৫ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১১:২১

দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অতিকথন

ড. মো. নূরুল আমিন : ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও যোগাযোগ এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি পরিহাস করে বলেছেন যে, ১২ বছর চলে গেছে বিএনপি কোন আন্দোলনই তৈরি করতে পারেনি; এ দলের কাছে জাতি কি আর আশা করতে পারে? তার পরিহাসটি সময়োপযোগী। আসলে তো তাই! দেশে প্রচণ্ডতম দুঃশাসন, দুর্নীতি ও একদলীয় শাসন চলছে। পার্লামেন্ট না ভেঙ্গে এমপিদের ক্ষমতায় রেখেই নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। একবার বিনা ভোটে নির্বাচন হয়েছে, আরেকবার ভোটের আগের দিন মধ্য রাতে নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন দল দু’মেয়াদ অর্থাৎ দশ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছে। কই আন্দোলন, মিটিং, মিছিল, হরতাল, অবরোধ কোনটাই তো হলো না। সরকার নিরাপদে ক্ষমতা ভোগ করছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা তো আছেই, ইউনিয়ন পর্যায়ের ছাত্রলীগ নেতাদের কাছেও পাচারযোগ্য হাজার হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাচ্ছে। ধর্ষণ, হত্যা, গুম, দুর্নীতিতে দেশ সয়লাব। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ দলীয় কব্জায়, প্রতিবাদ তো নেই। বিরোধী দল অকার্যকর। বিরোধী দল দমনে তার সাফল্যে সম্ভবত ওবায়দুল কাদের এতো বেশি খুশি যে তিনি নির্যাতিত বিরোধী দলের ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্য হারানোকে পরিহাস করতেও ভুলছেন না। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন যে, আন্দোলনের কারণে তারা বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩৩ লাখ মামলা দিয়েছেন। মামলার হাজিরা দিতে দিতে তারা পরিশ্রান্ত; হত্যা-গুম তো আছেই। তারা মানববন্ধন, মিটিং মিছিল এমনকি ঘরোয়া বৈঠক করলেও গ্রেফতার হন। আসলে ক্ষমতার মোহ ও অর্থান্বেষা এবং দেশপ্রেমের অভাব এই তিন প্রবণতার অভিশপ্ত সংযোগে বাংলাদেশে গোটা রাজনীতির চরিত্রই বদলে গেছে এবং তা পরিণত হয়েছে দুর্নীতি আর দখলবাজির নিষ্ঠুর আখড়ায়। যারা গণতন্ত্রের নামে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করলেন এবং এই কৃতিত্বের জন্য গর্ববোধ করে থাকেন; তারা কোটি মানুষের দুঃখবরণ, জীবন দান ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখার ব্যাপারে নিজেদের অতিশয় নতজানু ও শক্তিহীন প্রমাণ করলেন। এর চেয়ে দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত আর কি হতে পারে। এরা তাদের স্বাধীনতার চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন এবং সমাজের সামনে উলঙ্গ হয়ে পড়েছেন এবং প্রমাণ করেছেন যে ক্ষমতার লালশা এবং অর্থান্বেষাই তাদের তথাকথিত দেশপ্রেমের মূল চেতনা।

প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একটি সত্য কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ক্ষমতার মসনদ আর জেলখানার দূরত্ব খুবই কম। কথাটা অত্যন্ত সত্য। দেশে এখন রাজনৈতিক সংকট চলছে। তবে এই সংকটের যুক্তিসঙ্গত রাজনৈতিক সমাধান পাওয়া যাবে না এমন কথা কেউ বিশ্বাস করেন না। বাধা হচ্ছে তার দল আওয়ামী লীগ নিজে। এই দল এবং তার আশপাশের কেউ ক্ষমতা হারাতে প্রস্তুত নন। তারা মনে করেন তাদের জন্য ক্ষমতা হারানো নিরাপদ নয়। এ জন্যই বিজ্ঞ জনেরা বলে থাকেন যে, দুর্নীতির রাজত্ব আর গণতন্ত্র একসাথে চলতে পারে না।

