৩ জানুয়ারি ২০২১, রবিবার, ২:৫৬

কী হতে যাচ্ছে সামনে?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরাজিত অবস্থার অবসান কবে হবে, কেউ জানে না। কতদিন আর চলবে এভাবে? অনেকেরই ধারণা ছিল, বিগত রমজানের পর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মতো অবস্থায় পৌঁছবে, কিন্তু রমজান, কোরবানি গেল, বছরও প্রায় শেষের দিকে; কিন্তু প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হচ্ছে না। লার্নিং লস থেকে শুরু করে মানসিক ও সামাজিক যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোর কোনো বিকল্প বা অর্থনৈতিক হিসাব করা বেশ কঠিনই বটে। ইউনেস্কোর রিপোর্ট বলছেÑ বাংলাদেশে প্রায় ৪০ মিলিয়ন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৭.৩৩ মিলিয়ন প্রাথমিক, ১৫.৮৬ মিলিয়ন মাধ্যমিক আর ৩.১৫ মিলিয়ন বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়া করে। তার মানে হচ্ছেÑ দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যাই শিক্ষার্থী। তারা করোনার এই দীর্ঘ বিরতিতে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আগামী দিনের দুশ্চিন্তায় ও মানসিক চাপে সুদিনের অপেক্ষার প্রহর গুনছে। একদিকে জীবনাশঙ্কা, অন্য দিকে পারিবারিক অসচ্ছলতা ও মানসিক অশান্তি তাদের জীবনকে সম্পূর্ণ নাজেহাল করে ফেলেছে।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের শিখনফল বিশেষ অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। ৩০ দিনের মধ্যে শেষ করা যায়, এমন সিলেবাস নির্ধারণ করা হয়েছে, যা শিগগিরই সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষকদের পাঠিয়ে দেয়া হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরা দ্রুত বিষয়গুলোর ওপর ফিডব্যাক পেয়ে যাবেন। সনাতন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের প্রধান অংশ ছিল বার্ষিক পরীক্ষা, ষান্মাসিক পরীক্ষা। ‘মূল্যায়ন’ বলতে আমরা এই প্রান্তিক পরীক্ষাই বুঝি। তারপর পাবলিক পরীক্ষা। সেটিও কিন্তু এক ধরনের প্রান্তিক পরীক্ষা; এককালীন পরীক্ষা, সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট। অ্যাসাইনমেন্ট বা বাড়ির কাজ বা নিজের ইচ্ছেমতো একটি বিষয়কে প্রকাশ করার যে রীতি, সেটি ইনফরমালই থেকে গেছে, কখনো ফরমাল পর্যায়ে আসেনি অন্তত দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে। বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে এর একটু আধটু চর্চা কোনো কোনো শিক্ষকের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, কোনো কোনো বিভাগে। গোটা বিশ^বিদ্যালয়ে ঢালাওভাবে এখনো প্রচলন হয়নি অ্যাসাইনমেন্ট প্রথার মাধ্যমে শিক্ষার্থী মূল্যায়নের। তাই এর গুরুত্ব এখনো প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ধারাবাহিক মূল্যায়নকে গুরুত্ব দেয়ার কথা প্রশিক্ষণে ও শিক্ষা প্রশাসনে বলা হয়; কিন্তু যৌক্তিক কিছু কারণে এটি সেভাবে চালু করা যায়নি কোনো পর্যায়ে। দু-একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো কোথাও কিছুটা করছে। কিন্তু অন্যত্র সেভাবে এর প্রচলন হয়নি। করোনাকালে এটি যেন আমাদের বাধ্য হয়েই করতে হচ্ছে। সরকার থেকে বলা হচ্ছে অটো প্রমোশন দিতে; বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যেভাবে বা যতটুকু পর্যবেক্ষণ করা হয় তার ওপর এখন ক্লাস টেস্ট কিংবা মাসিক পরীক্ষার স্কোরকে এ ক্ষেত্রে ধরে নিয়ে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশন দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এই অটো পাসের ফলে যারা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কাজের সাথে সেভাবে জড়িত ছিলেন না এবং যেসব প্রতিষ্ঠান এই দৌড়ে সবার পেছনে থাকত তাদের জন্য যেন ‘পোয়াবারো’ হয়েছে। শিক্ষাবিদদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন, যেখানে কল-কারখানা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খুলে দেয়া হয়েছে, সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় কেন? অন্তত অর্ধেক করে শিক্ষার্থী যদি ক্লাসে আসত তাহলে তাদের মধ্যে হতাশা ও মানসিক কষ্ট অনেকটাই কমে যেত। বিকল্প পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেয়া যেত বলে তারা মন্তব্য করেছেন।

এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির মেয়াদ আপাতত জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে খোলা যায় কি না, সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হয়েছিল; কিন্তু খোলা সম্ভব হয়নি। অনার্স ও কারিগরিতে শিক্ষার্থী কম থাকায় তাদের পরীক্ষা সরাসরি নেয়া যায় কি-না সেটি ভেবে দেখছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের কেউ দাবি করছেন অটো পাস; কেউ এর বিরোধিতাও করছেন; আবার কেউ বলছেন, বিগত তিন বছরের পরীক্ষার ফল গড় করে নম্বর দিয়ে তাদের ফল প্রকাশ করতে। পরীক্ষা ছাড়া জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের ফল প্রকাশ না করার কথা মন্ত্রী বলেছেন। আমরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। করোনাভাইরাসের সঙ্কটের মুখে দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বাতিল হয়েছে এইচএসসি ২০২০ সালের পরীক্ষা। সবাইকে অটো পাস দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রাথমিকের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা, মাধ্যমিকের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে না, সবাইকে অটো পাস দেয়া হয়েছে।

আগামী বছরের এসএসসি পরীক্ষা পেছাতে হবে বলে শিক্ষামন্ত্রী আশা মন্তব্য করেছেন। কারণ এসএসসি পরীক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছে। তারপরও যে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে তা বিশেষ পরিচর্যার মাধ্যমে পূরণের কথা বলা হয়েছে। তবে, শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হবে। তারা প্রাক-নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষা দিতে পারেনি এই স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা চিন্তা করেই।
অটো প্রমোশনের মাধ্যমে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাস কাটালেও ভর্তিপরীক্ষায় তো এমনটা করা যাচ্ছে না। কী হবে সেখানে? এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। আলোচনা চলছে, অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে, কিন্তু সেটি কী ধরনের ফল নিয়ে আসবেÑ কারণ নেটওয়ার্কিং ও ডিভাইসের যে অবস্থা, তাতে এটি কতটা সফল হবে? ডিজিটাল বিভাজন তো তাতে আরো প্রকটভাবে বেড়ে যাবে।

তবে, এই ধরনের জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও মানসিক সঙ্কটের মধ্যেও দেশে অমানবিক কার্যাবলি থেমে নেই। কোটি কোটি টাকা লুটেরা শ্রেণী লুট করে বিদেশে পাচার করছে, সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ চলছে, শক্তিশালীদের শক্তি প্রদর্শন চলছে রাস্তায়-হাটে, বাজারে-দোকানে, পরিবহনে, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ও কারণহীন ঊর্ধ্বগতি কেউ ফিরিয়ে রাখতে পারছে না। কারণ শক্তিশালী ও ক্ষমতাশালীরাই এর সাথে জড়িত। কী শিখছে আর কী দেখছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম? তারা তো এখন পড়াশোনা, বিদ্যালয়, কোচিং নিয়ে ব্যস্ত নেই। তাদের অস্থির মনে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সমাজের সব অনাচার, অবিচার, অমানবিকতা। এগুলো শিক্ষার্থীদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে এগুলোকে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে চলবে এসব প্রতিষ্ঠান। করোনাকাল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এক মহাসঙ্কট ডেকে এনেছে। যেখানে বিদ্যালয় শক্তিশালী তারা অভিভাবকদের বাধ্য করছে টিউশন ফি চাপ দিয়ে আদায় করতে, আবার যেখানে প্রতিষ্ঠান দুর্বল সেখানে অভিভাবকরা আন্দোলন করছেন, বিদ্যালয়কে চাপ দিচ্ছেন যাতে কোনো ধরনের ফি চাওয়া না হয়। এই অনড় ও পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংস ডেকে আনবে যা সামষ্টিকভাবে মানবিক বিপর্যয় ঘটাবে। তাই, সরকারের মধ্যস্থতায় একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে; ঘোষণা দিতে হবে যাতে উভয় পক্ষই বেঁচে থাকতে পারে। শিক্ষক, কর্মচারীরা যদি সাত-আট মাস বেতন না পান তাহলে তারা সংসার চালাবেন কিভাবে? একজন অভিভাবককে হয়তো ৩০০-৪০০ টাকা দিতে হবে, তাতে তাদের খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাদের চিন্তা করতে হবে যাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বেঁচে থাকে। দেশের বেসরকারি ব্যবস্থায়ই চলছে জাতির শিক্ষার বৃহত্তম অংশ।

এসব কিছুর বিবেচনায় বলা যায়, শিক্ষাব্যবস্থার চলছে করুণ দশা। সবই অনুমাননির্ভর, কেউ কিছু জানছে না, কী হতে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বুঝে উঠতে পারছে না, সামনের দিনগুলো তাদের জন্য কতটা শুভ। এ বছরটি তো গেল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অপেক্ষা আর মানসিক অশান্তির মধ্য দিয়ে। প্রতিনিয়ত আশঙ্কা, ভয় আর অনিশ্চয়তা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল শিক্ষার্থীদের জীবন। মানুষ আশা নিয়ে বেঁচে থাকে। আমরা সবাই শিক্ষাব্যবস্থার, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুদিনের অপেক্ষায় সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হ
লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
ইমেইল: masumbillah65@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/553204/