২ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ৩:৪২

করোনা প্রকাশ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য খাতের দৈন্যদশা

ফিরে দেখা-২০২০

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের দৈন্যদশা প্রকাশ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না কারণ বাংলাদেশে সবচেয়ে বাজেট বরাদ্দের খাতের মধ্যে স্বাস্থ্য অন্যতম। প্রতি বছরই হাজার কোটি টাকা এ খাতে ব্যয় করা হলেও এর ভেতরটা যে ফাঁপা অথবা ভেতরের সবকিছুই ভঙ্গুর তা এত ব্যাপকভাবে আর কখনো প্রকাশ পায়নি। অপর দিকে দুর্নীতিতে যে ক’টি খাত চ্যাম্পিয়ন এর মধ্যে স্বাস্থ্য একটি। করোনার এ বিপদের মধ্যে মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে যেখানে আরো বেশি আন্তরিকতার সাথে স্বাস্থ্য খাতের কর্মকর্তাদের কাজ করা উচিত ছিল সেখানে মানুষের এ বিপদকে দুর্নীতির হাতিয়ার বানানোর প্রয়াস লক্ষ করা গেছে।

জনগণের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেয়া নেই, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নেই, নেই প্রয়োজনীয় ওষুধ ও অন্যান্য সরঞ্জামের সরবরাহ। আছে যা- তা হলো অবকাঠামো নির্মাণ, বিভিন্ন দামি যন্ত্রপাতি কেনায় বাজেটের বেশির ভাগ টাকা ব্যয়ের অপচেষ্টা। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ব্যাপকতা এত বেশি যে এখানে পাঁচশ’ টাকার সাধারণ সরঞ্জামও কেনার ব্যবস্থা করা হয় কয়েক হাজার টাকায়। অপর দিকে মুমূর্ষু রোগী চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই, যন্ত্রপাতিও নেই। ফলে রোগীদের যেতে হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। আবার এর বাইরে শাহেদ ও সাবরিনাদের মতো লোকদের প্রতারণা সারা বছরের অন্যান্য ঘটনাকেও ছাপিয়ে গেছে। প্রথম দিকে একটি মাত্র ল্যাবরেটরি দিয়ে সারা দেশের মানুষের করোনা পরীক্ষা করা হয়। দ্রুত করোনা পরীক্ষার জন্য অ্যান্টিবডি টেস্টের কিট একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি করলেও সরকার তাদের অনুমোদনই করেনি। ফলে মানুষকে করোনা টেস্টের জন্য মহাখালীর আইইডিসিআরের কাছেই আসতে হয়েছে। করোনার গত ৯ মাস ২২ দিনে মানুষের মধ্যে বিরাজ করেছে আতঙ্ক-উদ্বেগ, হাহাকার। আপনজনদের মৃত্যুর শোকে বাতাস ভারী হয়ে গেলেও করোনাকে কেন্দ্র টাকা কামানোর চেষ্টার উৎসবে মেতেছিল কিছু সরকারি কর্মকর্তা।

হাসপাতাল খালি করে দেয়া হয় : করোনাকে মোকাবেলা করতে না পেরে অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে শুধু জরুরি চিকিৎসার রোগী ছাড়া অন্য রোগীদের হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয় চিকিৎসা সম্পূর্ণ না করেই। ২০২০ সালের ৮ মার্চের পর থেকে প্রথম কয়েক দিন করোনার দোহাই দিয়ে হাসপাতালে সব ধরনের রোগী ভর্তি বন্ধ করে দেয়া হয়। করোনার নেগেটিভ সার্টিফিকেট নেই বলে মুমূর্ষু রোগীদের হাসপাতাল থেকে ফেরত দেয়া হয়েছে। এমনকি সার্জারির রোগীদেরও ভর্তি করেনি। ফলে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে রোগীরা রাস্তায়ই মারা গেছেন। করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালেও করোনা রোগীদের ভর্তি করা হয়নি। এমনকি ফরেনসিক মেডিসিনের একজন সিনিয়র অধ্যাপকও মারা গেছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে। ডাক্তার ও রোগীদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল আতঙ্ক। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে ডাক্তাররা রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। ডাক্তারদের নিজস্ব চেম্বারেও রোগী দেখা বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসা নিতে না পেরে কত যে মানুষ মারা গেছেন এর হিসাবও নেই।

চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক : যেকোনো রোগ মোকাবেলায় ডাক্তার নার্সদের প্রশিক্ষিত করা হয়। কিন্তু করোনাকালে এই ডাক্তার নার্সদের মধ্যে দেখা দেয় চরম আতঙ্ক। করোনা একটি ভয়ঙ্কর রকমের ছোঁয়াচে ভাইরাস। ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে চিকিৎসা কি হবে তা জানা না থাকায় আতঙ্কটা ঘিরে ধরে তাদের। চরম ছোঁয়াচে এ ভাইরাসটি ডাক্তারের মধ্যে যেন চলে না আসে এবং রোগী চিকিৎসা যেন ব্যাহত না হয় সেজন্য ডাক্তারদের প্রয়োজন ছিল প্রয়োজনীয় এবং মানসম্মত পিপিই বা পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট। চিকিৎসকদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত পিপিই, মাস্ক ও গগলস দেয়া হয়নি। ফলে রোগী দরদি কিছু ডাক্তারকেও দেখা গেছে শরীরে পলিথিন জড়িয়ে চিকিৎসা দিতে।

করোনাকালে মারা গেছেন ১২১ জন চিকিৎসক : গত প্রায় ১০ মাসে সারা দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে সরকারি হিসেবে সাত হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। এর মধ্যে ডেন্টাল চিকিৎসকসহ সারা দেশে ১২৫ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে করোনায়। দেশের ইতিহাসে ১০ মাসে এত বেশি চিকিৎসকের মৃত্যু আর কখনো হয়নি। প্রথমদিকে এ চিকিৎসকেরা মারা গেছেন করোনার চিকিৎসা না জেনে, পিপিই না পেয়ে এবং কে করোনা আক্রান্ত না জেনে চিকিৎসা দেয়ায়। চিকিৎসকদের মধ্যে প্রথম মৃত্যুবরণকারী সিলেট মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক ডা: মঈন উদ্দীন আহমদ পিপিই না পেয়ে পলিথিন পেঁচিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। কিছু দিন পরই তিনি করোনা আক্রান্ত হন এবং ১৫ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। এখন অবশ্য চিকিৎসকেরা মারা যাচ্ছেন সারা দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ায়। কে কার থেকে এবং কোথায় সংক্রমিত হচ্ছেন তা জানতে না পারায়। এখন যে চিকিৎসকেরা মৃত্যুবরণ করছেন তাদের সবাই হাসপাতালে ভর্তিরত অবস্থায় চিকিৎসাধীন থেকে। তাদের সবারই বয়স পঞ্চাশের উপরে। সবারই কো-মরবিডিটি বা করোনা সংক্রমিত হওয়ার আগে তাদের অনেকের শ্বাসকষ্ট, হার্ট ডিজিজ, ক্যান্সার এবং আগে থেকে স্ট্রোকের ইতিহাস রয়েছে। এ ধরনের অসুস্থদেরই বেশি মৃত্যু ঘটছে। চিকিৎসকেরাও ব্যতিক্রম নন।

টেস্ট না করেই শাহেদ ও ডা: সাবরিনারা রিপোর্ট দিত : উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক শাহেদ ও সরকারি চিকিৎসক ডা: সাবরিনার কর্মকা দেশবাসীকে হতবাক করে দিয়েছে। তাদের কারণে বাংলাদেশের সম্মান ধুলায় মিশে গেছে বিশ্ব দরবারে। বাংলাদেশের পিসিআর মেশিনে করোনা টেস্টকে অনেক দেশ এখন আমলে নিতে চাচ্ছে না। শাহেদ করিম ও ডা: সাবরিনারা পিসিআর মেশিনে করোনা টেস্ট না করেই সার্টিফিকেট দিয়েছে রোগীদের আবার রোগীদের কাছ থেকে উচ্চ হারে নিয়েছে ফি। তাদের এ প্রতারণার বিরুদ্ধে মিডিয়ায় রিপোর্ট হলে দেখা গেছে তাদের সাথে শীর্ষ কিছু কর্মকর্তাও জড়িত। শাহেদের দুর্নীতি প্রকাশ হয়ে পড়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে সরে যেতে হয়েছে। মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ পদত্যাগ করেছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চলছে। অপর দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আসাদুল ইসলামকে সরিয়ে অন্যত্র পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেলে সেখানে করোনা পজিটিভ হয়ে কোয়ারেন্টিনে যেতে হয়েছে অনেককে।