সাংঘর্ষিক রাজনীতি সুস্থ পরিস্থিতির পরিচায়ক নয়। বাংলাদেশের আজকের পরিস্থিতির জন্য ক্ষমতাসীনরাই দায়ী। দলীয় সন্ত্রাসী এবং পুলিশ রাজপথে সুস্থভাবে রাজনীতি করতে না দেয়ার কারণেই রাজনীতিতে সংঘর্ষ বাঁধে। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি এখন বিনা মূলধনের লাভজনক ব্যবসা। মূলধন না লাগলেও এই ব্যবসা এখন প্রচুর মূলধন সৃষ্টি করে এবং ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি ও তাকে রক্ষার জন্য এই মূলধনের যোগান দেয়। ফলে রাজনীতি এখন রাজনীতিকদের হাতে আর নেই, ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। অথবা রাজনীতিকরাই ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন। তারা মুনাফা ছাড়া আর কিছু বুঝেন না।

প্রবীণ রাজনীতিক ব্যরিস্টার মঈনুল হোসেনের একটি কথা স্মরণ করার মতো। তিনি বলেছেন, নিজেদের অযোগ্যতা ও দুর্নীতির ব্যাপকতার কারণে সরকার নিজেই কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। পুলিশী শক্তির মাত্রাতিরিক্ত অপব্যবহারের উপর সরকারকে নির্ভর করতে হচ্ছে। পুলিশ সরকারকে রক্ষা করতে পারে না- পুলিশের দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। অথচ পুলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে সরকারকে রক্ষার কাজে। তাদেরকে বুলেট প্রুফ পোশাক পরিয়ে যুদ্ধ করতে বলা হচ্ছে। এভাবে পুলিশের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করা বেদনাদায়ক। রাজনৈতিক সরকার রক্ষা পায় নিজেদের রাজনীতির সাফল্যের কারণে। এই সত্যটি রাজনীতিকদের ভুলে গেলে চলবে না। পাকিস্তান আমলের অগণতান্ত্রিক শাসন, শোষণ ও জুলুমের অবসান ঘটানোর জন্যই আমাদের জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন।

এখন যদি একই ধরনের বরং তার থেকেও নিকৃষ্ট অগণতান্ত্রিক অপশাসন, শোষণ ও অবিচার জনগণের উপর চেপে বসে তাহলে তফাৎ রইলো কোথায়? মুখে চেতনার কথা বলে কাজে ফাঁকা হলে তো চলবে না। দুর্নীতি ও কুশাসন রক্ষা করে গণতন্ত্র বাঁচানো যায় না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত বিরোধী দল সরকারেরই একটি অংশ। উভয়ের সাফল্যই গণতন্ত্রের সাফল্য। এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা রক্ষার কর্মকাণ্ড বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র রক্ষার পথ বা পন্থা হতে পারে না।

আরেকজন মন্ত্রী অধিকতর সুস্পষ্ট করে বলতে গেলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তিন-চার দিন আগে আরেকটি আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন বলে পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, দেশব্যাপী ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তিনি নাকি বলেছেন যে, আমদানি প্রক্রিয়াধীন কোভিড-১৯ টিকা বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা পাবে না। কেন পাবে না তা তিনি উল্লেখ করেননি। বিএনপি-জামায়াত এ দেশেরই দুটি দল। তারা এ দেশের নাগরিক এবং ভোটার। রাষ্ট্র তাদের কারুর নাগরিকত্ব খারিজ করেছে এ ধরনের খবর পাওয়া যায়নি। তারা খাজনা দেন, ট্যাক্স দেন, ভোট প্রার্থীও হন। তাহলে রাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে আমদানিকৃত টিকা তারা পাবেন না কেন? আমরা যতদূর জানি, কোন ব্যক্তিকে মন্ত্রী হতে হলে সংবিধানে নির্ধারিত শপথনামা পাঠ করতে হয়। এই শপথনামায় বলা আছে যে, শপথাধীন ব্যক্তি দল-মত নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের প্রতি সমান আচরণ করবেন, শুধুমাত্র নিজ দলকে প্রাধান্য দিবেন না। সংবিধানে পরিষ্কার বলা আছে যে, রাষ্ট্রের সকল নাগরিক চাকরি বাকরিসহ রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। মন্ত্রী যদি এর ব্যতিক্রম করেন বা বলেন তাহলে সংবিধান লংঘনের জন্য দায়ী হবেন। এ প্রেক্ষিতে চলনে বলনে কথনে মন্ত্রীদের সতর্ক হওয়াটা শ্রেয় বলে আমি মনে করি।

https://dailysangram.com/post/439583