৩ জানুয়ারি ২০২১, রবিবার, ২:৫৬

করোনার টিকা : এ্যাস্ট্রাজেনেকা, ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো সমাচার

আসিফ আরসালান : লিখতে বসেছি ২০২১ সালের পহেলা নববর্ষে। ‘সংগ্রামের’ অগণিত পাঠক পাঠিকা ভাই বোনকে শুভ নববর্ষ। গতকাল (৩১ ডিসেম্বর শুক্রবার) সন্ধ্যে থেকেই আমার এলাকায়, অর্থাৎ কলাবাগান ধানমন্ডির বিভিন্ন স্থানে পটকা ফুটছিল। কোনোটার আওয়াজ মৃদু। আবার কোনোটার আওয়াজ বিকট। বাড়িতে বসেই শব্দ পাচ্ছিলাম। রাত ১২টা বাজার ৫ মিনিট অবশিষ্ট থাকতেই চারিদিকে শুরু হলো প্রচন্ড আওয়াজ। আমার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি, আকাশে ফুটছে আতশবাজি। হাউইয়ের মত আগুন ছুটছে উর্ধ্বাকাশে। তারপর সেখানে বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণের সময় আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। মনে হয়, অতিকায় বিশাল কদমফুল। এর চেয়ে আরো বড় আকারে হয় পশ্চিমা দেশগুলিতে। সেখানে বলা হয়, ‘ফায়ার ওয়ার্কস’। অতীতে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে আমি এই ফায়ার ওয়ার্কস বা আতশবাজি দেখেছি। ৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। ঐ দিন নিউইয়র্কে বড় আকারে ফায়ার ওয়ার্কস হয়। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি এবং ক্যানবেরাতেও আমি ফায়ার ওয়ার্কস দেখেছি ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২ টায়। গত বছর এ বছরের মত এত আতশবাজী বা ফায়ার ওয়ার্কস হয়েছিল কিনা, আমি জানিনা। কারণ আমি অস্ট্রেলিয়া ছিলাম। কিন্তু এবার যা দেখলাম, তাতে আমার ধারণা হলো যে এসব ব্যাপারে দ্রুত গতিতে আমরা পশ্চিমাদের অনুসরণ করছি। থার্টি ফার্স্ট নাইট বা নিউ ইয়ার্সকে এভাবেই, তবে এর চেয়ে বড় স্কেলে বরণ করে। আমরাও, যতই দিন যাচ্ছে, ততই উদ্যাপনের ডাইমেনশনটা বড় করছি। তাই বলে আমি এটি উদ্যাপনের পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলছি না। নিজের মনেই নিজেকে প্রশ্ন করেছি, সারা দেশ করোনা কবলিত। ইতোমধ্যেই হাজার হাজার মানুষ করোনার ভয়াবহ ছোবলে প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকেই চিকিৎসাধীন। রাজপথে বাজি ফোটানো এক কথা। ছোট ছোট, সরু অলিতে গলিতেও যখন বোমা বা গ্রেনেডের প্রচন্ড আওয়াজে মধ্যরাতের স্তব্ধ প্রহরে বোমা বা ককটেল ফোটে তখন হৃদরোগ বা অন্যান্য গুরুতর অসুখের রোগী অথবা প্রৌঢ় বা বৃদ্ধের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটানোর বিষয়টিকে পটকাবাজরা বিবেচনায় আনেন বলে মনে হয় না। বিদেশের যত্রতত্র কিন্তু এই ধরণের বোমাবাজি বা পটকাবাজি হয় না। পূর্ব থেকেই ঘোষণা দেয়া থাকে যে কোথায় কোথায় ফায়ার ওয়ার্কস হবে। যারা আগ্রহী তারা একা বা সপরিবারে সেটি দেখতে যান। সর্বোচ্চ এক ঘন্টা চলে এই ফায়ার ওয়ার্কস। শেষ হলে সকলে নিজ গৃহে ফিরে যান এবং নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েন। ফায়ার ওয়ার্কস বা উৎসবের কারণে বিদেশে আমার কোনোদিন নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটেনি।

যাই হোক, ওপরের পর্যবেক্ষণসহ দৈনিক সংগ্রামের অসংখ্য পাঠক পাঠিকাদের প্রতি রইলো খৃষ্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।

