১ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১১:৫৬

আল কুরআনে অর্থনীতি : ১০

সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিকানা

শাহ্ আব্দুল হান্নান

‘তারা বলল, হে শুয়াইব, তোমার নামাজ কি এটাই শিক্ষা দেয় যে, আমরা এসব মাবুদ পরিত্যাগ করব যাদের ইবাদত আমাদের বাপ-দাদারা করতেন? অথবা আমাদের ধন-সম্পদে ইচ্ছামতো যা কিছু আমরা করে থাকি তা ছেড়ে দেবো? শুধু তুমিই একজন মহৎ ও সৎ ব্যক্তি থেকে গেলে।’ (সূরা হুদ : ৮৭)

তাফসিরকারদের আলোচনা
এ আয়াতের আলোচনা প্রসঙ্গে মুহাম্মদ শফী লিখেছেন : ওদের এসব মন্তব্য দ্বারা বোঝা যায়, ওরা ধর্মকে শুধু কিছু আচার-আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করত। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ধর্মকে কোনো স্থান দিত না। তারা মনে করত, প্রত্যেকে নিজ নিজ ধন-সম্পদ যেমন খুশি ভোগ-দখল করতে পারে; এ ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করা ধর্মের কাজ নয়, যেমন বর্তমান যুগেও কোনো কোনো অবুঝ লোকের মধ্যে এহেন চিন্তাধারা পরিলক্ষিত হয়।
(মাআরেফুল কুরআন, সূরা হুদের ৮৭ নং আয়াতের তাফসির)

এ আয়াতের আলোচনা প্রসঙ্গে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী লিখেছেন, এটাই জুলুমের বিরুদ্ধে জাহিলিয়াতের মতাদর্শের স্পষ্ট প্রকাশ। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, আল্লাহর দাসত্ব ছাড়া যে পথ-পন্থাই গৃহীত হবে সেটিই ভুল এবং তার অনুসরণ করা কিছুতেই উচিত নয়। কেননা অপর কোনো পথ ও পন্থার সপক্ষে জ্ঞান-বুদ্ধি, বিদ্যা-বিজ্ঞান ও আসমানি কিতাবে কোনো-ই দলিল বা প্রমাণ নেই। আর দ্বিতীয়ত, আল্লাহর বন্দেগি শুধু একটি সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়- হওয়া উচিত নয়। বরং তামাদ্দুন বা সংস্কৃতি, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির মতো জীবনের সব ক্ষেত্রেই আল্লাহর দাসত্ব বাস্তবায়িত করতে হবে। কেননা দুনিয়ার মানুষের কাছে যা কিছু আছে তা সবই আল্লøাহর। মানুষ কোনো জিনিসেরই ওপর আল্লাহর মর্জি থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ইচ্ছামূলক হস্তক্ষেপ করার অধিকারী নয়।

জাহিলিয়াতের মত ও পথ এর বিপরীত। তা হলো, বাপ-দাদার আমল থেকে যে রীতি ও পন্থা চলে এসেছে, তা-ই মানুষের পালন করে চলা কর্তব্য। আর তা মেনে চলার ব্যাপারে এর অতিরিক্ত অপর কোনো দলিলের প্রয়োজনই নেই যে, বাপ-দাদার নিয়ম ও পন্থা। উপরন্তু, দ্বীন ও ধর্ম বলতে শুধু পূজা-উপাসনালয়ই বোঝায়। জীবনের সাধারণ ব্যাপারে তোমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা আবশ্যক, আমরা সেখানে যা ইচ্ছা তাই করবার অধিকারী।

