রাজশাহী: শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই (বামে) মহানন্দার শুকিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। (ডানে) চরাঞ্চলে বসানো হচ্ছে পাতকুয়া -সংগ্রাম
২ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ৩:৩৮

বরেন্দ্র অঞ্চলে বাড়ছে পানির সংকট ॥ চরে বসছে পাতকুয়া

শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সেচ সংকটের পাশাপাশি খাওয়ার পানিরও সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষদের। এবার এই সংকটের কিছুটা লাঘব করতে চরগুলোতে বসানো হচ্ছে পাতকুয়া।

ফারাক্কাসহ ভারতীয় বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে গঙ্গা-পদ্মায় এমনিতেই পানির সংকট চলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে নামছে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পানির অনিশ্চয়তা বাড়ছে। শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামতে শুরু করেছে। ফলে অকেজো হয়ে পড়ছে এ অঞ্চলের হাজার হাজার টিউবওয়েল। এতে বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়ছেন মানুষ। এ সংকট বর্ষাকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পানি সংকটের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চল চাষাবাদ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বছর শীত শেষ হলেই এই অঞ্চলের হাজার হাজার টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। প্রায় ১০ বছর ধরেই এমন হচ্ছে। অনেকের বাড়ির টিউবওয়েল পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়েছে। গ্রীষ্মে পানিশূন্য হয়ে পড়ে কূয়াগুলোও। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। আর কিছুটা তাপপ্রবাহ শুরু হলেই এ অঞ্চলের খাল-বিল, পুকুরঘাট শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। এবার শীত শুরু হতে না হতেই এ অবস্থা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় এখন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ থেকে সরবরাহ করা পানিই প্রধান ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানেও দেখা দিয়েছে সমস্যা। বিএমডিএ’র আওতাধীন নলকূপও পানির অভাবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। নষ্ট হওয়ার পথে আরও অনেক গভীর নলকুপ।

বিএমডিএ’র একটি সূত্র জানায়, বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু এলাকা হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, রহনপুর, নওগাঁর পোরশা, নিয়ামতপুর ও পত্নীতলা উপজেলায় এক যুগ আগে ৭০ থেকে ৮০ ফুট নিচে পানি পাওয়া যেতো। এখন তা নেমে ১৪০ থেকে ১৬০ ফুট নিচে চলে গেছে। পানির স্তর নিচে নামার ফলে বাড়িতে বসানো টিউবওয়েলগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। মাত্র এক দশক আগেও বরেন্দ্র অঞ্চলের খালবিল, নদীনালাগুলো সারা বছরই পানিতে পরিপূর্ণ থাকত। প্রতিটি বাড়িতে ছিল নলকূপ ও কুয়া। তবে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অকেজো হয়ে পড়েছে আগের টিউবওয়েলগুলো। নতুন টিউবওয়েল বসাতে হলে ১৩০ ফুট নিচে না গেলে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এখন তাদের বিএমডিএ’র গভীর নলকূপ থেকে পানির চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় বিদ্যুৎচালিত গভীর নলকূপের পাশে বড় বড় পানির ট্যাঙ্ক বসিয়ে গ্রামে গ্রামে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের চেষ্টা করা হচ্ছে।

এদিকে পানির সংকট কিছুটা হলেও লাঘব করতে রাজশাহীর পদ্মার চর এলাকায় পাতকূয়া স্থাপন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের নিচ পর্যন্ত গোলাকার আকৃতিতে মাটি খনন করে চারপাশ থেকে চুয়ানো পানি ধরে রাখার আধার। আধুনিক প্রযুক্তি আসার আগে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ রাজশাহীর গ্রামে সুপেয় পানির নির্ভরযোগ্য আধার ছিল পাতকুয়া। নলকূপসহ পানি উত্তোলনের বিভিন্ন প্রযুক্তি আসার পর পাতকুয়ার ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। এ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামতে থাকায় চাপ কমাতে বিকল্প পদ্ধতির এই পাতকূয়া স্থাপনের প্রয়োজন অনুভব করা হয়। তবে আগে বালতি ও রশি দিয়ে পানি উত্তোলন হতো। এখন সৌর প্যানেলের মাধ্যমে যান্ত্রিকভাবে সেচকাজে ব্যবহার হচ্ছে এই পাতকূয়ার পানি। বিএমডিএ সূত্রে জানা যায়, রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের চর মাঝারদিয়াড়ে পাতকূয়া ও সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। ফলে জলাবদ্ধতা নিরসন ও পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় এখানে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয়েছে। এই পানি ব্যবহার করছে প্রায় ৮ হাজার মানুষ। ফলে স্বল্প খরচে পদ্মার চরে পানির নিশ্চয়তা, খাদ্য ও সবুজায়ন সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বিএমডিএ’র একজন কর্মকর্তা জানান, চরাঞ্চলের মানুষের জীবনে এ প্রকল্প আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। পাতকুয়া ব্যবহারে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি ব্যবহার করা সম্ভব। এই পানি গ্রামের মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজসহ কৃষি কাজে ব্যবহার করতে পারেন।

https://dailysangram.com/post/439240