১ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১১:৫৫

ডা. মঈন ছিলেন দুঃসময়ের ভরসা

করোনাভাইরাসের আগ্রাসনের শুরুতে সারা দেশের মতো সিলেটেও তখন আতঙ্কে থমথমে অবস্থা। এর মধ্যেই রোগীর সেবায় তিনি ছিলেন অবিচল। কিন্তু একসময় করোনায় আক্রান্ত হন, এরপর ১০ দিনের মধ্যেই মারা যান। দেশে চিকিৎসকদের মধ্যে তিনিই প্রথম করোনায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘গরিবের ডাক্তার’, ছাত্রদের কাছে বাবার মতো, অভিভাবকের মতো। সহকর্মীরাও সময়ে-দুঃসময়ে তাঁর ওপরই ভরসা করতেন। তিনি ডা. মো. মঈন উদ্দিন।

গত ৮ মার্চ দেশে করোনা রোগী শনাক্তের খবর দেয় সরকার। ৫ এপ্রিল বিকেলে জানা যায়, সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। সিলেটে করোনা আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। শুরুতে তাঁকে বাসায় রেখেই চিকিৎসার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ৭ এপ্রিল তাঁর অবস্থার অবনতি হলে সিলেটে শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। পরিবারের সিদ্ধান্তে পরদিন বিকেলে তাঁকে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ১৫ এপ্রিল ভোর ৬টা ৪৫ মিনিটে তিনি মারা যান।

ডা. মঈন উদ্দিনের জন্ম সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার নাদামপুর গ্রামে। সেখানেই মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করে ভর্তি হন সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজে। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে যোগ দেন। মেডিসিন বিষয়ে এফসিপিএস, কার্ডিওলজি বিষয়ে এমডি ডিগ্রিধারী ডা. মঈনের বাবা মুনশি আহমদ উদ্দিন ছিলেন একজন পল্লী চিকিৎসক। মৃত্যুর আগে বাবা বলে গিয়েছিলেন এলাকার অসহায় রোগীদের যেন সেবা দেন ছেলে। আমৃত্যু বাবার সেই নির্দেশ পালন করে গেছেন তিনি। বাবার কথা রাখতে প্রতি শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনে সিলেট থেকে ছুটে যেতেন গ্রামে। গরিব রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতেন বিনা মূল্যে। অসহায় রোগীদের ওষুধও দিতেন বিনা মূল্যে। বিভিন্ন সময়ে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পও করেছেন সেখানে। এভাবেই একটা সময় ‘গরিবের ডাক্তার’ হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। এরপর সে গণ্ডি পেরিয়ে সিলেট নগরেও তিনি একই পরিচিতি পান।

ডা. মঈন উদ্দিনের স্ত্রী চৌধুরী রিফাত জাহানও একজন চিকিৎসক। সিলেটের পার্কভিউ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক। তাঁদের দুই ছেলের বড়টির বয়স ১১ বছর। ছোট ছেলের আট।

মঈন উদ্দিনের স্ত্রী কালের কণ্ঠকে বলেন, দুই সন্তানকে নিয়েই তাঁর ভবিষ্যৎ। ছোট ছেলে প্রায়ই বাবার জন্য কাঁদে জানিয়ে রিফাত জাহান বলেন, তখন তিনি সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেন। স্বামীর স্মৃতি প্রতিনিয়তই তাঁকে তাড়া করে।

ডা. মঈনের ভায়রা ভাই মো. খসরুজ্জামান বলেন, ছোট ছেলেকে এখনো বোঝানো যাচ্ছে না যে তার বাবা নেই। মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে। আর রাগলেই বলে সে তার বাবার কাছে চলে যাবে।

মঈন উদ্দিনের গ্রাম এলাকার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক আছকির মিয়া মহৎ এই চিকিৎসকের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘এলাকার অসহায় হিন্দু-মুসলিম সবাই ডা. মঈন উদ্দিনের কাছ থেকে বিনা মূল্যে সেবা পেয়েছেন।’

গ্রামের বাসিন্দা গিরিধর দাস বলেন, ‘ডা. মঈন ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ।’

স্থানীয় মুরব্বি সোহেল আহমদ স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘এলাকার কোনো রোগী মঈনের সিলেটের চেম্বারে গেলেও তিনি তাদের ফ্রি দেখতেন।’

সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক ডা. মঈন তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/01/01/991000