৪ জানুয়ারি ২০২১, সোমবার, ১২:১২

ঘনীভূত সামাজিক সঙ্কট

ডাটাবেজ নেই বৈবাহিক তথ্যের তথ্য গোপন করে একাধিক বিয়ে বাড়ছে হত্যা, আত্মহত্যা ও ফৌজদারি অপরাধ

সনাতন ধর্মের মেয়ে যশোরের অনিন্দিতা। ভালোবেসে বিয়ে করেন ইন্স্যুরেন্স কর্মকর্তা জামাল উদ্দিনকে। ৩ মাসের প্রেম। অতঃপর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং বিয়ে। বিষয়টি গোপন রাখেন নিজ পরিবারের কাছে। বিয়ের পর এফিডেভিটের মাধ্যমে নাম ধারণ করেন ‘আনোয়ারা বেগম’। এ নামে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি করেন। এর ভিত্তিতে গ্রহণ করেন পাসপোর্টও। সেই পাসপোর্টে স্বামী হিসেবে উল্লেখ করা হয় জামাল উদ্দিনের নাম। আনোয়ারা-জামাল উদ্দিন হানিমুন করেন থাইল্যান্ডে। ৬ মাস পর অনিন্দিতা জানতে পারেন জামালের স্ত্রী-দুই সন্তান রয়েছে। বরিশাল মুলাদীতে গ্রামের বাড়িতে তাদের বসবাস। অনিন্দিতা সেখানে গিয়ে ওঠেন। জামালের আগের স্ত্রী তাকে মারধর করেন। স্থানীয় বিচার-সালিশ ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি অনিন্দিতার। চরম পারিবারিক অশান্তির প্রেক্ষাপটে জামাল তাকে তালাক দেয়। ততদিনে আনোয়ারা বেগম (অনিন্দিতা) ২ মাসের অন্তঃস্বত্তা। নিজ পরিবারেও ফেরার পথ নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন, দেশ ছাড়ার। কিন্তু বিপত্তি বাধে পাসপোর্ট। আঞ্চলিক কার্যালয়ে গিয়ে জানতে পারেন-পাসপোর্ট সংশোধনের শর্টকাট কোনো উপায় নেই। ভেস্তে যায় তার দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচার পরিকল্পনা। ব্যক্তিগত গভীর সামাজিক সঙ্কটে নিপতিত অনিন্দিতা অবশেষে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।

এক পাসপোর্ট কর্মকর্তার উদ্ধৃত ঘটনাটি বছর দুই আগের। কিন্তু চট করে প্রেমে পড়ে যাওয়া, হুট করে বিয়ে এবং পরবর্তীতে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে ইদানিং হরহামেশাই। মোবাইল ফোন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দূরের মানুষ ‘আপন’ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আগ-পর না ভেবে সেটি গড়াচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্কে। বিবাহ-পরবর্তীতে, এমনকি বেশ কিছুদিন সংসার করার পর দম্পতি জানতে পারছেন পারস্পরিক নানা তথ্য। তাতে দেখা যাচ্ছে, হয় স্বামী ইতঃপূর্বে একটি কিংবা একাধিক বিয়ে করেছেন, সন্তানাদি আছে। না হয় স্ত্রী হয়েছেন তালাকপ্রাপ্তা। কিন্তু ততক্ষণে কিছুই করার থাকে না। ‘আপন’ মানুষটি ততোধিক দ্রুত গতিতে ‘পর’ হয়ে যায়। দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। ঘটনা তখন শুধু বিচ্ছেদ আর তালাকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। সৃষ্টি করছে বহুমুখি পারিবারিক, সামাজিক সঙ্কট। যা মামলা-মোকদ্দমা, হত্যা এবং এমনকি আত্মহত্যা পর্যন্ত গড়ায়। দীর্ঘ সময় এর ঘানি টানতে হয় সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্য এবং সমাজকে। তথ্য গোপন করে প্রতারণামূলকভাবে বিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে অহরহ। এটি পরিবারকে বাদ দিয়ে নিজে নিজে বিয়ে করার ক্ষেত্রে যেমন ঘটছে, তেমনি ঘটছে পারিবারিকভাবে সম্পাদিত বিয়ের ক্ষেত্রেও। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বর-কনের ব্যক্তিগত তথ্য গোপন, ছলনা, শঠতা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়ার ফলে ঘটছে এমনটি। এছাড়া বাস্তবতার চেয়ে আবেগকে গুরুত্ব প্রদান, বিয়ের মতো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পরিবারকে সম্পৃক্ত না করাও বিবাহ-পরবর্তী প্রতারণার শিকার হওয়ার অন্যতম কারণ।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. বাবরুল আমীনের মতে, ক্রমবর্ধিষ্ণু এ সঙ্কটের দায় শুধু মানুষের ব্যক্তিগত নয়। দায় রয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনারও। প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সরকার তথা রাষ্ট্র কি ভূমিকা নিচ্ছে? বিদ্যমান আইন বিবাহ সংক্রান্ত প্রতারণা রোধে যথেষ্ট কি-না?

আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়- ১৯৬১ সালে নিকাহ নিবন্ধন প্রথা চালু হয়। কিন্তু নিকাহ নিবন্ধন না করাকে শাস্তিযোগ্য করা হয় ১৯৭৪ সালে প্রণীত আইনে। বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রি না করলে ২ বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং ৩ হাজার টাকা জরিমানা রয়েছে। ৪৭ বছরের পুরনো এ আইনের আওতায় চলছে নিকাহ ও তালাক নিবন্ধন। প্রতিটি নিবন্ধন থেকে সরকার নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব পেয়ে থাকে। অথচ বিদ্যমান আইন বিবাহ সংক্রান্ত প্রতারণা রোধ করতে পারছে না। বরং দুর্বল আইনের সুযোগে নিকাহ নিবন্ধনে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে নৈরাজ্য। এখনও নিকাহ রেজিস্ট্রার কিংবা কাজীদের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়নি। সারা দেশে রয়েছে ভুয়া কাজীর ছড়াছড়ি। যারা তথ্য গোপন করে প্রতারণামূলকভাবে বিয়ে করেন তারা বেশিরভাগই ভুয়া কাজীদের শরণাপন্ন হন। ভুয়া কাজীগণ অর্থের বিনিময়ে চাহিদানুগ বিবাহের সনদ দিয়ে থাকেন। তাদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত: ডিজিটাল যুগেও নিকাহ রেজিস্ট্রির এই সেবা খাতটি রয়ে গেছে অ্যানালগ যুগে। ভুয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতে অনেকেই নিজেকে ‘বৈধ কাজী’ দাবি করছেন। ফলে সারা দেশে কতজন সরকার নিযুক্ত বৈধ কাজী নিযুক্ত রয়েছে জানা নেই খোদ মন্ত্রণালয়েরই। দীর্ঘ দিন জিইয়ে রাখা এ নৈরাজ্য নিরসনে কার্যকর উদ্যোগও দেখা যায় না।

সূত্রমতে, ফাঁক-ফোঁকর রয়েছে ‘নিকাহনামা’য়ও। ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ এর বিধি ২৮(১)(ক) অনুযায়ী মুদ্রিত ‘নিকাহনামা’য় বর-কনের নানা ধরনের তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে ৫ নম্বরে কনে কুমারী, বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত নারী কি-না উল্লেখ করতে হয়। ২১ নম্বরে বরের কোনো স্ত্রী বর্তমানে আছে কি-না এবং থাকলে অন্য বিবাহ আবদ্ধ হইবার জন্য বর ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ’ মোতাবেক সালিসী কাউন্সিলের অনুমতি নিয়েছেন কি-না উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু এসব তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। কনে তালাকপ্রাপ্ত হলে কিংবা বরের বর্তমান কোনো স্ত্রী থাকলেও সেটি গোপন রেখে বিবাহের কাবিন সম্পাদন করা হয়। এই গোপনের শাস্তিও অত্যন্ত গৌণ। বর্তমান স্ত্রী ও সালিসী পরিষদের অনুমতি ছাড়া বিয়ের অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হলে ১ বছর কারাদন্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু অনুমতিবিহীন দ্বিতীয় বা পুনরায় বিয়েটি ‘অবৈধ’ গণ্য হবে না। বরং দ্বিতীয় বিয়ের কারণে প্রথম স্ত্রী আদালতে স্বামীর বিরুদ্ধে বিয়ে বিচ্ছেদ চাইতে পারবেন। অন্য দিকে কনের দেয়া ৫ নম্বর তথ্যটি মিথ্যা প্রমাণিত হলে কি শাস্তি হবে সুস্পষ্ট নয়।

অভিজ্ঞ নিকাহ রেজিস্ট্রারগণ জানান, বর্তমান নিকাহ নিবন্ধন আইন বিবাহ সংক্রান্ত প্রতারণা রোধ করতে পারছে না। কাজীগণ বর-কনের মিথ্যা তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। তথ্য যাচাইয়ের আধুনিক কোনো পদ্ধতি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিকাহ রেজিস্ট্রারদের হাতে নেই। ‘বাংলাদেশ কাজী সমিতি’র একাংশের মহাসচিব কাজী আব্দুল হাই তালুকদার বলেন, নিকাহ রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে দু-একটি তথ্য নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হচ্ছে। যেমন, বর-কনে প্রাপ্তবয়ষ্ক কি-না এটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য উভয়ের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), পাসপোর্ট কিংবা শিক্ষাগত সনদের ফটোকপি নেয়া হয়। কিন্তু এটি আসল না নকল তা যাচাই করার কারিগরি সক্ষমতা অধিকাংশ নিকাহ রেজিস্ট্রারেরই নেই। অথচ বাল্য বিবাহ নিবন্ধনের রেজিস্ট্রির অভিযোগে মামলা হলে কারাভোগ করতে হয় নিকাহ রেজিস্ট্রারদের।

প্রায় অভিন্ন অভিমত তুলে ধরে ‘বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতি’র মহাসচিব কাজী ইকবাল হোসেন বলেন কিন্তু বরের বর্তমান কোনো স্ত্রী রয়েছে কি-না কিংবা কনে তালাকপ্রাপ্তা কি না এটি নিশ্চিত হওয়ার কোনো ‘অপশন’ নেই। বৈবাহিক তথ্যের ডাটাবেজ থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে এটি নিশ্চিত হওয়া যেত। এ সংক্রান্ত দাম্পত্য সঙ্কট এত ঘনীভ‚ত হতো না। বিষয়টি অনুধান করে ইতিমধ্যেই আমরা ডাটাবেজ প্রণয়নের দাবি তুলেছি। কাজীদের এ বিষয়ক প্রশিক্ষণেরও দাবি তোলা হয়েছে। এতে নিকাহ রেজিস্ট্রারগণও নানাবিধ হয়রানি থেকে রেহাই পাবেন।
এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারোয়ার ইনকিলাবকে বলেন, এ বিষয়ে বেসরকারি সংস্থাসহ বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে নিকাহ সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণে ডাটাবেজ প্রণয়নের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/347654/