এ থেকে এ কথাও ধারণা করা যায়, জীবনকে ধর্মীয় ও বৈষয়িক এই দুই স্বতন্ত্র বৃত্তে বিভক্ত করা কোনো নতুন ধারণা নয়। তিন সাড়ে তিন হাজার বছর আগে হজরত শুয়াইব আ:-এর জাতিও এরূপ ভাগবাটোয়ারা করারই দাবি জানিয়েছিল, যেমন বর্তমানের পাশ্চাত্য জগৎ তাদের প্রাচ্য শাগরেদরা দাবি জানাচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে, এটা কোনো নতুন আলো নয় এবং আজো মানসিক অবস্থা ও মননশীলতা বিকাশের ফলে জানা যাচ্ছে না। বরং আসলে এটা তো অতি পুরনো কথা। হাজার বছর আগেকার জাহিলিয়াতেও এটা এরূপ প্রচারিত হয়েছিল এবং এর বিরুদ্ধে ইসলামের প্রবল ভূমিকা-সংগ্রামও পৃথিবীতে নতুন নয়। বরং এটাও অতি প্রাচীন ব্যাপার। (সূরা হুদের তাফসির, ৯৭ নং টিকা)

অর্থনৈতিক তাৎপর্য
ইসলামের অর্থনৈতিক দর্শনের জন্য এটি একটি দিকনির্দেশকারী আয়াত। এ আয়াতে স্পষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। শুয়াইব আ:-এর কওম মনে করত, তাদের কাছে যে সম্পদ রয়েছে তার নিরঙ্কুুশ মালিক তারা নিজেরাই এবং তারা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ধন-সম্পদ ব্যবহার করতে পারবে। এ ব্যাপারে তারা কোনো ধর্মীয় আইনের বা সৃষ্টিকর্তার বিধানের অধীন নয়। নামাজের সাথে বা ধর্মীয় ইবাদতের সাথে অর্থনৈতিক কায়কারবারের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারেÑ তা তারা বুঝতেও পারত না, মানতেও চাইত না। হজরত শুয়াইবকে এ জন্য তারা উপহাস করেছিল। কিন্তু কুরআন বলছে, আল্লাহর বিধানে এ ধরনের চিন্তার কোনো সমর্থন নেই। ইসলাম ধর্মকে এবং আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে আলাদা এবং সম্পর্কবর্জিত মনে করে না। ইসলামের মতে, জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধিনিষেধের প্রয়োগ থাকবে। জীবনকে কৃত্রিমভাবে ভাগ করা কুরআন স্বীকার করে না। আল্লাহ ও নবীর আনুগত্য না করা এবং সর্বপ্রকার বিধি-নির্দেশই অমান্য করা নিঃসন্দেহে নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে কুরআনের সংশ্লিষ্ট কিছু আয়াত নিম্নে উল্লেøখ করা হলোÑ

হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ^াস করো, তবে তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের...। (সূরা নিসা : ৫৯) বিধান দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লøাহরই। (সূরা ইউসুফ : ৪০) জেনে রাখো, সৃষ্টি তার (আল্লাহর) এবং আদেশ দেয়ার অধিকারও তারই। (সূরা আরাফ : ৫৪)

‘তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমাদের কাছে যা অবতীর্ণ হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ করো। (সূরা আরাফ : ৩) ‘আল্লøাহ যা বিধান দিয়েছেন, সে মোতাবেক যারা সঠিক বিচার করে না তারা কাফির, জালিম তারা ফাসিক। (সূরা মায়িদা : ৪৩, ৪৫ ও ৪৭) এসব আয়াতে সুস্পষ্ট হয়, অর্থনৈতিক জীবনও আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর নির্দেশের অধীন হবে। আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের বেলায় কোনো শর্তারোপ করা হয়নি; অর্থাৎ নিঃশর্তভাবে আল্লাহ ও রাসূলের বিধান ব্যক্তিজীবন থেকে আরম্ভ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মেনে চলতে হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি প্রযোজ্য ইসলামের বিধান মেনে চলতে বাধ্য।

