২ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ৩:৪৮

সভ্যতার আধুনিকায়ন ঘটছে বটে

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : মানুষ নাকি এখন অনেক সভ্য। বলা হয়, মনুষ্যত্বের এখন চরম উন্নতি সাধিত হচ্ছে। তবে এটা ঠিক যে, মানুষ চাঁদে অবতরণ করেছে। মঙ্গলগ্রহে বসতি গড়তে অভিলাষ ব্যক্ত করছে। কিন্তু নিজের ঘরে আগুন লাগবার উপক্রম। অনেকের ঘরে ইতোমধ্যে তা লেগেও গিয়েছে। কিন্তু টের পাচ্ছে না হতভাগ্য আধুনিক মানুষ। পেলেও প্রকাশ করছে না। ভেতরে ভেতরে মানুষ গুমরে গুমরে মরতে বসেছে, তা বলাই বাহুল্য। প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা উবে যাচ্ছে ক্রমাগত। হৃদয়-মন বলতে মানুষের ভেতর কিছু রয়েছে বলে মনে হয় না।
একজন মায়ের কী করুণ পরিণতি হতে পারে তা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করবার মতো নয়। তব্ওু ঘটনাটা উল্লেখ করছি।
ভারতীয় বাণিজ্যনগরী মুম্বাইয়ের এক কোটিপতি মহিলা মারা গেছেন নিজের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে ধুঁকে ধুঁকে। কেউ তাঁর খোঁজ নেননি। হয়তো নিতে পারেননি। তাঁর কোটিপতি এনআরআই অর্থাৎ নন রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান ছেলে আমেরিকায় বসবাস করেন। সেখানে বড়সড় এক কোম্পানির ওপর লেবেলের কর্মকর্তা। ভীষণ কর্মব্যস্ত। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে হাইফাই লাইফ এঞ্জয় করেন। কিন্তু জন্মদায়িনী মা মুম্বাইয়ের দামি ফ্ল্যাটে মরে পড়ে আছেন। কেউ খোঁজ নেননি। জানাজানি হবার ১০ মাস আগে মারা গিয়েছিলেন মহিলা। ১৭ কোটি রুপি মূল্যের ফ্ল্যাট থেকে তাঁর কঙ্কাল উদ্ধার করেছিল মুম্বাই পুলিশ।
মার্কিন মুল্লুকে নামকরা কোম্পানির হাইপ্রোফাইল ইঞ্জিনিয়ার ঋতুরাজ সাহানি জানেনই না তাঁর মা আশা সাহানি ঠিক কবে মৃত্যুবরণ করেছেন নিজের দামি ফ্ল্যাটে নির্জনে। নিভৃতে।
ঋতুরাজের নিজের বিবরণ অনুযায়ী মায়ের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হয়েছিল প্রায় ১ বছর ৩ মাস আগে টেলিফোনে।
২৩ এপ্রিল ২০১৬ সালে আশা সাহানি নিজের বৃদ্ধবয়সের একমাত্র সহায় প্রাণপ্রিয় পুত্র ঋতুরাজকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁকে যেন আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সম্ভব না হলে কোনও বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবারও ব্যবস্থা করতে বলেন তিনি। দুর্ভাগা এবং ব্যস্ত পুত্র ইঞ্জিনিয়ার ঋতুরাজ সাহানি সময় বের করে উঠতে পারেননি।
কোনও এক রোববার সকালে ঋতুরাজ মুম্বাই এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে আসেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।
অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকির পরও সাড়া না পেয়ে তিনি প্রশাসনের দ্বারস্থ হন। অতঃপর পুলিশ এসে ফ্ল্যাটের দরোজা ভেঙে আশা সাহানির কঙ্কাল দেখে হতবাক হয়।
৬৩ বছরের আশা দেবী সাহানি মুম্বাইয়ের রিচ এলাকার এক বহুতল কমপ্লেক্সের ১০ম তলায় থাকতেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা দীর্ঘদিন ধরে কেউ ব্যাপারটা বুঝতেই পারেননি যে, তিনি তখন আর বেঁচে নেই।

ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের আন্ধেরি এলাকার এ ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পাশ্চাত্য সভ্যতা খুব দ্রুত গ্রাস করে চলেছে আমাদের সমাজ, বোধ এবং বিবেককে। এ ছাড়া করোনা মহামারি মানুষের অনিশ্চিত মৃত্যুর ঘটনা ভঙ্গুর সভ্যতার অসহায়ত্বকে আরও প্রকটতর করে তুলছে বলা যায়।

আশা দেবী সাহানির এমন মৃত্যু আমাদের বুঝিয়ে দিল সামাজিক বিবেক-বিবেচনা-বোধ-বুদ্ধি একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছে গিয়েছে। কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

আমরা আমাদের সন্তানদের কেরিয়ার গঠন করত গিয়ে তাদের রোবটে পরিণত করে ফেলছি। অতএব এখনই ভাবতে হবে রোবট নয়, আমাদের সন্তানদের আগে মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে জাগতিক শিক্ষাই সবকিছু নয়। পারলৌকিক শিক্ষা ব্যতীত সবশিক্ষাই অসম্পূর্ণ। কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারেন, আপনার বা আমার অবস্থা আশা দেবী সাহানির মতো হবে না?

