৩ জানুয়ারি ২০২১, রবিবার, ২:৩৬

নতুন বছরে কর্মের চ্যালেঞ্জে পড়বে ষাট লাখের বেশি তরুণ-তরুণী

ইবরাহীম খলিল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন ফিরোজ আহমদ। এরপর থেকেই তিনি একাধিক সরকারি চাকরিতে আবেদন করেছেন, বেসরকারি চাকরির চেষ্টাও করেছেন। আশা করছিলেন একটা ভালো চাকরি হয়ে যাবে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে তার সেই স্বপ্ন থমকে গেছে। এখন তো মহামারির কারণে সবকিছুই আটকে আছে। কোন সার্কুলার নেই, কোন চাকরির পরীক্ষা নেই।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ থেকে পাস করা ফিরোজ জানালেন আমরা যারা বেকার আছি, চাকরির খুব প্রয়োজন, তাদের জীবনটা এই মহামারির কারণে একটা অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কোন কাজ নেই, যতদিন যাচ্ছে পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছি। পরিবারের সদস্যদের মলিন চেহারা সেই হতাশা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি জানান, তার বাবা মায়ের বয়স হয়েছে, এখন তার পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার কথা। কিন্তু এই মহামারির কারণে তিনি সেটা করতে পারছেন না। আরেকজন চাকরি প্রত্যাশী নমিতা সরকার পড়াশোনা শেষ করেছেন ২০১৭ সালে। গত কয়েকবছর ধরেই তিনি সরকারি চাকরির চেষ্টা করছেন।

তিনি জানালেন, আমি শুধু সরকারি চাকরির জন্যই অনেক বছর ধরে চেষ্টা করছি। করোনার কারণে সব আটকে গেল। এদিকে চাকরির বয়সও শেষ হতে চলেছে। মেয়ে হিসাবে পারিবারিকভাবে বিয়ের চাপও আছে। সব কিছু মিলিয়ে একটা মানসিক চাপের মধ্যে, হতাশার থাকতে হচ্ছে।

প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের চাকরির বাজারে যোগদান করে। এদের বড় একটি সংখ্যক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এমনিতেই দেশে বেকারত্বের হার অনেক। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেই সংকট আরো বেড়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ আর ২৭ লাখ বেকার। আর সম্ভাবনাময় কিন্তু সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের সুযোগ পান না এরকম মানুষ রয়েছেন প্রায় ৬৬ লাখ। এরা চাহিদা মাফিক কাজ না পেয়ে টিউশনি, রাইড শেয়ারিং, বিক্রয় কর্মী ইত্যাদি খণ্ডকালীন কাজ করেন। করোনাভাইরাস মহামারি কবে শেষ হবে, তা এখনো সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, মহামারির কারণে আর্থিক মন্দা বহাল থাকবে আরো কিছুদিন। যার প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি পড়বে চাকরির বাজারেও।

আইএলও-র একটি প্রতিবেদনে বলছে যে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এই বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে আগামী তিন মাসের মধ্যে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের পূর্ণ বা খণ্ডকালীন মোট কর্মশক্তির প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনের পেশা কোন না কোনভাবে কোভিড-১৯ এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই ক্ষতির শিকার বড় একটি অংশ তরুণ-তরুণীরা। আইএলওর মহাপরিচালক গাই রাইডার বলেছেন, জরুরিভিত্তিতে তরুণদের জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু করা না গেলে এই ক্ষতির জের টানতে হতে পারে পরবর্তী কয়েক দশক ধরে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের প্রধান নির্বাহী ড. ফাহমিদা খাতুন বলছেন, নতুন চাকরি তো নেই, যারা ছিল, তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। তার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে তরুণদের ওপর। যতদিন পর্যন্ত অর্থনীতি ঠিক না হবে, ততদিন তাদের সবার শ্রমবাজারে প্রবেশ করাটা কঠিন হবে।

এমনকি করোনা পরবর্তী সময়েও যেসব কাজের সৃষ্টি হবে, সেগুলোর ধরণ কিন্তু অন্যরকম হবে। এখন যেমন বেশিরভাগ কাজকর্ম ঘরে বসে হচ্ছে। ফলে ডিজিটাল বা আইটিবেজড কাজ বেশি হবে। ফলে আগের গতানুগতিক শিক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়া যাবে না। বাজার উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষন, সেই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার দরকার হবে। সেই সঙ্গে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, যুবকদের এই সমস্যা ও সংকটের ব্যাপারে এখনি গুরুত্ব দেয়া শুরু করা উচিত।

দীর্ঘদিন শ্রমবাজারের বাইরে অনেকদিন থাকলে তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম নেবে, সামাজিক একটা প্রভাব তৈরি করবে। এর ফলে যে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, তাই নয়, এর ফলে সমাজের ওপরেও সামগ্রিকভাবে একটা প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ৪.২% হলেও যুব বেকারত্বের হার ১১.৬ শতাংশ। করোনাভাইরাসের কারণে জুন ২০২০ সাল নাগাদ সেটি কয়েকগুণে বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন বেকার হয়েছে আর বাংলাদেশের প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে (২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ)। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই এই বেকারত্ব বাড়ছে।

আইএলও বলছে, মহামারিতে তারা তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে বেকার, সেই সঙ্গে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণও ব্যাহত হচ্ছে তাদের। এতে তাদের চাকরিতে প্রবেশ ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। আইএলও-র সংজ্ঞা অনুযায়ী, সপ্তাহে একদিন বা এক ঘণ্টা কাজের সুযোগ না পেলে ওই ব্যক্তিকে বেকার হিসাবে ধরা হয়। সেই হিসাবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ মানুষের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি কর্মসংস্থান খাতেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন বছরে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে কর্মহীন এই মানুষগুলোকে কাজের আওতায় আনা।