পাঁচশ টাকার গগলস পাঁচ হাজার টাকায় কেনা : বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে ঋণের টাকায় কেনাকাটার অস্বাভাবিক পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায় মিডিয়ার রিপোর্টে। কেনাকাটায় গগলস, পিপিইর দাম ধরা হয়েছে বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে দুই থেকে চার গুণ বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিকল্পনা ও গবেষণা শাখার পরিচালকের স্বাক্ষরে পাঁচশ টাকার গগলস পাঁচ হাজার টাকা, এক দেড় হাজার টাকার পিপিই পাঁচ হাজার দেখিয়ে পরিকল্পনা জমা দেয়া হয়। এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হলে এটা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। পরে সরকার বাধ্য হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিকল্পনা ও গবেষণা শাখার পরিচালকের পদ থেকে অধ্যাপক ইকবাল কবিরকে সরিয়ে দিতে। একই সাথে প্রকল্প দু’টি থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয় তাকে। সার্জিক্যাল মাস্ক দিয়ে বলা হয়েছে এন-৯৫ মাস্ক দেয়া হয়েছে। আবার মানহীন এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের ঘটনাও ঘটেছে। এন-৯৫ মাস্ক মানহীন বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অভিযোগ মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকদ্বয়কে অন্যত্র বদলি করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আবার জেএমআই নামক একটি কোম্পানি এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের নামে সার্জিক্যাল মাস্ক সরবরাহ করলেও এর বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

স্বাস্থ্য খাত শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত : শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের মধ্যে অনেকবার স্বাস্থ্য খাতের নাম উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) দুর্নীতির জরিপে। টিআইবি জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭ প্রতিবেদন অনুযায়ী সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর একটি স্বাস্থ্য খাত। এ খাতে দুর্নীতির হার ৪২ দশমিক পাঁচ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা-নিয়োগসহ দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন জমা দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। সেখানে স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ ১১টি খাতকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু সে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যখাতে কোনো সংস্কার বা পদক্ষেপের কথা শোনা যায়নি। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কারণে সেবার মান উপেক্ষিত। যেমন এন ৯৫ মাস্ক ক্রয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজানোর কোনো বিকল্প নেই।

চিকিৎসার চেয়ে অবকাঠামো ও ক্রয়ে খরচ বেশি : স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনের তুলনায় এবং জনসংখ্যার তুলনায় বাজেট বরাদ্দ যেমন কম, তেমনি বরাদ্দের যতটা না চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়, তার চেয়ে বেশি খরচ হয় ভৌত অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ ও বেতন-ভাতার পেছনে।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট ছিল মোট বাজেটের পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ অর্থাৎ ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে বাজেটে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গেল অর্থবছরের মোট বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকার মধ্যে ১৩ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা যার বেশির ভাগই চলে গেছে পরিচালন খাতে। এর মাত্র এক-চতুর্থাংশের মতো বরাদ্দ হচ্ছে ওষুধ ও সরঞ্জাম কেনার পেছনে। বাকি অর্থ চলে গেছে বেতন-ভাতায়।

স্বাস্থ্য খাতে সক্ষমতার অভাব, দুবৃর্ত্তায়ন, কেনাকাটা সিন্ডিকেটের কারসাজিতে অপচয় বেড়েছে। সংস্কার, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ছাড়া বরাদ্দ বাড়ালেও স্বাস্থ্য খাতে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসেনি। অবকাঠামো কিছু গড়ে তোলা হয়েছে কিন্তু সেগুলো সুপরিকল্পিত নয়। রোগীর চাপ এত বেশি যে তাদের জন্য মানসম্পন্ন চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। রোগীর জন্য যে বরাদ্দ তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। যে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়, সেটাও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয় না। সেটা মূলত ভৌত অবকাঠামো, প্রশাসনিক ব্যয়, বেতন-ভাতা ইত্যাদিতে চলে যায়। প্রকৃতপক্ষে রোগীর সেবার জন্য বরাদ্দ খুবই কম। এক দিকে বরাদ্দ কম, অন্য দিকে বাজেট বরাদ্দ বাস্তবায়নের হার কম। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ৫১,৩১৬টি। আর বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে পাঁচ হাজার ৫৫টি এবং এসব হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৯০ হাজার ৫৮৭টি। দেশে প্রতি এক হাজার ১৫৯ জন ব্যক্তির জন্য হাসপাতালে একটি শয্যা রয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/553056