৪ জানুয়ারি ২০২১, সোমবার, ১২:১৭

কোন পথে অমর একুশের বইমেলা ?

ইবরাহীম খলিল : বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশের বই মেলা অন্যান্য বছরের এই সময়ে সরগরম থাকে এবং লেখক-পাঠক এবং বই প্রেমিদের সম্মিলন ঘটে। কিন্তু এবারের বই মেলার সিদ্ধান্ত একরকম ঝুলে আছে। ঠিক কবে হবে প্রাণের বইমেলা তাও বলা যাচ্ছে না। সবার মনে বই মেলা নিয়ে উসখুশ অবস্থা। লেখকদের কেউ কেউ প্রস্তাব করছেন পহেলা ফাল্গুন থেকে বইমেলা শুরু করার জন্য। আসলে বইমেলা কিভাবে হবে তা নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। একারণে তারিখও ঘোষণা করা হচ্ছে না। তবে করোনাকালে ইতিমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেলা কিন্তু হয়েই গেল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মানুষেরাই ভার্চুয়াল বই মেলা করে দেখিয়ে দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাকালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা হয়ে গেল গত বছরের ১৪ থেকে ১৮ই অক্টোবর জার্মানিতে। ফ্রাঙ্কফুর্টের মেলাটা হওয়ার কথা ছিল ফেস্টহালেতে। কিন্তু করোনার কারণে করতে হয়েছে ভার্চুয়ালি। অর্থাৎ যাকে বলে ডিজিটাল বইমেলা। শহরজুড়ে নানা আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল বইমেলাকে ঘিরে। কিন্তু প্রদর্শনী হল ছিল ফাঁকা। মেলায় শুধু বইয়ের কপিরাইট বিক্রি করেই সব সুবিধা পান লেখক এবং প্রকাশক। মেলার প্রধান ফোকাসে ছিলেন গ্রন্থকার এবং তাদের বই। ফ্রাঙ্কফুর্ট ফেস্টহালের ভার্চুয়াল সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে সারাবিশ্বের গ্রন্থকার ও বইয়ের স্বত্তাধিকারীরা এক্ষেত্রে সব তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

ফ্রাঙ্কফুর্টের ডিজিটাল বইমেলার প্রেসিডেন্ট ইয়ুর্গেন বুস এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, মেলার জন্য প্রথমেই তারা ডিজিটাল সবধরনের পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখেছেন। মেলা শুরুর আগেই লেখকের সঙ্গে পাঠকরা কীভাবে যোগাযোগ করতে পারবে তা-ও ঠিক করা হয়। গ্রন্থকারের অধিকারের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়। এছাড়া ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রকাশকরা যাতে বিশ্বব্যাপী নিজেদের প্রকাশনা নিয়ে হাজির হতে পারেন, সে সুযোগ সৃষ্টি করা হয় টেলিভিশন, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। তার আগে এ কাজে দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ করে কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

মেলার পরিচালক ইয়ুর্গেন বোস মনে করেন, অন্য কোনো ক্ষেত্রে ছাপা বই ও ডিজিটাল বইয়ের মধ্যে মেলবন্ধন এতটা জোরালো নয়, যেমনটা খুদেদের জগতে দেখা যায়। কমিকস'এর ভূমিকাও বেড়ে চলেছে। বইয়ের জগতে শোনা যাচ্ছে নতুন কিছু প্রবণতার কথাও। যেমন ‘ক্রো-ফান্ডিং'। অর্থাৎ লেখক তাঁর প্রকল্প ইন্টারনেটে প্রকাশ করার পর ব্যবহারকারীরাই তার জন্য অর্থের ব্যবস্থা করছেন। আছে ‘ফ্যান-ফিকশন'। লেখক বন্ধ করে দিলেও হ্যারি পটারের মতো জনপ্রিয় সিরিজ ইন্টারনেটে চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে অনেকে। পথ চলতে ইলেকট্রনিক বই’এর কোনো কমতি নাই, ঘাটতি নাই, তার সংস্করণ কখনোই ফুরোয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ই-বুক ও ‘সেল্ফ পাবলিশিং'এর মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হচ্ছে।

