ্রধান পদে নিয়োগ দেন। পরে দেখা গেল জিয়াউল হক তার পথের কাঁটা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার নিজের রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করলেন।

উচ্চপদে আসীন আমাদের দেশের অনেক পদধারীর মধ্যে নৈতিকতার অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও উপসম্পাদকীয়তে জানা যায়, আমাদের শীর্ষ বিচারালয়ে একাধিক বিচারক রয়েছেন যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিচার বিভাগের নি¤œতম পদ সহকারী জজ পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য নির্ধারিত যোগ্যতার নি¤œতর। প্রথম আলো পত্রিকায় সংবাদটি ও উপসম্পাদকীয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এখনো এ বিষয়ে পত্রিকায় কোনো প্রতিবাদলিপি ছাপা হয়নি। বিষয়টির সত্যতা থেকে থাকলে তা হবে দেশ তথা বিচার বিভাগের জন্য দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিচারক নৈতিকতা বোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে নিজের ওপর সুবিচার করলে বিচার বিভাগের জন্য হয়তো বিব্রতকর পরিস্থিতি পরিহার সম্ভব হবে। তা ছাড়া সংবিধানের ১০৯নং অনুচ্ছেদকে প্রকৃত অর্থে কার্যকর করতে হলে বিষয়টির ন্যায়সম্মত সমাধান বাঞ্ছনীয়। রাজনৈতিক পদধারী বিশেষত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টা পদধারী প্রভৃতি সমগ্র দেশকে প্রতিনিধিত্ব করায় তাদের কারো জন্য সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশেষ এলাকা অর্থাৎ নিজ এলাকার উন্নয়নে প্রাধান্য দেয়া এবং নিজস্ব বলয়ের লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা সততার ওপর কালিমা লেপন বৈ আর কিছু নয়। বিষয়টি উচ্চপদে আসীন সামরিক-বেসামরিক পদধারীদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।
সততা সর্বক্ষেত্রে সব শ্রেণীপেশার মানুষের মধ্যে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হলে অপর কোনো প্রতিবন্ধকতা দেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারবে না। তাই এ কথা অনস্বীকার্য যে, সততার মধ্যে নিহত আছে দেশ ও জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন, কল্যাণ ও মঙ্গল।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/553719/