৩ জানুয়ারি ২০২১, রবিবার, ২:৫৩

হিলিতে ঢুকেছে ভারতের পেঁয়াজবোঝাই ট্রাক

‘বিকল্প’ পেঁয়াজের কী হবে?

চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে ২৩ হাজার টন আমদানিকারকদের ‘মাথায় বাজ’

সাড়ে তিন মাস বন্ধ থাকার পর ভারত থেকে পেঁয়াজের আমদানি ফের শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজবোঝাই ভারতীয় ট্রাকের প্রথম চালান দেশে ঢোকে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার অভ্যন্তরীণ বাজারে সংকট এবং দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছিল। এদিকে ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার পর এখন পেঁয়াজ দেশে ঢুকতে থাকায় চট্টগ্রামের আমদানিকারকদের মাথায় যেন বাজ পড়েছে। এ অবস্থায় এসব পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় নেওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

জানা যায়, ভারতের বদলে বিকল্প দেশ থেকে আনা প্রায় ২৩ হাজার টন পেঁয়াজ পড়ে আছে চট্টগ্রাম বন্দরে। টাকার অঙ্কে এই পেঁয়াজের কেনা দাম ৮৩ কোটি টাকা। দেশের পাইকারি বাজারে দামে ধস নামায় আমদানিকারকরা এসব পেঁয়াজ বন্দর থেকে ছাড় নিচ্ছিলেন ধীরগতিতে। এ কারণে এক মাস ধরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনটেইনারে পড়ে আছে এই পেঁয়াজ।

গতকাল বিকেলে ভারত থেকে হিলি চেকপোস্ট দিয়ে পেঁয়াজবোঝাই ভারতীয় ট্রাকগুলো স্থলবন্দরে প্রবেশ করতে শুরু করে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ হারুন। সেখানকার পেঁয়াজ আমদানিকারক মাহফুজার রহমান বাবু বলেন, ‘আজ (শনিবার) আমার এক ট্রাক (১৯ টন) পেঁয়াজ ভারত থেকে এসেছে। দেশের বাজারে তা ২৩ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করব।’

এদিকে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরে পড়ে থাকা আগে আমদানি করা পেঁয়াজের কেনা দর ৪০ টাকার ওপর, কিন্তু বাজারে এখনই বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। ফলে কেজিতে এত বিপুল ক্ষতিতে এই পেঁয়াজ বিক্রি সম্ভব নয়। এ ছাড়া ভারত থেকে পেঁয়াজ ঢুকতে থাকায় বাজারে দর আরো নামছে।

পেঁয়াজ আমদানিকারক কায়েল স্টোরের মালিক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে আসা ছয় কনটেইনার পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দরে ১০ দিন ধরে পড়ে আছে। মূলত বাজারে দাম কমতে থাকায় এবং পণ্য ছাড়ার কাগজপত্র না পাওয়ায় ছাড় করতে পারিনি।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের পেঁয়াজ এরই মধ্যে ঢুকতে শুরু করেছে, এখন বাজার কী হবে আল্লাহই জানেন। এসব পেঁয়াজ কেনা পড়েছে কেজি ৪০-৪২ টাকায়, আর বাজারে আজকের দাম প্রায় অর্ধেক। তার পরও বন্দরে রেখে কী হবে। ছাড় করে নেব।’

জানা যায়, গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত হঠাৎ পেঁয়াজে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিলে বিপাকে পড়েন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। পরদিন থেকেই বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঋণ সুবিধা, শুল্ক কমানোসহ বড় শিল্প গ্রুপগুলোকে দিয়ে পেঁয়াজ আনানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র নেন ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রাম বন্দরের ট্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, গত শুক্রবার পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দুই লাখ ১০ হাজার টন পেঁয়াজ ছাড় হয়েছে। বিশ্বের অন্তত ১৫টি দেশ থেকে এসব পেঁয়াজ এসেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এর মধ্যে গত শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় ২৩ হাজার টন পেঁয়াজ বন্দর ইয়ার্ডে পড়ে আছে। আমরা পেঁয়াজ আমদানির সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট শিপিং লাইন, শিপিং এজেন্ট, আমদানিকারক এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের চিঠি দিয়ে দ্রুত ছাড় নেওয়ার আহ্বান জানানোর পরও ২৩ হাজার টন রয়ে গেছে। বন্দরে নামার ৪৫ দিন পার হওয়ার পর আমদানিকারক বন্দর থেকে ছাড় না নিলে এসব পেঁয়াজ নিলামে তুলবে কাস্টম কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় না নেওয়া আমদানিকারকরা বলেন, কিছু পেঁয়াজ এসেছে পচা, চালান আসার পর আর কিছু পেঁয়াজের মান খারাপ। বাজারে সংকট থাকলে এই পেঁয়াজ সরবরাহ নিতাম, কিন্তু এখন তো বাজারে ধস নেমেছে। তাই এই পেঁয়াজ ফেরত নেওয়ার জন্য সরবরাহকারীকে বলা হচ্ছে।

ভারতের পেঁয়াজ দেশের বাজারে ঢুকে পড়ায় ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়বেন। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম বন্দরের ওই পেঁয়াজ বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় পেঁয়াজ পাইকারি বাজারে ঢুকতে দিলে ভবিষ্যতে সরকারের ডাকে সাড়া মিলবে না বলছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রামের পেঁয়াজ আমদানিকারক মনজুর মোরশেদ বলেন, ভারত থেকে এখনই পেঁয়াজ আনলে চট্টগ্রাম বন্দরে যাদের পেঁয়াজ আছে তাঁরা আর বন্দর থেকে ছাড় নেবেন না। এর ফলে ওই আমদানিকারকরা দেউলিয়া হবেন। এ রকম হতে দিলে সংকট সামাল দিতে আর কোনো ব্যবসায়ী কি ভবিষ্যতে সরকারের ডাকে সাড়া দেবেন? বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আনবেন? প্রশ্ন রাখেন তিনি।

ভারতীয় পেঁয়াজ আসার খবরেই চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। বাজারে তুরস্কের ছোট জাতের পেঁয়াজ ছাড়া সব পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২২ থেকে ৩৫ টাকার মধ্যে। আর তুরস্কের ছোট পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে আড়তে ৪০ টাকা দরে।

ভারত থেকে পেঁয়াজ এলে অন্য দেশের পেঁয়াজের বাজারে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না বলছেন পেঁয়াজ আমদানিকারক ওকেএম ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অসিয়র রহমান। তিনি বলেন, ভারতীয় পেঁয়াজ ঢুকলে দেশের আড়তে কেজি ২০ টাকার মতো হবে। ফলে বিকল্প দেশের পেঁয়াজ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে যাঁরা আমদানি করেছেন অন্তত সেগুলো বিক্রি করে দেওয়ার একটা সুযোগ অবশ্যই দেওয়া উচিত।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/01/03/991507