২ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ৩:৩৯

বন্দুকযুদ্ধে ১৮৮ জন এবং বিএসএফের গুলীতে ৪৯ বাংলাদেশী নিহত

টেকনাফে পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যুর পর বিদায়ী বছরে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা কিছুটা কমে এসেছিল। তারপরও সদ্য সমাপ্ত বছরে (২০২০ সাল) দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ১৮৮ জন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের গুলী ও নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ৪৯ বাংলাদেশী। এসময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৬২৭ নারী ও শিশু।

অভিযোগ আছে, বন্দুকযুদ্ধে ও হেফাজতে মৃত্যু এবং নির্যাতনের বিষয়ে বিচার চেয়েও অনেক ঘটনায় প্রতিকার পায়নি ভুক্তভুগী পরিবার। অনেক ক্ষেত্রে বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করার পর ভুক্তভুগী একাধিক পরিবার হুমকির শিকার হয়েছেন। পুলিশি নির্যাতনে আহত হলেও ভুক্তভোগীরা অনেকে মামলা করেন না। তবে এসব ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে বলে পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের চাকরিচ্যুত, পদোন্নতি স্থগিত ও পদাবনতির মতো শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের আটক করে আইনের হাতে তুলে দেয়া হয়। পুলিশ সদরদফতর থেকে বলা হয়েছে- কোনো সদস্যের অপকর্মের দায় পুরো বাহিনীর ওপর চাপানো সঠিক সয়। কোনো সদস্যের অপকর্মের দায়ভার পুরো বাহিনী বহন করবে না। অপরাধী সে যেই হোক তাকে শাস্তি পেতে হবে।

এদিকে বৃহস্পতিবার মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ২০২০ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ১৮৮ জন। মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছেন ১১২ জন। সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আসক সদস্য আবু আহমেদ ফজলুল কবির। এতে জানানো হয়, বছর জুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নিহত হয়েছেন ১১ জন। গ্রেফতারের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে মারা গেছেন ১৩ জন। অসুস্থতাসহ নানা কারণে দেশের কারাগারগুলোতে মারা গেছেন ৭৫ জন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের গুলী ও নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ৪৯ বাংলাদেশি।

গত ১০ অক্টোবর রাতে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান উদ্দিন আহমেদ নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ (সাময়িক বরখাস্ত) এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়ার নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যু হয়। ঘটনার পর এসআই আকবর পালিয়ে গেলেও পরে পরে ধরা পড়ে। এ মামলা তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। রায়হানের মৃত্যুর বিষয়ে তার পরিবার জানায়, ৯ অক্টোবর পুলিশ তাকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে ১০ হাজার টাকা ঘুষ চায়। বলা হয়, টাকা দিলে ছেড়ে দেয়া হবে। পরদিন মোবাইল ফোনে বিষয়টি জানার পর রায়হানের মা তার চাচাকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে ওই পুলিশ ফাঁড়িতে পাঠান। কিন্তু পুলিশ তা নিতে রাজি হয়নি। পরে ১০ হাজার টাকা নিয়ে যাওয়া হলেও ততক্ষণে নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যু হয়। মারা যাওয়ার পর রায়হানের শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তার হাতের নখ উপড়ানো ছিল। এ ঘটনার পর পুলিশের বিরুদ্ধে হেফাজতে নির্যাতন করে রায়হানকে মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে। রায়হানের মৃত্যুর জন্য দায়িত্বহীনতার দায়ে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। এরমধ্যে এসআই আকবর হোসেন পুলিশ লাইন থেকে পালিয়ে যায়। তদন্তে নেমে পুলিশ হেফাজতে রায়হান উদ্দিনের মৃত্যু ও নির্যাতনের প্রাথমিক সত্যতাও পায় এসএমপির তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি জানতে পারে ভোর ৩টার দিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় রায়হানকে আনা হয় বন্দরবাজার ফাঁড়িতে। সেখানে ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবরের নেতৃত্বেই তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে রায়হানকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন বন্দরবাজার ফাঁড়ির এএসআই আশেকে এলাহী। ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে মারা যান তিনি। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার করেছে। তিন ঘন্টার ফুটেজ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশের হাতে আটকের পর ফাঁড়িতে নিয়ে নির্যাতনের কারণেই রায়হানের মৃত্যু হয়েছে।

এরআগে গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মারিশবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিও চিত্র ধারণ করে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপসহ ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়। সেই মামলায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যকেও যুক্ত করা হয়। পরে এ মামলায় আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫তে। সম্প্রতি টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেয় র‌্যাব। চার্জশিটে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। রাষ্ট্রপক্ষের প্রত্যাশা আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারার অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হবেন। চার্জশিটে কক্সবাজার জেলার তখনকার পুলিশ সুপারের (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসাইনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এদিকে সিনহা হত্যা মামলা বাতিল চেয়ে প্রধান আসামি ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীর করা রিভিশন মামলা খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। এছাড়া শিপ্রা ও সিফাতের মাদক মামলারও সত্যতা পায়নি তদন্ত কর্মকর্তা। এই ১৫ আসামির মধ্যে ৯ জন টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্য, তিন জন এপিবিএন’র বরখাস্ত হওয়া সদস্য এবং তিন জন বেসামরিক ব্যক্তি। ১৫ জনের মধ্যে ১৪ জন কারাগারে আছেন। একজন পলাতক। কারাগারে থাকা ১৪ জনের মধ্যে ১২ জন তাদের নিজ নিজ দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

