২ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ৩:৪১

শেয়ারবাজারের শুরুটা হতাশার হলেও শেষটা ছিল আশা জাগানিয়া

বিদায়ী বছরে ২০১০ এর ক্ষততে মলম লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দেশের পুঁজিবাজারে মহা ধসের দশ বছর পার হলেও সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার প্রভাব খুব বেশি পড়েনি বাজারে। পুঁজিহারা বিনিয়োগকারীরা এখনো আটকে আছেন লোকসানের বৃত্তে। শেয়ারবাজারের ইতিহাসে ১৯৯৬ সালে ও ২০১০ সালে মহা ধসের ঘটনা ঘটে। আর এই দুই মেয়াদেই ক্ষমতায় ছিল বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার। বিনিয়োগকারীদের নি:স্ব করে দেওয়ার এই ন্যাক্কারজনক ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু বিচারের আওতায় আনা হয়নি তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের। এতে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এর ফলে দীর্ঘ ১০ বছরে কোমর সোজা করেই দাঁড়াতে পারেনি শেয়ারবাজার। এরই মধ্যে হাজির বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস। ওলট-পালট করে দিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। এর ধাক্কা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও লেগেছে। করোনার শুরুর দিকে শেয়ারবাজারের অবস্থার ব্যাপক অবনতি হতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ৬৬ দিন বন্ধ থাকে শেয়ারবাজারের লেনদেন। তবে বিদায়ী বছরের শুরুটা শেয়ারবাজারের জন্য হতাশার হলেও শেষটা ছিল আশা জাগানিয়া। বছরের শেষে এসে ডিএসইদে প্রতিদিন গড়ে হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে। সূচক উঠে এসেছে পাঁচ হাজার পয়েন্টে বেশি। ২০২০ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করেছেন উদ্যোক্তারা। এছাড়া বর্তমান বাজার মূলধন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে।

ব্যাংক খাতের বাইরে দেশের অর্থনীতির আরেকটি বড় ক্ষেত্র শেয়ারবাজার। সেই শেয়ারবাজারেও ১৯ বছরের ব্যবধানে বড় দুটি কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেংকারির পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০১০ সালে। ১৯৯৬ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মত ক্ষমতায় আসার বছরে শেয়ার বাজারে ঘটে মহা দুর্নীতি। যেখানে ৪০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়। নভেম্বর-ডিসেম্বরে এই ঘটনা ঘটে। শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধস, সাধারণ সূচকের রেকর্ড পতন হয়। শেয়ারবাজার প্রসঙ্গ এলেই ঘুরেফিরে আসে এই দুটি কেলেঙ্কারির কথা। একটি ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারি, অপরটি ২০১০ সালের কেলেঙ্কারি হিসেবে বহুল আলোচিত। আর এই দুটি কেলেঙ্কারির ঘটনার সময়ই দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। শেয়ারবাজারের আলোচিত এই দুই কেলেঙ্কারির পর সরকারের উদ্যোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়। অভিযুক্ত করা হয় অনেককে। এমনকি দুই কেলেঙ্কারির ঘটনায় মোট ১৭টি মামলা হয়। এর মধ্যে ‘৯৬-এর কেলেঙ্কারির ঘটনায় ১৫টি আর ২০১০ সালের ঘটনায় দুটি মামলা। শেয়ারবাজারের আলোচিত দুই কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সিংহভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।

১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আমিরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ১৫টি মামলা হয়। এদিকে ২০১০ সালের কেলেঙ্কারির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে অনিয়ম ও অপরাধের বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরলেও মামলা হয় মাত্র দুটি।