॥ দুই ॥

নববর্ষের শুরুতে আজ আমরা হতাশার কথা বলবো না। বছরের শুরু থেকেই, সেই মার্চ থেকেই, করোনার আতঙ্কে মানুষ অস্থির। চীনের উহানে কোভিড-১৯ বা করোনা নামে যে রোগটি প্রথম দেখা দেয় এবং অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ইউরোপের ইটালীতে ছড়ায় সেই রোগটির কথা বাংলাদেশের পত্র পত্রিকাতে ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রকাশিত হয়। ৮ মার্চ যখন ৩ জন রোগী শনাক্ত হন তখনই সকলের টনক নড়ে। সেই থেকে ডিসেম্বর শেষ হয়ে গেল। পুরা ১০ টি মাস মানুষ অস্থির সময় কাটাচ্ছে। সকলের মনে প্রশ্ন: কবে এই প্যান্ডেমিকের অবসান হবে? আমার সোজা সাপ্টা উত্তর: আল্লাহ্ তায়ালাই এই আযাব দিয়েছেন। যেদিন আল্লাহ্ এই আযাব উঠিয়ে নেয়ার বা নিয়ন্ত্রণ করার সিদ্ধান্ত নেবেন, সেই দিন থেকে এই আযাবের অবসান হবে বা এটি নিয়ন্ত্রণে আসবে।

রাব্বুল আলামীন কোন পথে মুশকিল আসান করেন সেটা মানুষের বোধগম্য হয় না। তবে নাজাত পাওয়া পর মানুষ বুঝতে পারে যে তাদের মুশকিলের আসান হয়েছে। হতে পারে যে বিশেষজ্ঞদের ধারণার চেয়ে কম সময়ে মহান আল্লাহই ভ্যাকসিন আবিষ্কার করালেন। অতীতে যে সমস্ত মহামারি এসেছে তার কোনো কোনোটির প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে সর্বোচ্চ ১০ বছর সময়ও লেগেছে। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, আমেরিকা বা ইউরোপের বিজ্ঞানীরা বলেন যে করোনার টিকা আবিষ্কার করতে কম করে হলেও দুই বছর সময় লাগবে। মহামারি বা প্যান্ডেমিকের ভয়াবহতা দেখে বিশ্বের সমস্ত উন্নত দেশ যত দ্রুত সম্ভব, ভ্যাকসিন আবিষ্কারে লেগে যান। এটিকে আল্লাহ্ তায়ালার বড়ই মেহেরবানী বলতে হবে যে, দুই বছর নয়, দেড় বছরও নয়, মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই এই প্রাণঘাতি ভাইরাসের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে।

॥ তিন ॥

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধ শতক পার হতে চলছে। অথচ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে আমরা এমন মেধা ও দক্ষতা দেখাতে পারিনি যে ভয়াবহ করোনা ভাইরাস আবিষ্কারের মহৎ প্রতিযোগিতায় আমরা শামিল হতে পারি। সে কারণে আমরা বসে থাকি, উন্নত বিশ্ব কবে টিকা আবিষ্কার করবে এবং কবে আমরা সেই টিকা পাবো। অবশেষে টিকা আবিষ্কারের সুখবর পাওয়া গেছে। কিন্তু আমরা, অর্থাৎ বাংলাদেশীরা, কবে সেই টিকা পাবো সেটি স্পষ্ট নয়।

সর্বপ্রথম টিকা আবিষ্কার এবং সেটি সাধারণ মানুষের দেহে প্রয়োগের খবর আসে রাশিয়া থেকে। রুশ টিকার নাম ‘স্পুটনিক-ফাইভ’। রুশ সরকার এই টিকার অনুমোদন দিয়েছে গত আগস্ট মাসে। কিন্তু গণহারে ইঞ্জেকশন দেয়া বা টিকা দেয়া শুরু হয়েছে ডিসেম্বরের শুরু থেকে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা ছিল যে আমরা এই টিকা প্রাপ্তিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবো। কারণ, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি Indo Centric বা ভারত কেন্দ্রিক বা ভারত নির্ভর। ভারত আমেরিকার সাথে যতই লবিং করুক না কেন, রাশিয়ার সাথে তাদের সম্পর্ক অনেক গভীরে। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহর লাল নেহরু এই সম্পের্কের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তীতে নেহরু তনয়া ইন্দিরা গান্ধী, তদীয় পুত্র রাজিব গান্ধীসহ সমস্ত কংগ্রেস সরকার রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক যত্নের সাথে লালন করে। চীনের কারণে ভারত আমেরিকার দিকে কিছুটা ঝুঁকলেও রাশিয়ার সাথে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। তাই দেখা যায় যে কিছুদিন আগে রাশিয়া যখন পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে যাচ্ছিল তখন ভারত প্রকাশ্যে ঐ অস্ত্র বিক্রয়ে বাধা দেয়। ভারতের প্রকাশ্য বিরোধিতার কারণে রাশিয়া পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রয়ে বিরত থাকে।
কিন্তু দেখা গেল যে ভারত নিজেই রুশ ভ্যাকসিন আমদানিতে আগ্রহী নয়। কারণ রুশ ভ্যাকসিনের তৃতীয় ও ফাইনাল ট্রায়াল হয়েছে কিনা। হয়ে থাকলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের জন্য সেগুলো পাঠানো হয়নি। সে কারণেই রুশ ভ্যাকসিন সকলের আগে বের হলেও ঐ ভ্যাকসিনে অন্য কোনো দেশ তেমন আগ্রহ দেখায়নি। রাশিয়ার বাইরে শুধুমাত্র বেলারুশ ও আর্জেন্টিনায় এই টিকার ব্যবহার হচ্ছে।