এদিকে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত দাবি করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এক বিবৃতিতে আসক জানায়, সিলটে রায়হানের মৃত্যুর রেশ না কাটতেই ১৩ অক্টোবর ঢাকার নবাবগঞ্জ থানা হাজতে মামুন মিয়া নামের আরেক অটোরিকশা চালকের মৃত্যু হয়। গত ক’দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে সংস্থাটি। আসকের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব মো. নূর খান স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে বলা হয়, গত ১১ অক্টোবর সকালে নবাবগঞ্জ উপজেলার নয়নশ্রী ইউনিয়নের দেওতলার খ্রিস্টানপল্লির বাঁশঝাড় থেকে অজ্ঞাত এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, পরদিন ১২ অক্টোবর ওই নারীর স্বজনরা অটোরিকশা চালক মামুনকে সন্দেহভাজন হিসেবে মারধর করে শ্রীনগর থানায় সোপর্দ করে। ১৩ অক্টোবর সকালে নবাবগঞ্জ থানা পুলিশের কাছে আসামীকে হস্তান্তর করা হয়। এরপর থানা পুলিশ তাকে আদালতে পাঠানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই ফাঁকে আসামী মামুনকে তার পরিহিত লুঙ্গি দিয়ে হাজতখানার ভেতর টয়লেটের জানালার সঙ্গে ফাঁস দিয়ে ঝুলে থাকতে দেখে পুলিশ। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরিবারের সদস্যরা জানান, পুলিশ গত ১২ অক্টোবর সন্ধ্যায় মামুনকে আটক করলেও ১৩ অক্টোবর দুপুর পর্যন্ত তাকে আদালতে পাঠানো হয়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে নবাবগঞ্জ থানা হাজতের সিসি ক্যামেরার একটি ফুটেজ দেখানো হয়, যেখানে মামুনকে বাথরুমে যেতে দেখা গেছে। কিন্তু ওই ফুটেজের সম্পূর্ণ অংশ দেখতে চাইলে পুলিশ তা দেখায়নি। এছাড়া সন্ধ্যায় পরিবারের লোকজন মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে গেলেও তাদের লাশ দেখতে দেওয়া হয়নি। এসব কারণে নিহতের পরিবারের অভিযোগ, মামুনের মৃত্যুর বিষয়ে পুলিশ যে বক্তব্য দিচ্ছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা খতিয়ে দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে আসক বলে, দুই সপ্তাহে রাজধানীর পল্টন ও নবাবগঞ্জ থানা, সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি এবং রংপুরের গঙ্গাচড়া থানা হেফাজতে চার জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আসক মনে করে, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর মতো ঘটনা নিরসনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা দরকার।

২৮ সেপ্টেম্বর বাগেরহাটে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবি আই) হেফাজতে রাজা ফকির নামে এক আসামীর মৃত্যু হয়। রাজার পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ হেফাজতে তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার পল্টন থানা হেফাজতে মাসুদ রানা নামে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। একই দিনে রংপুরের গঙ্গাচড়া থানা হেফাজতে নির্যাতনের কারণে এজারুল নামে এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। বছরের শুরুতে ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার হাজতে আবু বক্কর সিদ্দিক বাবু (৩৫) নামে একজন আসামী মারা যান। পুলিশ বলছে, ঐ আসামি হাজতের গ্রিলের সঙ্গে চাদর পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে গ্রিলের সঙ্গে চাদর পেঁচিয়ে আত্মহত্যার বিষয়টি মানতে রাজি নন নিহত বাবুর সহকর্মীরা। বাবু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) ফ্লোর ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে একজন নারী ডিজিটাল নিরাপত্তা ও নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেছিলেন। ঐ মামলাতেই গত ১৮ জানুয়ারি রাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বাবুর মৃত্যুর ঘটনার বিচার চেয়ে এফডিসির সহকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। ঘটনাটি তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

এদিকে বিদায়ী বছরে (২০২০ সাল) ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৬২৭ নারী ও শিশু। ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছে ৫৩ জন। ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করেছে ১৪ জন। এর আগের বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১ হাজার ৪১৩ নারী, তার আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৭৩২। তা ছাড়া বিদায়ী বছরে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে ২০১ নারী ও শিশু। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন ১০৬ পুরুষ, আত্মহত্যা করেছেন ১৪ নারী, খুন হয়েছেন তিন নারীসহ ১৪ জন। এ ছাড়া পোশাকশিল্পের ৬০ থেকে ৬৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন।

https://dailysangram.com/post/439243