বাজার বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকের মতে, অতীতের অনিয়মের কোনো বিচার না হওয়ায় বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। তাই শেয়ারবাজার দীর্ঘকালীন এক মন্দাবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বিএসইসির যে ধরনের শক্তিশালী ও সৎ অবস্থান তৈরি করা দরকার ছিল, তা তারা করতে পারেনি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর দেশের ইতিহাসে ডিএসই সাধারণ সূচক সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে। ওই দিন লেনদেন শেষে ডিএসই সূচক দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্টে। সেই সঙ্গে ওই দিন মোট লেনদেনকৃত শেয়ারের সংখ্যা, বাজার মূলধন ও মোট লেনদেনের পরিমাণও সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে। কিন্তু এর পরদিন অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর থেকেই শুরু হয় পতন। কয়েক দিনের ব্যবধানেই যা মহাধসে পরিণত হয়। একপর্যায়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরই পরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারে ধস নামিয়ে দেওয়া হয়। এতে মোট ৩৫ লাখ বিনিয়োগকারী সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসে পড়েন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কার্যালয়ের সামনে পুঁজি হারানো মানুষের আহাজারি ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। সে সময় পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব কয়েকজন বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে। পুঁজিবাজারে সূচকের পতনের পর ফুঁসে ওঠেন বিনিয়োগকারীরা। প্রায় প্রতিদিনই রণক্ষেত্রে পরিণত হতে থাকে পুরো মতিঝিল এলাকা। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও মামলা-মোকদ্দমার ঘটনাও ঘটে।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশীদ চৌধুরী জানান, ধসের পর নিঃস্ব বিনিয়োগকারীদের অবস্থা দশ বছরেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিনিয়োগকারীদের দেখার কেউ নেই। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) লক্ষ্য স্থির করে বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু করতে পারেনি বলেই আস্থা ফিরে পাননি বিনিয়োগকারীরা। ফলে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর পরিবার এখনো সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। তবে অতি সম্প্রতি শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে কিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে বিএসইসি। এতে কিছুটা আস্থা ফিরেছে।

বৈশ্বিক করোনা ভাইরাস মহামারির আঘাতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও বিদায়ী বছরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দেশে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর এ বছর চার মাসের বেশি সময় উৎপাদন কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ ছিল। ফলে গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এর মধ্যেও দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক চলতি বছর ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৪৯ পয়েন্ট বেড়েছে। ২০১৯ সালের শেষ দিন ডিএসইর মূল সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৪ হাজার ৪৫৩ পয়েন্ট। ৩০ ডিসেম্বর তা বেড়ে ৫ হাজার ৪০২ পয়েন্টে উঠেছে। লেনদেন হচ্ছে হাজার কোটি টাকার উপরে।

২০২০ সালের শেষ ছয় মাসে দেশের পুঁজিবাজার ভালো করলেও প্রথম ছয় মাসের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। বছরের প্রথমার্ধে সূচক ৪ হাজার পয়েন্টের নেমে গিয়েছিল, লেনদেনও নেমেছিল ১০০ কোটি টাকার নিচে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই করোনা ভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলেও বিশেষ প্রণোদনা থাকায় পুঁজিবাজার তুলনামূলক ভালো করেছে মনে করেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের এই অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা। তিনি বলেন, প্রণোদনার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিতে নতুন নেতৃত্ব আসার পর তাদের কার্যক্রমে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরেছে। এসবের সার্বিক প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারের কর্মকাণ্ডে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রবাসী আয়ে (রেমিটেন্স) প্রবৃদ্ধিসহ অর্থনীতির কয়েকটি সূচক ভালো থাকায় সামনের বছরও পুঁজিবাজারে ভালো কাটার কথা। তবে দেশের পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা ব্যাংক খাতে ‘ঝুঁকি রয়েছে’ মন্তব্য করে অধ্যাপক মুসা বলেন, ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে (প্রভিশন) ছাড় দেওয়া হয়েছে। এই সুযোগ নিয়ে ঋণখেলাপি বেড়ে গেলে তা ব্যাংকিং খাতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ২০১৯ সালের শুরু থেকে মন্দাভাব চলছিল। এর মধ্যেই বছরের শেষ দিকে চীনে করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে, ক্রমে তা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রভাবে ২০২০ সালের প্রথম থেকে দেশের পুঁজিবাজারের সূচক কমতে থাকে; পতন ঠেকাতে শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দেওয়া হয়। এতে তাৎক্ষণিকভাবে বাজার চাঙা হলেও দীর্ঘ মেয়াদে আশানুরূপ ফল মেলেনি।