গত বছর অথাৎ ২০১৯ সালে সে দেশে ই-বুক বিক্রির মুনাফার মাত্রা চিরায়ত বইয়ের ব্যবসাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জার্মানিতে এখনো সনাতন পদ্ধতিতে বই বিক্রির রীতি চলছে। জার্মান পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতির প্রধান আলেক্সান্ডার স্কিপিস এ বিষয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। তাঁর মতে, যে কোনো পুস্তক বিক্রেতা অ্যামাজন'এর চেয়ে বেশি শক্তি রাখেন। ক্রেতাদের কাছে নিজেদের আকর্ষণ বাড়াতে তাদেরও নিজস্ব অনলাইন দোকান খুলতে হবে। এ ভাবে ছোট ছোট সংস্থাও বড় কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে পারে। তবে জার্মান পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতি শুধু উৎসাহের কথা বলে হাত গুটিয়ে বসে নেই। এই শিল্পক্ষেত্রকে ভবিষ্যতেও টিকিয়ে রাখার পথ খুঁজতে তারা একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। তাতে একটি প্রকল্পের জয় হয়েছে। কীভাবে একটি বইকে ফেসবুক, চলচ্ছিত্র ও কম্পিউটার গেমস'এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছে এই প্রকল্প।

ফ্রাঙ্কফুর্টের মেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের হিসাবে গত দশ বছর ধরে বইয়ের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল থাকার পর গত বছর এই প্রথম বিক্রি কিছুটা কমে গেছে। এখনো মানুষ দোকানে গিয়ে বই কিনছেন বটে, কিন্তু জার্মানিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বই কেনার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। ফলে অনেক প্রকাশনা সংস্থা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ছাপা বইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ‘ই-বুক'এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। অন্যদিকে অনেক লেখক প্রকাশনা সংস্থার দ্বারস্থ না হয়ে সরাসরি ইন্টারনেটেই নিজেদের রচনা প্রকাশ করছেন। ‘সেল্ফ পাবলিশিং'এর প্রবণতা বেড়ে চলেছে। জার্মানিতে অবশ্য বইয়ের দোকানের সংখ্যা কমে চলেছে। অন্যদিকে অ্যামাজন সহ অন্যান্য ইন্টারনেট-ভিত্তিক সংস্থার রমরমা বেড়ে চলেছে। জার্মানির বড় বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোরে যে বইয়ের দোকান দেখা যায়, সেগুলির অস্তিত্বও সংকটের মুখে। নানা ধরণের ইলেকট্রনিক বইয়ের বাজার ফুলে ফেঁপে উঠছে।
এদিকে করোনাকালে ডিজিটাল বই মেলা নিয়ে পিছিয়ে ছিলেন না বাংলাদেশীরাও। তারাও করে দেখিয়েছেন কেমনে ভার্চুয়াল বই মেলা করা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশর্তবার্ষিকী উপলক্ষে নিউইয়র্কে ১৮ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর ১০ দিনব্যাপী ভার্চুয়াল বাংলা বইমেলার আয়োজন করা হয়। মেলার নাম ‘নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলা–২০২০’ আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ। ‘যত বই তত প্রাণ’ স্লোগান নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত বইমেলার ২৯ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। সেখানে প্রতিদিনের অনুষ্ঠান দেখা যায় নিউইয়র্ক বইমেলার ওয়েবসাইট, ফেসবুক, ইউটিউব চ্যানেল ও সরাসরি টেলিভিশনে। এ ছাড়া পৃথিবীর সব দেশ থেকেই বই কেনার ব্যবস্থা থাকে ওই মেলা থেকে।

বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার বাইরের বাংলা বইয়ের এটি সর্ববৃহৎ বইমেলা। এটি ২৯ বছর ধরে চলে আসছে। এ বছর আয়োজিত ১০ দিনব্যাপী এই মেলার উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতর্পণ, জাতির জনকের প্রতি নিবেদিত কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি এবং বঙ্গবন্ধুর স্মরণে বিশেষ কনসার্ট। আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী, প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ, বাংলা একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খান, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক ও কবি কামাল চৌধুরী।