মুসলিম রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব জাতীয় অর্থনীতি প্রসঙ্গে ইসলামের বিধান ও লক্ষ্যের কাঠামোতে নীতিনির্ধারণ এবং তার বাস্তবায়ন করা। বর্তমানকালে সারা বিশে^ই ইসলামী অর্থনীতিকে সমাজ বিজ্ঞানরূপে বিশ্লেষণ করার গবেষণা চলছে। সে দিক থেকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, আলোচ্য আয়াতে একটি গভীর মৌল নির্দেশনা রয়েছে। আধুনিককালের অমুসলিম অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতিকে দু’ভাগে ভাগ করে বিবেচনা করে থাকেন। একভাবে হলোÑ ঢ়ড়ংরঃরাব বপড়হড়সরপং অর্থাৎ, যা যেমন আছে (ঝড়সবঃযরহম রং ধং রঃ রং ) তারই রূপ প্রদর্শন। অন্যভাবে হলোÑ ঘড়ৎসধঃরাব বপড়হড়সরপব অর্থাৎ যেমন এর থাকা বাঞ্ছনীয় (অং রঃ ংযড়ঁষফ নব). পরবর্তী ভাগে সাধারণত কোনো সমস্যার বিশ্লেষণ করে সমাধানের সুপারিশ পরিবেশনের প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো মূল্যবোধ আগে থেকেই প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্যভাবে ধর্তব্য থাকে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ভালো-মন্দ বিচার করে সমাজের জন্য বা কোনো পণ্যের মূল্য নির্ধারণ বা বিপন্ন ইত্যাদি ব্যাপারে সুপারিশ পরিবেশনের চেষ্টা হয়। আর চড়ংরঃরাব বপড়হড়সরপং-এর ব্যাপারে কোনো বিষয়ে কিছু ঘটনা ঘটা বা কোনো আচরণকে উপলব্ধি করার জন্য প্রথমে একটা সম্ভাব্য কারণ চিন্তা করতে হয়। তাকে যুঢ়ড়ঃযবংরং ধরে নিয়ে তার কাঠামোতে যুক্তি দাঁড় করা হয়। সে যুক্তিবাদ দিয়ে যদি ঘটনা বা আচরণের কারণকে বিশ^াস্য বলে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তাহলে সেই আগের ধর্তব্য কারণই তত্ত্ববাদের যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য সত্যে পরিণত হয়। কিন্তু সে গ্রহণযোগ্যতা সাময়িক। অন্য তত্ত্ববাদী ভিন্ন রকম যুক্তি দাঁড় করিয়ে গৃহীত তত্ত্বকে ভুল প্রমাণও করতে পারেন। তখন পরবর্তী তত্ত্বটিই নতুন সত্যে পরিণত হবে আর আগেরটি বর্জিত হবে। এমন পদ্ধতি সে কারণেই কোনো অপার্থিব সত্তার দেয়া সৃষ্টিজগতের বিধানের প্রতি বিশ^াসকেও প্রশ্নাতীত মনে করে না। তখন জ্ঞান ও তত্ত্ব সবকিছু ধর্মনিরপেক্ষই শুধু হয় না, দিকনির্দেশনাহীন এবং লক্ষ্যহীন হয়ে পড়ে। সে জন্যই জ্ঞানকে ধ্বংসের ও অকল্যাণের লক্ষ্যে ব্যবহার করা হতে থাকে।

আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ অর্থনীতি, অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানকে মানুষের অর্থনীতি-বহির্ভূত সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধচেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিজ্ঞানের রূপ দিয়েছে। কিন্তু সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ বর্জিত তত্ত্বজ্ঞান বা তার ব্যবহারকে মানুষের জীবনোপযোগী করার জন্য কোনো পদ্ধতি সংস্কার করেনি। সে সংস্কার সম্ভব শুধু নৈতিক ও ইসলামী মৌল বিশ^াস এবং বিধানের ধর্তব্যকে আর ভাব-ধারণাকে অনুশীলন ও গবেষণার অন্তর্গত করে।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/552865