আহা! বেচারা আশা দেবী সাহানি! ১৭ কোটি ভারতীয় রুপির বিলাসবহুল ফ্ল্যাটবাড়ি ছিল। ছিল কোটি কোটি রুপির ব্যাংক ব্যালেন্স। তাঁর সবই ছিল। এখনও রয়েছে। কিন্তু এরপরও কিছুই নেই।

আশা সাহানির মতো অন্তিম অবস্থা হয় ইউরোপ-আমেরিকার অনেকেরই। তাঁদের বিলাসবহুল বিশাল বাড়ি থাকে। গাড়ি থাকে। থাকে ব্যাংক ব্যালেন্সও। কাছে থাকে না কেবল মৃত্যুর সময় আপনজনদের কেউ। সবাই নিজেকে নিয়ে খুব বেশি বিজি। বৃদ্ধ বাবা-মা একলা বাড়িতে পড়ে থাকেন। কাজের মানুষও সহজে পাওয়া যায় না। একলা নির্জনে নিভৃতে থাকতে থাকতে কারুর জীবনবায়ু নির্গত হয়ে গেলে পড়ে থাকে বেডে অথবা বাথরুমে। বাথরুম অথবা বেডের সঙ্গে নিভৃত বাসিন্দার ইলেকট্রনিক সংযোগ থাকে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের। হয়তো ছোট্ট ক্যামেরাও থাকে গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য। নিভৃতে থাকা মানুষটি মারা গেলে করপোরেশনের লোকজন টের পায়। তারপর তাঁর সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়। প্রয়োজন হলে মৃতের আপনজনদের খবর দেয়া হয়। ঠিকানা না থাকলে তাও সম্ভব হয় না। ব্যস! খেল খতম।

ঠিক ইউরোপীয় ও মার্কিনসভ্যতার আদলে আশা দেবী সাহানি নিজের নির্জন বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে মৃত্যুবরণ করলে দীর্ঘ ১০ মাস পর সুদূর আমেরিকা থেকে এসে টের পান পুত্র ঋতুরাজ সাহানি। ততদিনে তাঁর মা আশা সাহানির দেহের রক্ত-মাংস-রস সব উবে গেছে। পড়ে আছে কেবল হাড়হাড্ডি। কী ভয়ানক এবং বীভৎস পরিণতি ঘটতে পারে ধনাঢ্য মানব-মানবীর, আশা সাহানি তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ। বলতে দ্বিধা নেই, আশা সাহানি যেমন পাশ্চাত্য সভ্যতার করালগ্রাসে হারিয়ে গেছেন নিজের নিবাসে। নির্জনে-নিভৃতে। তেমনি অনিবার্য পরিণতির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে যেন আমাদের প্রাচ্যসভ্যতাও। এ বিনাশী সভ্যতার শিকার কেবল আশা সাহানি নন। বোধহয় আরও অনেকে। বলা যায়, আমরাও।

আমাদের দেশেও ইতোমধ্যে বৃদ্ধাশ্রমসংস্কৃতি চালু হয়েছে। বিদেশে যেটাকে ওল্ডহোম বলা হয়। মানুষের যখন বয়স হয়ে যায়। কর্মক্ষমতা থাকে না। ঘরে বসে বসে থাকতে হয়। অন্নধ্বংস ব্যতীত কোনও কাজ থাকে না। তখন বুড়োবুড়ির ঠাঁই জোটে বৃদ্ধাশ্রম বা ওল্ডহোমে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ওল্ডহোম আছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়ও রয়েছে। শিশুনিবাস যেমন। বুড়োবুড়ির নিবাসও তেমন। অনাথ, বেওয়ারিশ, ফেলে দেয়া শিশুদের যেমন চাইল্ডহোমে দেয়া হয়। তেমনই মা-বাবার বয়স হলে সন্তানেরা ঝামেলা এড়াতে ওল্ডহোমে দিয়ে আসেন। কোনও কোনও মা-বাবা ছেলে-বউয়ের আচরণ টের পেয়ে নিজেরাই খুঁজে নেন বৃদ্ধাশ্রম। কেউ কেউতো বুড়ো মা-বাবাকে রাস্তায় পর্যন্ত ফেলে দিয়ে আসেন। এমন অবস্থা কেবল যেসব মা-বাবার কিছু থাকে না তাদেরই ঘটে না। অনেকে মা-বাবার সম্পত্তি, বাড়িঘর কৌশলে লেখে নিয়ে তাঁদের রাস্তায় ফেলে দেয়। যেসব সন্তানের একটু দয়ামায়া (?) বলে কিছু থাকে তাঁরা ওল্ডহোম খোঁজেন বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য। এ হচ্ছে আধুনিক সভ্যতা।