স্বরচিত কবিতা পড়েন কবি আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, হাবিবুল্লাহ সিরাজী, মোহাম্মদ নূরুল হুদা ও আরও অনেকে। আরও থাকবেন উভয় বাংলার সেরা আবৃত্তিকারেরা। উভয় বাংলার যেসব লেখক এই মেলায় অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সেলিনা হোসেন ও আনিসুল হক। উত্তর আমেরিকা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত আরও প্রায় ১০০ কবি ও লেখক।
এদিকে বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির অমর একুশের বই মেলা প্রথমে শোনা গিয়েছিল করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এবার স্থগিত হচ্ছে। পরে আবার শোনা যায় বইমেলা স্থগিত হলেও ১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হবে। পরে করোনাকালে ২০২১ সালের বই মেলা ডিজিটাল পদ্ধতি নাকি আগের মতই অ্যাকচুয়াল পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে শুরু হয় হৈ চৈ। একাডেমি এবং বই লেখক ও বই প্রকাশকদের মধ্যে শুরু হয় চিঠি চালাচালি। আলোচনা সমালোচনা। দোষাদোষী। অবশেষে অ্যাকচুয়াল বই মেলার সিদ্ধান্ত হয়। তবে এবার করোনাকালে যেটা হতে পারতো সেটা হলো এই সুযোগে ভার্চুয়ালি বইমেলার মধ্যে দিয়ে আমরা প্রকশনাগুলোর সক্ষমতাও দেখে নেওয়া ডেত। প্রকশনাগুলো তাদের প্রকাশনা বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে পারতো।

আর ডিজিটালি এই বইমেলা যে একেবারেই নতুন বিষয়, তা কিন্তু নয়। এর আগে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বইমেলা জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলাকেও নির্ধারিত সময় অক্টোবরেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে হয়েছে। ফ্রাঙ্কফু্র্েটর বইমেলা কিন্তু নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এই বইমেলা যে শুধু বই বিক্রির জন্য বিখ্যাত তা কিন্তু নয়, এখানে বই প্রকাশনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রকাশনা আইন, লাইসেন্স ফি এবং ট্রেডিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও করে থাকে। তারপরেও তারা এই আয়োজনকে ডিজিটালাইজ করেছে। সুতরাং এটাও আমাদের জন্য একটা বড় উদাহরণ।

মূল বিষয়টা হলো, পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে পুরো পৃথিবীকেই ভার্চুয়ালি অনেক কিছু করতে হয়েছে, আগামীতেও হয়তো করতে হবে। সেক্ষেত্রে বইমেলার মতো এত বড় একটা আয়োজন যদি একবার ভার্চয়ালি করা হয়েই যায়, তাহলে এগিয়েই থাকা যায় আরো একটা বিষয় খেয়াল করার মতো- রকমারি.কম, বাতিঘর, বইবাজার, বাংলা বই এবং বই পাঠাইসহ হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠানের ভার্চুয়ালি বই বিক্রি করছেন বেশ কিছুদিন ধরেই। বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে গুটি কয়েক অনলাইন বুক কিন্তু যথেষ্ট নয়? প্রতিটি প্রকাশনারই অনলাইনে বই বিক্রির সক্ষমতা থাকা জরুরি বৈকি। সেক্ষেত্রেও ভার্চুয়ালি বইমেলার আয়োজন একটা ভালো অনুষঙ্গ হতে পারে। বইপ্রেমীদের আশা, প্রতিবছর অ্যাকচুয়াল্লি বইমেলার আয়োজন হবে। কেননা, সামনাসামনি লেখক, পাঠক আর প্রকাশকের যে যোগাযোগ এই মেলায় হয়, তার বিকল্প কোনোভাবেই ভার্চুয়ালি বইমেলা না।

https://dailysangram.com/post/439421