এদিকে এখন অনেক অফিস করোনা ভাইরাসকে অজুহাত দেখিয়ে লোক ছাটাই করে দিচ্ছে। জব মার্কেটের যেই অবস্থা। তাতে করোনা মুক্তি ছাড়া জীবনের মুক্তি মিলবে বলে মনে হচ্ছে না বলে মনে করেন অনেকেই। অনেকেই মনে করেন টাকা হয়তো ম্যানেজ হবে। কিন্তু চাকরি তো একটা পরিচয়, স্ট্যাটাস। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটের কারণে বাংলাদেশে প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার হয়ে পড়েছেন। আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি করেন এমন ১৩ ভাগ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই এমন মানুষের সংখ্যা আরও বেশি। আর ২৫ ভাগ চাকরিজীবীর বেতন কমে গেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বি আইডিএস-এর এক গবেষণায় এসব তথ্য জানা গেছে।

নতুন চাকরির সন্ধান যারা করছেন এবং নতুন উদ্যোক্তারাও এই করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে কাজ হারিয়ে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে।

নতুন বছরে সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্যমান ব্যবসা ও চাকরির খাতগুলো টিকিয়ে রাখা এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা।এক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন খাতে যে প্রণোদনা দিয়েছে সেটা দ্রুত বাস্তবায়নের করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ নাজনিন আহমেদ। নগরের অতি দারিদ্র মানুষগুলোর জন্য সাময়িক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি এবং সরকারের বড় বড় প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখলে কর্মহীন এই মানুষগুলোকে অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত করা যাবে বলে তিনি জানান।

এছাড়া ওষুধ শিল্প ও অনলাইনে ব্যবসার মতো নতুন সম্ভাবনাময় খাতে ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিও জরুরি বলে মনে করছেন নাজনীন আহমেদ। করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে সরকার বিভিন্ন খাতের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। কিন্তু এখনও বেশিরভাগ প্রণোদনা প্যাকেজ ব্যাংক থেকে ছাড় পায়নি।

এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে আড়াই কোটি মানুষ চাকরি হারাবে বলে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনাভাইরাস শুধু জীবন ও স্বাস্থ্যেই প্রভাব ফেলছে না, এই ভাইরাস সংক্রমণের প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতেও। যার ফলে ব্যবসা বাণিজ্য নিম্নমুখী এবং কর্মীরা বেশ বাজেভাবে আতঙ্কে ভুগছে। করোনাভাইরাসের কারণে তৈরি হওয়া মন্দায় ব্যাংকিং, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাই করছে। আর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই নতুন কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে।

বহুজাতিক বা বড় কোম্পানিগুলো গত কয়েকমাস ধরে ব্যবসা না হওয়ায় কর্মী ছাঁটাই বা বর্তমান কর্মীদের বেতন কমিয়ে দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো বলছে, আগে থেকেই খেলাপি ঋণের চাপ, তারল্য সংকট, তার ওপর ব্যবসা বাণিজ্যের অবনতির কারণে করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবে তাদের ব্যবসা খাদের কিনারে। ব্যয় কমানো ছাড়া তাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই। বেতন না কমালে ছাঁটাই করতে হবে।

অত্যন্ত জরুরি না হলে অনেক প্রতিষ্ঠানে আপাতত কয়েকমাস কোন রকম নিয়োগ কার্যক্রম না করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে শীর্ষ পর্যায় থেকে।একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানির কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অত্যন্ত জরুরি নয়, এমন কর্মীদের তালিকা চাওয়া হয়েছে মানবসম্পদ বিভাগ থেকে। তিনি জানাচ্ছেন, আপাতত তাদের বেতন কিছুটা কমিয়ে দিয়ে কর্মী ছাঁটাই না করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু মন্দা অব্যাহত থাকলে নতুন নিয়োগ তো বন্ধই, তিনি একপর্যায়ে কর্মী ছাঁটাই শুরু হওয়ার আশঙ্কা করছেন।

মানবসম্পদ কর্মকর্তাদের অ্যাসোসিয়েশন, গ্রিন এইচআর প্রফেশনাল বাংলাদেশের সভাপতি রওশন আলী বুলবুল বলছেন, নতুন যারা পড়াশোনা শেষ করে বের হলো, তারা একটা বিপদে পড়বেই। কারণ বাংলাদেশের সব ধরণের কোম্পানিই এখন সংকটে আছে। যারা বর্তমানে চাকরিতে আছে, তাদের অনেকে চাকরিহীন হয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে এসে চাকরির লড়াই করতে হবে নতুন আসা ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের।সরকারের প্রতিবছর অনেকগুলো সার্কুলার থাকে। এই বছর ছয়মাস হয়ে গেল, সরকারি কিন্তু কোন নিয়োগ নেই। আবার বেসরকারি খাতে পুরোটাই বন্ধ আছে। যারা চালু আছে, তারাও সীমিত লোক নিয়ে কাজ করছে। ফলে নতুন করে লোকবল নিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা তেমন নেই। তিনি বলেন, শিক্ষার ওপর নির্ভর করে না থেকে তাদের কোয়ালিটি বৃদ্ধি করতে হবে। "বেকার থাকার চেয়ে বেগার খাটা ভালো। এই দুঃসময়ে বসে না থাকে, যা পান, তাই নিয়ে শুরু করে দিন, অভিজ্ঞতা হোক। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি অন্য চাকরির জন্য চেষ্টা করতে পারেন।

https://dailysangram.com/post/439341