॥ চার ॥

বাংলাদেশের মানুষ সকলেই চান আমেরিকার ফাইজার বায়োএনটেক টিকা। বৃটেন কানাডাসহ অধিকাংশ ধনী এবং উন্নত দেশ ইতোমধ্যেই এই মার্কিন টিকা দেয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশ এই মার্কিন টিকা আমদানির চেষ্টা করেনি। আমার ধারণা, মাইনাস ৭০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় (হিমাঙ্কের নীচে ৭০ ডিগ্রী) এটি সংরক্ষণ করতে হয় বলে এটিতে বাংলাদেশ আগ্রহী নয়। কারণ মাইনাস ৭০ ডিগ্রী তাপমাত্রার হিমঘর বা রেফ্রিজারেটর বাংলাদেশে নাই। আমরা এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই বলে কোনো মন্তব্য করছি না। কিন্তু তবুও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। আমেরিকা তো ১০ মাস আগে থেকে এই টিকা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। এই সুদীর্ঘ ১০ মাস ধরে কি এটি জেনে নেয়া যেত না যে এই টিকা সংরক্ষণের জন্য মাইনাস ৭০ ডিগ্রী তাপমাত্রার দরকার হয়? অবশ্যই জানা যেত। জানা গেলে বাংলাদেশে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ কি অসম্ভব ছিল? আমি একটু আগেই বলেছি যে আমরা এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই। এটি কি অনেক ব্যয়বহুল, যা বাংলাদেশ বহন করতে পারবে না? নাকি কারিগরি জ্ঞানের (Technical knowhow) অভাব? বিষয়টি পরিষ্কার করলে জনগণ উপকৃত হতো।

ফাইজার বায়োএনটেকের টিকা ছাড়াও আমেরিকাতে আরেকটি টিকা সে দেশের ফেডারেল ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন পেয়েছে। সেটি হলো মডার্নার টিকা। কানাডাসহ একাধিক দেশ এটি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে। মডার্নার টিকাও কি মাইনাস ৭০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে? এখনও সেটি বলা হয়নি।

চীনের টিকার কি হলো? এরমধ্যে তাদের ৪ টি কোম্পানী ৪ টি টিকা উদ্ভাবন করেছে। এগুলো হলো, ক্যানসিনো, সিনোফার্ম, সিনোভ্যাক এবং সিনোফার্ম উহান। এসব টিকা সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহ্রাইনে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ এসব চীনা টিকায় কেন আগ্রহী নয়, সেটাও স্পষ্ট নয়।

দেখা যাচ্ছে, প্রায় দেড় মাস আগে বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার জন্য চুক্তি করেছে। কার সাথে? ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে। কেন সরাসরি অক্সফোর্ডের সাথে চুক্তি হলো না? কারণ অক্সফোর্ডের এই ওষুধটির প্যাটেন্ট পেয়েছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট। মনে হচ্ছে, আন্ডার লাইসেন্স ভারত (সিরাম ইনস্টিটিউট) এটি উৎপাদন করবে। সিরামের সাথে চুক্তি করেছে বেক্সিমকো। বেক্সিমকো কি এ্যাস্ট্রাজেনেকার প্যাটেন্ট পেয়েছে? এসব বিষয় ক্লিয়ার নয়।

তবে বাংলাদেশের মানুষ চায়, জানুয়ারিতেই এ্যাস্ট্রাজেনেকা যেন তাদের দেহে পুশ করা হয়।

asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/439338