৪ জানুয়ারি ২০২১, সোমবার, ১২:১১

‘নিউ নরমাল’ বা নতুন স্বাভাবিককালে সম্ভাব্য পরিবর্তন

এম এ খালেক : বিশ্বব্যাপী দ্রুত সংক্রমণশীল প্রণাঘাতী করোনা ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ যেনো কমছেনই না। শীতকালে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞগণ আগেই সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু সেই দ্বিতীয় ঢেউ যে এতটা ভয়াবহ আকার ধারন করবে তা সম্ভবত কেউই বিশ্বাস করতে পারেন নি। বিশেষ করে ইউরোপীয় অঞ্চলের শীত প্রধান দেশগুলোতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে চলেছে। কোনো কোনো দেশ করোনার প্রভাব মোকাবেলায় নতুন করে ‘লক ডাউন’ ঘোষণা করছে। এছাড়া অন্যান্য উপায়ে এই সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য চেষ্টা করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে বিশ্ববাসী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে মুক্তি পাবে না। এই ভাইরাসের সংক্রমণ কতদিন চলবে তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। অনেকেই বলছেন, আগামীতে কখনোই করোনা ভাইরাস থেকে পৃথিবীবাসী পুরোপুরি মুক্ত হতে পারবে না। অর্থাৎ আগামীতে আমাদের করোনা ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই বসবাস করতে হবে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুধু যে মানবিক এবং আর্থিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলেছে তা নয় এর অন্যান্য প্রভাবও কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। যদিও বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের জন বিপর্যয় এবং আর্থিক ক্ষতির প্রভাব নিয়ে এতটাই আলোচনা হচ্ছে যে অন্যান্য ক্ষেত্রে এর সম্ভাব্য প্রভাব উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। করোনা ভাইরাস মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মারাত্মক সঙ্কট সৃষ্টি করে চলেছে। এই সঙ্কটের কিছু আছে যা আগামীতে আমাদের জীবন যাত্রাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে পারে। বিশ্বের কয়েকটি দেশের বেশ কিছু কোম্পানি করোনা ভাইরাসের টিকা আবিস্কার করেছে। তারা দাবি করছেন, এই টিকা ৯৩ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর। এই টিকা আবিষ্কারের বিষয়টি এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে মনে হতে পারে এই টিকা বাজারে এলে করোনা নামক প্রাণঘাতি ভাইরাস ভয়ে পালবার পথ পাবে না। কিন্তু বিষয়টি আসলে তেমন কিছু নয়। এই টিকা গ্রহণের পরও যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই টিকা নিয়ে খুব একটা উল্লসিত হবার কিছু নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রচার বিশারদগণ এমনভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন যেনো করোনার টিকা ‘সর্ব রোগ সংহারক বটিকা বিশেষ।’ টিকা বাজারে এলে আর কোনো চিন্তা নেই। তাদের এই অতিমাত্রায় আস্থাশীল প্রচারণার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। কারণ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কোনো সুযোগ পেলেই তাদের পণ্য দরিদ্র দেশে বাজারজাত করে অর্থ লুটে নেয়। করোনার টিকা নিয়ে অতি মাত্রায় প্রচারণা তেমনই একটি কৌশল হতে পারে। এখন আমাদের এই নতুন উদ্ভাবিত টিকার বিষয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। মানুষের দুর্ভোগ বা সঙ্কটকে পুঁজি করে ফায়দা হাসিল করার সুযোগ সন্ধানীদের কোনো অভাব নেই। এরা সুযোগ বুঝে কর্ম সম্পাদন করে। করোনার টিকা সম্পর্কে যতই প্রচারণা চালানো হোক না কেনো এটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে যে করোনার সংক্রমণ থেকে বিশ্ববাসী সহসাই মুক্তি পাচ্ছে না। বরং ভবিষ্যতে করোনার সংক্রমণ আরো ভয়াবহ আকারে বিস্তার লাভ করতে পারে। আগামীতে যেহেতু খুব সহসাই করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না তাই নতুন স্বাভাবিক বা নিউ নরমাল অবস্থায় কিভাবে চলতে হবে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। করোনা প্রভাব আরো কয়েক বছর অব্যাহত থাকলে বিশ্বব্যাপী সামাজিক এবং আচরণগত ক্ষেত্রে কি কি পরিবর্তন সাধিত হতে পারে তা সে সম্পর্কে আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। করোনা ভাইরাস আগামীতে খুব সহসাই পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে না এটা বিবেচনায় রেখে আমরা নতুন স্বাভাবিক বা নিউ নরমালকালিন সময়ের আচরণ নির্ধারণ করতে পারি।