মিরপুরের বশিরউদ্দিন স্কুলের এক বি.এসসি. শিক্ষক দুই ছেলেকে ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার করেছেন। এরপর পাইকপাড়ার ভিটেমাটি বেচে ছেলেদের ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। মেয়েকে কিছু দেননি। ছেলেরা বিয়েশাদি করে সংসার গুছিয়েছেন। তিনি ছেলেদের বাসায় নাকানিচুবানি খেয়েছেন। কিন্তু ঠাঁই হয়নি। বেচারা এখন মেয়ের বাসায়।

আজকে যারা মা-বাবাকে ওল্ডহোমে রেখে আসেন কিংবা উচ্চশিক্ষিতা বউয়ের চাপে বাসায় রাখতে না পেরে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে অথবা আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে নেবার নাম করে রাস্তায় ফেলে আসেন, তাঁরাও আগামিতে বুড়ো হবেন। তাঁদের ঠাঁই যখন ওল্ডহোমে কিংবা রাস্তার ধারে হবে তখন মজাটা কেমন হবে তা চিন্তা করা খুব দরকার।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের এক রিটায়ার্ড প্রফেসর সন্তানদের বড় করেছেন। পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ (?) বানিয়েছেন। কিন্তু সন্তানের ঘরে তাঁর স্থান হয়নি। তিনি স্বেচ্ছায় ওল্ডহোমে আশ্রয় নিয়েছেন। সন্তান ও তাঁদের বউদের কাছে লাঞ্ছিত হবার আগেই তিনি ওল্ডহোমে আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন পাশ্চাত্যের মানুষের মতো।

কোনও কোনও সৌভাগ্যবান ও সৌভাগ্যবতী ওল্ডহোমে থেকেও সুসন্তানদের (?) কালেভদ্রে দেখা পান। কেউ কেউ তাও পান না। ওল্ডহোমে রেখে যাবার সময় সন্তানেরা বলে যায়, “এখানে ক'দিন থাকো। চিকিৎসাশেষে বাসায় নিয়ে যাবো।” কোনও কোনও মা-বাবা সন্তানের মিথ্যে আশ্বাস বুঝতে পারেন। তাঁরা আর তেমন আফসোস করেন না। কিন্তু যে মা-বাবারা সন্তানের মিথ্যে সান্ত্বনা বুঝতে না পেরে নিতে আসবার পথপানে চেয়ে থাকেন তাঁরা কষ্ট পান বেশি। কান্নাকাটি করেন সন্তানের জন্য। কিন্তু যে-পাষাণহৃদয় সন্তান চিরদিনের জন্য মা-বাবাকে ওল্ডহোমে রেখে যান, তিনি আর আসবেন কেন?

যা হোক, আশা দেবী সাহানির সন্তান ঋতুরাজ সাহানি সুদূর আমেরিকা থেকে মুম্বাইয়ের আন্ধেরিতে জন্মদায়িনী মাকে দেখতে এসেছিলেন। ওল্ডহোমে নয়। মায়ের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। যেখানে আশা সাহানি বড্ড নিরাশার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছিলেন নির্জনে। দীর্ঘ নিঃসঙ্গতায় থেকে থেকে নিরাশ হয়ে ছেলের কাছে আমেরিকায় নিয়ে যেতে বলেছিলেন। তা সম্ভব না হলে মুম্বাইয়ের আশ-পাশে কোনও ওল্ডহোমে রেখে আসবার অনুরোধ করেছিলেন। অর্থাৎ তিনি আর নিজের ফ্ল্যাটে একা বসবাস করতে পারছিলেন না।

ছেলে ঋতুরাজ হয়তো দুটোর একটা ব্যবস্থা করতেনও। এ উদ্দেশ্যেই হয়তো তিনি এসেছিলেন। কিন্তু সে আর হয়নি। ছেলে দেশে আসবার ১০ মাস আগেই তিনি চলে গেছেন আসল ঠিকানায়। যেখান থেকে কেউ আর ফেরেন না। ঋতুরাজ তাঁর মায়ের কঙ্কালটাই দেখতে পেয়েছেন। আর দেখেছেন ১৭ কোটি রুপি মূল্যের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। এটাই হচ্ছে সভ্যতার আধুনিক সংস্করণ। মায়া-মমতা, মাতৃস্নেহ এবং পারিবারিক বন্ধন বা নৈকট্য সব যেখানে অতি তুচ্ছ আর মূল্যহীন প্রতিপন্ন হয়েছে। অসহায় মা-বাবাকে ওল্ডহোমে কিংবা একদম রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যাবার মতো অমানবিক ঘটনাও ঘটাচ্ছেন কেউ কেউ অবলীলায়। এটাই কি তাহলে সভ্যতার আধুনিকায়ন?

https://dailysangram.com/post/439238