এর মধ্যেই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে নজিরবিহীনভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় দেশের পুঁজিবাজার। এই পদক্ষেপকে পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখেননি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বিশ্বে এটা একটা বিরল ঘটনা। বিনিয়োগকারীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

করোনার কারণে পুঁজিবাজার প্রায় ৬৩ দিন বন্ধ ছিল; বিনিয়োগকারীদের টাকা আটকে গিয়েছিল, কেউ চাইলেও টাকা বের করতে পারছিলেন না। ডিএসই ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএর সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী জানান, এর আগে কোনো দিন বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এভাবে বন্ধ হয়নি। ১৯৮৮ সালে বন্যা হয়েছিল; সেসময় পানি ঢুকে গিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ তিন চার দিন বন্ধ ছিল। এক দিকে অর্থনীতির খারাপ অবস্থা, অন্যদিকে পুঁজিবাজারের পতন ঠেকাতে শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দেওয়ায় লেনদেন গিয়ে ঠেকেছিল তলানিতে।

এর মধ্যেই জুলাইয়ের শেষ ভাগ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। এর পেছনে তিনটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। আমানতের সুদের হার ৫ শতাংশে এবং ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে বেঁধে দেওয়া। এর ফলে কম সুদে ঋণ পেয়েছেন উদ্যোক্তারা। ব্যাংক সুদ আকর্ষণীয় না হওয়ায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বেড়েছে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়নের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাগুলো দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নতুন নেতৃত্বের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে

প্রায় নয় বছর পর মে মাসে নতুন নেতৃত্ব পায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে চার বছরের জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয় সরকার। অনেক দেরিতে হলেও কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থাসহ পুঁজিবাজারের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় নতুন কমিশন। আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান বলেন, পুঁজিবাজারের কারসাজির বিষয়ে কমিশনের শক্ত ভূমিকা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া অনেক সমালোচনার মুখেও আগের কমিশনের বেঁধে দেওয়া শেয়ারের সর্বনিম্ন দরের সীমা উঠিয়ে দেয়নি নতুন কমিশন। এটা শেষ পর্যন্ত কাজে লেগেছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

আহমেদ রশিদ লালী বলেন, সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দেওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা ‘স্বস্তি’ ফিরে আসে। কারণ এর মাধ্যমে একটা বিষয় নিশ্চিত হয় যে, লোকসান নির্দিষ্ট অংকের বেশি হবে না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর প্রতি মাসের বিনিয়োগ নজরদারির একটা নিয়ম চালু করে নতুন কমিশন, যার ফলে পুঁজিবাজারে টাকার যোগান কিছুটা বাড়ে। এছাড়া উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ারধারণে বাধ্য করতে বিএসইসির কড়াকড়ির ফলে শেয়ারের চাহিদা বেড়ে যায় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতেও ভূমিকা রাখে।

এদিকে বিএসইসি ২০২০ সালে প্রায় ১৫টি আইপিওর অনুমোদন দিয়েছে। এর ফলে পুঁজিবাজারে বেশ কিছু টাকা বিনিয়োগ এসেছে। শর্ত পূরণ করতে না পারায় বেশ কিছু আইপিও বাতিল করেছে বিএসইসি, যার ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজে বিনিয়োগ থেকে ‘বেঁচে যায়’। বিনিয়োগকারীদের আটকে থাকা অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নেয় বিএসইসি। কমিশনের পক্ষ থেকে বিলম্বিত হলেও বহুল প্রত্যাশিত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের ফলে আসছে বছর নিয়েও আশাবাদী পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। ডিএসই পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ২০২১ সালে দেশের পুঁজিবাজার ২০২০ সালের চেয়ে ভালো করবে। বন্ড মার্কেট ভালো হবে, এসএমই বোর্ড চালু হবে। ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হবে।
এদিকে মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপে সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও বিদায়ের পথে থাকা ২০২০ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করেছেন উদ্যোক্তারা। আগের বছরের তুলনায় এ বছর আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তিনগুণের বেশি অর্থ নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। এমনকি গত তিন বছরে সম্মিলিতভাবে যে পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে, শুধু ২০২০ সালেই তার থেকে বেশি অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে।

অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেয়ার পর আবার আইপিও মার্কেট সরগরম হয়ে ওঠে। তার নেতৃত্বাধীন কমিশন একের পর এক প্রতিষ্ঠানের আইপিও দিতে থাকে। ফলে মাত্র সাত মাসেই রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের সুযোগ পেয়ে যান উদ্যোক্তারা। তথ্য পর্যালোনায় দেখা যায়, ২০২০ সালে স্থির মূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে ৫টি এবং বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৩টি কোম্পানি আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করেছে। সম্মেলিতভাবে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭০৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রিমিয়াম বাবদ তিনটি কোম্পানি নিয়েছে এক হাজার ৩৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

এর আগে ২০১৯ সালে স্থির মূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে ৫টি এবং বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৩টি কোম্পানি অর্থাৎ ৮টি প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে আইপিও’র মাধ্যমে ৫৫২ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। তার আগে ২০১৮ সালে ১৪টি প্রতিষ্ঠান ৬০১ কোটি ৭৫ লাখ, ২০১৭ সালে ৮টি প্রতিষ্ঠান ২৪৯ কোটি ২৫ লাখ এবং ২০১৬ সালে ১১টি প্রতিষ্ঠান ৮৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা উত্তোলন করে। এ হিসাবে ২০২০ সালে আইপিও’র মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন হলেও আইপিওতে আসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়েনি। স্বল্প সংখ্যক প্রতিষ্ঠান আসার পরও আইপিওতে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন এবং রবি আজিয়াটা লিমিটেড। এই দুই প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বড় ভূমিকা রেখেছে মীর আখতার হোসেন। এর মধ্যে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন আইপিও’র মাধ্যমে সংগ্রহ করেছে ৮৮৬ কোটি ৪৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রিমিয়াম হিসেবেই নিয়েছে ৮৪৬ কোটি ১৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। আর স্থির মূল্যে বা ১০ টাকা করে শেয়ার বিক্রি করা রবি উত্তোলন করেছে ৫২৩ কোটি ৭৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। অবকাঠামো খাতের প্রতিষ্ঠান মীর আখার আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে থেকে নিয়েছে ১১২ কোটি ১৬ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রিমিয়াম রয়েছে ৯১ কোটি ৩৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। প্রিমিয়াম নিয়ে আসা আর এক কোম্পানি ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ আইপিও’র মাধ্যমে সংগ্রহ করেছে ৯৯ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রিমিয়াম আছে ৯৭ কোটি ৭ লাখ ১৬ হাজার টাকা। বছরটিতে আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স ২৬ কোটি ৭ লাখ ৯০ হাজার, অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন ১৫ কোটি, ডমিনেজ স্টিল বিল্ডিং ৩০ কোটি এবং ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে।

বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই মাস ধরে বেশকিছু বড় বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে সক্রিয় হয়েছেন। প্রতিনিয়ত তারা শেয়ারবাজারে লেনদেন করছেন। এসব বিনিয়োগকারীর বড় অংশই বেশকিছুদিন বাজারে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। বড় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও বাজারে তাদের অংশগ্রহণ বাড়িয়েছেন। বিদেশীদের পোর্টফোলিও নিয়ে কাজ করেন এমন একটি ব্রোকারেজ হাউজের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, অনেকদিন ধরেই বিদেশী বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপ ছিল। চলতি মাসে তাদের শেয়ার বিক্রির চাপ কিছুটা কমেছে। বিক্রির বদলে এখন তারা শেয়ার কেনায় বেশি মনোযোগী। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি তারাও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

https://dailysangram.com/post/439223