করোনাকালীন সময়ে বিশ্বেও বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এব স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনিতেই আমাদের মতো দেশের শিক্ষা খাতে আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম। তার উপর করোনার প্রভাবে আর্থিক বরাদ্দ আগামীতে আরো কমে যেতে পারে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী উৎপাদনের অধিকাংশ সেক্টর খুলে দেয়া হলেও করোনার সংক্রমণের আশঙ্কায় স্কুল-কলেজ তথা শিক্ষাঙ্গনগুলো কার্যত বন্ধই রয়েছে। বিকল্প পন্থা হিসেবে অন লাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু অন লাইন শিক্ষা ব্যবস্থা কখনোই ট্রেডিশনাল শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না। বাংলাদেশের কথাই বিবেচনা করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, একটি দেশের শিক্ষা খাতে কম করে হলেও মোট জিডিপি’র ৬শতাংশ বরাদ্দ থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপি’র ২ শতাংশ বা তারও কম। বাংলাদেশ তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু তারপরও অন লাইনে সবাই শিক্ষার সমান সুযোগ পাচ্ছে না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা অন লাইন শিক্ষা কার্যক্রম থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে। আগামীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে অন লাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকবে না। কিন্তু সেই অবস্থায় শিক্ষার গুনগত মান আরো নিম্মমুখি হতে বাধ্য। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে শিক্ষার্থীর পাশের হার বেড়েছে কিন্তু গুনগত মান কি সেই মাত্রায় উন্নত হয়েছে? একজন শিক্ষাবিদও সম্ভবত নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবেন না যে আমাদের দেশের শিক্ষার গুনগত মান আগের তুলনায় উন্নয়ত হয়েছে। অনেকে এমন অভিযোগও করেন যে, বাংলাদেশের মানুষ যাতে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করতে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, ভালো রেজাল্ট করে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করার পরও একজন প্রার্থী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের প্রায় সবাই বাংলাদেশি। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ে যারা কর্মরত তাদের অনেকেই বিদেশি।

করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশের ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। অবশ্য ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ গত প্রায় ১০ দশক ধরেই মন্থর ছিল। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপি’র ২২/২৩ শতাংশে উঠানামা করছিল। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল এবং দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির জন্য ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার অন্তত ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন ছিল। করোনার কারণে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ সংঘাতিকভাবে কমে গেছে। শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচমাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি হ্রাস পেয়েছে ব্যাপকভাবে। সরকার করোনাকালিন সময়ের জন্য শিল্প খাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ প্রণোদনা দিয়েছেন। এই ঋণ প্রণোদনার প্রায় পুরোটাই তারা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তারপরও বেশির ভাগ কারখানা মালিক তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী ছাঁটাই করেছেন। চাকরিচ্যুৎ কর্মীরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। আগামীতে কারখানা মালিকগণ উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য প্রযুক্তি নির্ভরতার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়লে কারখানায় সাধারণ শ্রমিকের চাকরি হারানোর ভয় আরো বেড়ে যাবে। আগামীতে অভ্যন্তরীণ ভোগ চাহিদা সাংঘাতিকভাবে কমে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ সাধারণ মানুষের ভোগ সামর্থ্য বাড়ছে না। এই অবস্থায় তারা চাইলেও বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে পারবে না। অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য কমে গেলে তা দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় নিশ্চিতভাবেই প্রভাব ফেলবে। করোনাকালিন সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন (৪ হাজার ২০০ কোটি) মার্কিন ডলার অতিক্রম করে গেছে। এটা নিয়ে আমরা উল্লাস প্রকাশ করছি। কিন্তু বিনিয়োগবিহীন স্ফীত রিজার্ভ সব সময় ভালো নাও হতে পারে। রিজার্ভ স্ফীত হবার পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে রেমিটেন্স প্রবাহের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখি প্রবণতা। রেমিটেন্স বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কর্মচ্যুৎ হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। দেশে প্রত্যাবর্তনের কারণে তারা বিদেশে তাদের সঞ্চিত অর্থ একযোগে দেশে নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া করোনার কারণে স্থানীয় বেনিফিশিয়ারিদের আর্থিক চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আগের তুলনায় বেশি অর্থ প্রেরণ করেছে। এ পর্যন্ত সরকারি হিসাব মোতাবেক ৩ লাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি স্বদেশে ফিরে এসেছে। যারা দেশে ফিরে এসেছে তাদের পুনরায় পুনরায় বিদেশে কর্মসংস্থান অথবা স্থানীয়ভাবে পুনর্বাসনের জন্য কোনো উদ্যোগ কি আমরা গ্রহণ করেছি? করোনাকালিন সময়ে অর্থনৈতিক পুনর্বাসনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাগণ বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন। কিন্তু এদের জন্য যে ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনামূলক ব্যাংক ঋণ বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তার অর্ধেকও এখনো বিতরণ করা সম্ভব হয় নি।
ব্যাংকগুলো বড় উদ্যোক্তাদের ঋণদানের ক্ষেত্রে যতটা উৎসাহি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে তা নয়। আমার ‘তেলা মাথায় তেল দিতে’ বেশি আগ্রহী।

আগামীতে আমাদের সামাজিক আচার-আচরণ এবং রীতি-নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিভিন্ন মিটিং মিছিল করতে অভ্যস্থ। আগামীতে এটা নাও থাকতে পারে। আগামীতে সরাসরি কোনো মিটিং মিছিলের পরিবর্তে অন লাইনে মিটিং মিছিল হতে পারে। সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন, বিয়ের অনুষ্ঠান, বৌভাত, জন্ম দিন ইত্যাদি পালন করার পদ্ধতি এবং রীতি পরিবর্তিত হতে পারে। সামাজিক ভাবে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়ানোর কালচারও অনেকটাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। করোনা যদি আগামীতেও অব্যাহতভাবে সংক্রমিত হতে থাকে তাহলে হ্যান্ডশেক এবং কোলাকুলির মতো সামাজিক প্রথাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সব খারাপেরই কিছু ভালো দিকও থাকে। করোনাকালেও বিষয়টি আমরা প্রত্যক্ষ করছি। করোনার কারণে মানুষের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এর কারণে প্রকৃতি এবং জীব জগতের উপকার হয়েছে। করোনার কারণে মানুষ আগের মতো নির্বিচারে প্রকৃতি এবং জীবযন্তু ধ্বংস করতে পারছে না। এই সুযোগে প্রকৃতি আবারো সজীব হয়ে উঠেছে। বিরল প্রায় পশু-পাখিও নিরুপদ্রব পরিবেশে তাদের বংশ বিস্তার করতে পারছে। বর্তমানে আমরা যে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা প্রত্যক্ষ করছি আগামীতে তা আর থাকবে না। পানিতে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ এই নিয়ে আমাদের প্রকৃতি আবারো নব সাজে সজ্জিত ও পুষ্পিত হয়ে উঠবে। আগামীতে মানুষের কারণে প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা অনেকটাই হ্রাস পাবে। বাঙ্গালিরা আড্ডা প্রিয় জাতি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আগামীতে এই আড্ডায় কিছুটা হলেও ছেদ পড়বে। এতদিন আমরা যেসব আচার-আচরণে অভ্যস্ত ছিলাম তার অনেকগুলোই আগামীতে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। তবে এই সম্ভাব্য পরিবর্তন কতটা ইতিবাচক হবে আর কতটা নেতিবাচক হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

https://dailysangram.com/post/439454