৪ জানুয়ারি ২০২১, সোমবার, ১২:১৩

শুল্ক ফাঁকিতে কয়লা পাথর আমদানি

সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার ১৩টি স্থল শুল্ক স্টেশনের মধ্যে ১২টিতেই নেই ওজন পরিমাপের কোনো যন্ত্র। আর এর সুযোগ নিচ্ছে স্থানীয় কয়লা ও পাথর আমদানিকারকদের একটি বড় সিন্ডিকেট। অতিরিক্ত কয়লা ও পাথরবোঝাই ট্রাক শুল্ক স্টেশন দিয়ে বাংলাদেশের ভেতর প্রবেশ করলেও দিতে হচ্ছে না বাড়তি কোনো শুল্ক। প্রতিদিন ব্যাংকে এলসিতে উল্লেখের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ কয়লা ও পাথর নিয়ে আসা হচ্ছে। আমদানি করা অর্ধেকের বেশি কয়লা ও পাথর শুল্ক না দিয়ে প্রবেশ করায় সরকার বছরে হারাচ্ছে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব।

কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এলসিকৃত কয়লা ও পাথর আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ট্রাকে ১২ টন আনার অনুমোদন থাকলেও সিলেটের ভোলাগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের তাহেরপুর বড়ছড়া, বাগলী ও চারাগাঁও শুল্ক স্টেশন দিয়ে পার হচ্ছে প্রতি ট্রাকে ১৮ থেকে ২২ টন পর্যন্ত। এ বাবদ নেওয়া হচ্ছে না অতিরিক্ত শুল্ক। অভিযোগ আছে, এ ব্যাপারে আমদানিকারকদের সঙ্গে বোঝাপড়া আছে শুল্ক স্টেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর।

গত ২২ ডিসেম্বর সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে চারাগাঁও ও বড়ছড়ি শুল্ক স্টেশন দিয়ে প্রতিটি ট্রাকই অতিরিক্ত কয়লা ও পাথর নিয়ে বাংলাদেশে আসছে। স্টেশনে পরিমাপের কোনো বালাই নেই। ভারত থেকে আসা ট্রাকের স্লিপ দেখেই প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, করোনা মহামারি ও ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে দীর্ঘদিন কয়লা আমদানি বন্ধ থাকার পর তিন মাস ধরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর স্টেশন দিয়ে কয়লা, সঙ্গে পাথরও আমদানি হচ্ছে। বড়ছড়া শুল্ক স্টেশনের অধীনেই চারাগাঁও ও বাগলী শুল্ক স্টেশন। এই তিন সীমান্ত পথ দিয়ে প্রতিদিন কয়লা আমদানি হচ্ছে তিন শ থেকে সাড়ে তিন শ ট্রাক। গড়ে একটি ট্রাকে ২০ টন কয়লা আমদানি হলে দিনে আসছে প্রায় সাত হাজার টন। এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার টন কয়লাই শুল্ক ফাঁকি দিয়ে প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। এই শুভংকরের ফাঁকির ‘সুবিধা’ ভোগ করছেন অসাধু কয়লা আমদানিকারক আর শুল্ক স্টেশনের অসাধু কর্মকর্তারা।

তবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কয়লা প্রবেশের অভিযোগ অস্বীকার করেন তাহিরপুরের বড়ছড়া কাস্টমস সুপারিনটেনডেন্ট সুদীপ্ত কুমার দাস। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বড়ছড়া এলসি স্টেশনে ওজন পরিমাপের কোনো যন্ত্র না থাকলেও কেউ অতিরিক্ত পাথর কিংবা কয়লা আনতে পারছে না। প্রতিটি ট্রাকেই ফিতা দিয়ে মেপে পাথরের ওজন মাপা হয়।’

সিলেট বিভাগের ১৩টি শুল্ক স্টেশনের মধ্যে একমাত্র তামাবিল স্টেশনেই ওজন পরিমাপের যন্ত্রের দেখা মেলে। কিন্তু সেখানেও রয়েছে রাজস্ব লুটের বিশেষ ব্যবস্থা। প্রতিটি ট্রাক ওজন পরিমাপের স্কেলে ওঠানো হলেও ওজনের পরিমাপ খাতায় হাতে লিখে রাখা হচ্ছে। অটোমেশনের মাধ্যমে কম্পিউটার থেকে কাগজ বের করা হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, ট্রাকে অনেক বেশি পাথর এলেও গড়ে লেখা হয় ১২ টন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘এখানে অটোমেশন পদ্ধতি চালু হয়নি, হিসাব হাতে লিখে রাখা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ধরনের অনিয়ম হচ্ছে না। কেউ এলসির অতিরিক্ত পণ্য নিয়ে এলেই মামলা দেওয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত পাথর আমদানির কারণে তিন শতাধিক মামলা করা হয়েছে।’

২৩ ডিসেম্বর সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ শুল্ক স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, ভারত থেকে পাথরবোঝাই করে একের পর এক ট্রাক প্রবেশ করছে। ট্রাক এসে থামছে ভোলাগঞ্জ শুল্ক স্টেশনের নামমাত্র চেক পোস্টের সামনে। ট্রাক এলেই কিছু যুবক ট্রাকের দিকে ছুটে যাচ্ছে এবং ট্রাক থেকে একটি স্লিপ নিয়ে কাউন্টারে আসছে। দুইচালা টিনের ঘরের এক কোণে শুল্ক স্টেশনের সিপাহি মো. মনির হোসেন বসে সিল মেরে ট্রাক ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছেন। ট্রাকে কী পরিমাণ পাথর আছে সেটা কোনো পদ্ধতিতেই পরিমাপ করতে দেখা যায়নি। বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ৩৫টি পাথরবোঝাই ট্রাক এলেও কোনো ট্রাকেরই ওজন পরিমাপ করতে দেখা যায়নি। জানতে চাইলে মনির হোসেন বলেন, ‘আমাদের শুল্ক স্টেশনে কোনো যন্ত্র নেই, চোখের আন্দাজে মেপে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়।’

বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বড় স্যারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। পাশেই কাঁচাপাকা টিনশেডের আরেকটি ঘরে গিয়ে কথা হয় স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা আব্দুর রহিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শুধু আমার স্টেশনে নয়, সিলেটের বেশির ভাগ স্টেশনেই ওজন পরিমাপের যন্ত্র নেই। ফিতা দিয়ে সিএফটি মেপে কিংবা চোখের আন্দাজেও ট্রাক পার করতে হয়। আর দেখুন, ভারতের শুল্ক স্টেশনের চালানপত্র দেখে বোঝা যায়, ট্রাকে করে কত টন মালামাল আসছে।’

শুল্ক স্টেশন এবং কয়লা-পাথর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাসে গড়ে ১৮ হাজার ট্রাকবোঝাই কয়লা ও পাথর আমদানি হয়। সেই হিসাবে মাসে চার লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ টন কয়লা-পাথর আমদানি হওয়ার কথা। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসছে এর চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ। ভারতে এক টন কয়লার এলসি মূল্য ৭০ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ছয় হাজার ৯০ টাকা। কয়লা আমদানি করা হলে মূল্যের ২৫ শতাংশ রাজস্ব পায় সরকার। সেই হিসাবে এক টন কয়লায় সরকার রাজস্ব পায় এক হাজার ৭৩৪ টাকা। একজন আমদানিকারক আট ট্রাক অর্থাৎ ৯৬ টনের কম আমদানি করতে পারেন না। হিসাব কষে দেখা গেছে, এই পরিমাণ কয়লা আমদানি করতে রাজস্ব দিতে হয় ১৩ হাজার ৭৭২ টাকা। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট শুল্ক স্টেশনের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে ওই পরিমাণ রাজস্বে আটটি ট্রাকে ৯৬ টনের পরিবর্তে নিয়ে আসছেন ১৯০ থেকে ২০০ টনের বেশি কয়লা।

এ ছাড়া আমদানিকারকরা কয়লা আমদানি করতে গিয়ে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম দেখান শুল্ক ফাঁকি দিতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলসিতে মূল্য টনপ্রতি ৭০ ডলার দেখানো হলেও কয়লার প্রকৃত মূল্য ১১০ ডলার থেকে ১২০ ডলার। এলসির বাইরে ওই অতিরিক্ত মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে মেটানোর অভিযোগ রয়েছে আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে। মূল্য কম দেখানোর কারণে সরকার এখানেও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

একটি স্টেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, অতিরিক্ত কয়লার ওজনের বিষয়ে কথা বললে ব্যবসায়ীরা মারমুখী হয়ে ওঠেন। অনেক সময় ছোট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া সম্ভব হলেও সিন্ডিকেটের বড় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দিতে গেলে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়।’

সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের তিনটি স্টেশনের দায়িত্বে আছেন কাস্টম কর্মকর্তা সুদীপ্ত শেখর দাস। এলসির চেয়ে বেশি পরিমাণে কয়লা নিয়ে আসার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেখুন ওজন পরিমাপের যন্ত্র না থাকলে তো কিছু বেশি নিয়ে এলে কী করব? আর এই তিনটি এলসি স্টেশন খুবই দুর্গম এলাকায়, কোনো কিছু বলাটাও খুবই কঠিন।’ সিলেটের অন্য বেশ কয়েকটি এলসি স্টেশনে অতিরিক্ত বহনের কারণে মামলা হলেও আপনার স্টেশনে কোনো মামলা নেই কেন জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

বড়ছড়া শুল্ক স্টেশন দিয়ে কয়লা ও পাথর আমদানি করেন রিপন ট্রেডার্সের মালিক মনমোহন পাল মতিশ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বড়ছড়া দিয়ে ৮০ থেকে ৯০ ট্রাক কয়লা প্রতিদিন আমদানি হলেও বেশি কয়লা আসছে চারাগাঁও এলসি স্টেশন দিয়ে। সেখান দিয়ে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক আসছে। তবে বাগলী এলসি স্টেশন দিয়ে শুধু চুনাপাথর বাংলাদেশে আসছে। আমি সর্বশেষ ১০০০ থেকে ১২০০ টন কয়লা এনেছিলাম, কিন্তু বড়দিনের কারণে আপাতত বন্ধ আছে। তবে শুল্ক না দিয়ে কোনো কয়লা আমি আনছি না।’ আর উজ্জ্বল ট্রেড লিংকের মালিক চন্দন সাহা বলেন, ডিসেম্বর মাসে ভারত থেকে আট হাজার টন কয়লা আমদানি করেছিলাম, টনপ্রতি ৭০ ডলারে এলসি করে আমদানি করেছি। এলসির পরিমাণের চেয়ে বেশি কয়লা অন্য কেউ আনছে কি না জানি না, তবে আমি এটা করি না। আনিসুল হক এন্টারপ্রাইজের মালিক আনিসুল হক বলেন, ‘ভারত থেকে ৭০ ডলারে এলসি করে এবং সরকারকে শুল্ক দিয়ে কয়লা এনে দেশের বাজারে বিক্রি করতে হয় আট হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৯ হাজার টাকায়। এলসির বাইরে কয়লা কিছু বেশি এলেও সরকার আমাদের কাছ থেকে টাকা কেটে নেয়। দ্বিগুণ পরিমাণ কয়লা আসার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/01/04/991881