২ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ৩:৪৯

একটি সংবাদের সূত্র ধরে যা বলতে হয়

গত ২৮ ডিসেম্বর ঢাকার একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ শিরোনাম আমার মতো বোধহয় আরও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শিরোনামটি হলো- ‘সাংবাদিকের ফোন কেড়ে নিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীকে দিলেন প্রিসাইডিং অফিসার’। ঘটনার স্থান, ঢাকার ধামরাই পৌরসভা নির্বাচন উপলক্ষে হুজোরিটোলা এলাকার কলেজিয়েট স্কুল ভোটকেন্দ্র।

দৈনিক পত্রিকাটির নিজস্ব একজন প্রতিবেদক তখন মোবাইল ফোনে ভোটকেন্দ্রের অনিয়ম ও ভোট কারচুপির ছবি তুলছিলেন। তার ছবি তোলা দেখে ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিবেদকের হাত থেকে জোর করে মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেন এবং সেখানে উপস্থিত সরকারি দলের স্থানীয় এক কর্মীর হাতে তা তুলে দেন। ওই কর্মী মোবাইল ফোনটি হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব ছবি ডিলিট করে প্রিসাইডিং অফিসারকে আবার ফেরত দেন। ফেরত পাওয়ার পর প্রিসাইডিং অফিসার মোবাইল ফোনটি সেখানে কর্তব্যরত একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করেন।

বাহ্ কী চমৎকার ব্যবস্থা! সরকারি দলের কর্মী এবং প্রিসাইডিং অফিসারের সম্মিলিত দ্রুত ব্যবস্থায় ভোট কারচুপি ধামাচাপা দেয়ার এ এক অনন্য উদাহরণ! প্রিসাইডিং অফিসার এ সাহসী ভূমিকার জন্য সরকারি দলের বাহবা পেতেই পারেন। জানা গেছে, ভদ্রলোক একজন সরকারি কর্মকর্তা, ধামরাইয়ের উপজেলা প্রকৌশলী।

খবরটি পড়ার পর এ বিষয় নিয়ে দু’-একজন বন্ধুর সঙ্গে কথা হয়। তারা সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘এ বিষয় নিয়ে আবার লেখালেখি করো না। দেখেছো তো দেশের বিশিষ্টজনরা নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতি নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লিখে সরকারি দলের নেতাদের কেমন কোপানলে পড়েছেন? শুধু দেশেই নয়; দেশের বাইরে থেকেও কেউ কেউ অভিযোগকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একটি বিশেষ দলের দালাল বলে আখ্যায়িত করতে দ্বিধাবোধ করেনি।

আমি বিষয়টি নিয়ে এমন করে ভাবিনি। কারণ, যেসব বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ করেছেন, তাদের অন্তত দু’জনকে জানি যারা ২০০৭ সালের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। তাদের ইস্তফার কারণে যে ধারাবাহিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তারই ফসল বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিজেদের ঘরে তুলেছিল।

কাজেই ড. আকবর আলি খান ও সুলতানা কামালের মতো উপদেষ্টাদের কোন বিবেচনায় দালাল বলে অবহিত করা হল তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। এছাড়া অভিযোগে স্বাক্ষরকারী মানবাধিকারকর্মী খুশী কবিরের মতো ব্যক্তিত্বদের যখন দালাল বলা হয়, তখন এসব তকমা প্রদানকারীর দৈন্যই প্রকাশ পায়।

ইদানীং আরও একটি অনৈতিক প্রবণতা লক্ষ করছি। অনেক পথচ্যুত ব্যক্তিকে রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে সরকারি দলের কর্মীদের মতো বক্তৃতা দিতে, অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নোংরা ভাষায় কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। দিনে দিনে যেন এর মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এ শ্রেণির কর্মকর্তারা শুধু নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব নয়, নানা রকম অনিয়ম, প্রকাশ্য দুর্নীতি, সরকারি সম্পদের অপচয় ও অর্থ তছরুপের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছেন। এ ধরনের ঘটনায় অবশ্য প্রশাসনের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকেন না। অথচ এর দায়ভার সবাইকে বহন করতে হচ্ছে।

এসব কর্মকর্তার এমন অতি উৎসাহী আচরণে যে প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তা মোটেও সন্তুষ্ট নন, তারই যেন প্রতিধ্বনি দেখতে পেলাম গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগের জেলা পর্যায়ের ‘শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা স্বীকৃতি প্রদান,’ অনুষ্ঠানে প্রশাসন ক্যাডারের মাঠ পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুনের সাহসী বক্তব্যে। তিনি একশ্রেণির এসি ল্যান্ড ও ইউএনওর ক্ষমতার অপব্যবহার ও নেতা সাজার প্রবণতা নিয়ে যে সত্য ভাষণ দিয়েছেন তা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।

বিশেষ করে প্রশাসনের বেশিরভাগ কর্মকর্তা সচিব ইউসুফ হারুনের বক্তব্যকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং এই বক্তব্য প্রশাসনের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সেদিনের বক্তব্যে জনপ্রশাসন সচিব দুঃখ করে বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তাদের অপরাধপ্রবণতা এখন এত পরিমাণে বেশি, প্রতিদিন আমাকে ৩-৪টি করে বিভাগীয় মোকদ্দমা শুনতে হয়।

আবার একজন কর্মকর্তা যখন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হন, তখন তিনি তার ফোরামের (?) লোকজন নিয়ে তদবির করতে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে আসেন। এসব তদবিরে আমরা চরমভাবে বিব্রত হই। অনেকের তো বড় শাস্তি হওয়া উচিত। তারপরও পরিবেশ-পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে সেভাবেই শাস্তি প্রদান করি। জনপ্রশাসন সচিবের এ সাহসী বক্তব্যকে প্রশাসনের অনেকেই সমর্থন করেছেন। তারা মনে করেন, অপরাধীদের পাশাপাশি যারা তদবির করতে আসেন তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

খোঁজ নিয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে যে সমস্যার চিত্র পাওয়া গেছে তা যেন আরও বেশি ভয়াবহ ও দুর্ভাগ্যজনক। জানা গেছে, তদন্তে এ শ্রেণির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও বিভাগীয় মামলা চলে মন্থরগতিতে। কারণ এসব অপরাধী কর্মকর্তার পক্ষে কাজ করে শক্ত তদবির। যে কারণে তদন্তকারী কর্মকর্তারা অপরাধের চাক্ষুষ প্রমাণ হিসেবে রেকর্ডকৃত ফোনালাপের আলামত গ্রহণ করতেও অপারগতা প্রকাশ করেন, কারণ তাতে যদি অপরাধ হাতেনাতে প্রমাণ হয়ে যায়; তাহলে তো শাস্তি নিশ্চিত হয়ে যাবে।

রাজনীতিবিদদের তদবিরের পাশাপাশি এখন অভিযুক্ত কর্মকর্তার ব্যাচের নেতা নামধারী (পূর্বে একই ছাত্র রাজনীতিতে বিশ্বাসী) কর্মকর্তারা চাপ সৃষ্টি করেন। এ অযাচিত চাপের ডিগ্রি এত বেশি ভয়াবহ, বিভাগীয় মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণকালে কেউ কেউ ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের মতো বিনানুমতিতে ঢুকে পড়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। একটি রাজনৈতিক সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় কতটুকু ঘুণ ধরলে এসব ঘটতে পারে! জনপ্রশাসন সচিবের বক্তব্যকে সমর্থন করেন এমন কর্মকর্তারা দুঃখ করে বলেন, ‘কিছু খারাপ লোকের জন্য পুরো প্রতিষ্ঠান ইমেজ সংকটে পতিত হয়; যা কখনো কাম্য নয়।

এ অবস্থা শুধু মাঠ পর্যায়ে বললে সঠিক বলা হবে না। সর্বক্ষেত্রে এ রোগ বাসা বেঁধেছে। অনেক ক্ষেত্রে জবাবদিহিত না থাকায় এবং অতিমাত্রায় দলীয় রাজনীতিকে প্রাধান্য দেয়ায় আজকে এ ধরনের অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে।’ জনপ্রশাসন সচিব সাহস করে কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে কথা বললেও প্রজাতন্ত্রের যেসব কর্মকর্তা একটি বিশেষ দলের রাজনৈতিক মঞ্চে উপবিষ্ট হয়ে দলকানাদের মতো বক্তৃতা দেন, তাদের নিয়ে একটি কথাও বলেননি। হয়তো ইচ্ছা করেই তিনি উহ্য রেখেছেন। কারণ তিনি তার সীমাবদ্ধতা জানেন। তারপরও যে সাহসী বক্তব্য দিয়ে সবার চোখ খুলে দিয়েছেন, বিশেষ করে সরকারের লেজুড়বৃত্তি না করে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে যারা কাজ করতে চান তাদের তিনি যে সাহস জুগিয়েছেন তার জন্য তিনি সাধুবাদ পেতেই পারেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক কর্মীর মতো আচরণপ্রবণতা রোধ করা যায় কী করে? কিছু উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তার আচরণের কারণে সরকারের পুরো প্রশাসনিক বিভাগ যে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, তা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে এর গোড়ায় যেতে হবে। এ ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আমলাদের অতীত ইতিহাস যে খুব ভালো, তা বলা যাবে না।

এমন অনৈতিক কাজ করে ব্যক্তিগতভাবে যে লাভবান হওয়া যায় তার উদাহরণ আছে ভূরিভূরি। এ ধরনের কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে ক্ষমতার উচ্চ পর্যায়ে নিজেদের এমনই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন যে, তাদের অনেকে এখন মধ্যম সারির জনপ্রতিধিদেরও তোয়াক্কা করতে চান না। এ প্রবণতা শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর যেন এ অনুশীলন পরিপক্বতা পেয়েছে। অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে, সচিবালয় থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের কিছু আমলার দাপটে বিভিন্ন মহলে হতাশা তৈরি হয়েছে।

কতিপয় আমলার এমন দাপুটে অবস্থানের কারণে প্রশাসনের চেইন অফ কমান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জনপ্রশাসন সচিবের বক্তব্যে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। বস্তুত এ পরিস্থিতির জন্য এককভাবে শুধু আমলাদের দায়ী করা ঠিক হবে না। এ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সবচেয়ে আগে যা প্রয়োজন, তা হল আমাদের দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। যতদিন না রাজনৈতিক নেতৃত্বের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে, ততদিন এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। দেশে এখন যে রাজনৈতিক চর্চা চলছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে এমনটি যে হবে, সে সম্ভাবনাও দেখছি না।

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/379862