প্রতীকী ছবি
১ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১১:৫২

ফিরে দেখা ২০২০

খেলাপি ঋণ থেমে থাকার বছর

দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি -ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ব্যাংকিং খাতের জন্য দুর্যোগপূর্ণ বছর -খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

করোনাভাইরাস মহামারীকালে ঋণ খেলাপি হওয়া থেকে মাফ পেয়েছেন গ্রাহকরা। দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্টে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণ অবলোপন ও কিছু গ্রাহকের সুদ স্থগিত কার্যক্রম হওয়াসহ বিভিন্ন সুবিধায় খেলাপি ঋণ স্থির রয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন বিশেষ সুবিধা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক খাতের বিষফোঁড়া খেলাপি ঋণের বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, করোনায় যথেষ্ট নীতি সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা বেড়েছে।

তবে খেলাপি ঋণসহ যেসব সমস্যা দীর্ঘদিনের সেটার তার কোনো সমাধান হয়নি। সব সমস্যা স্থবির হয়ে আছে। এসব সমস্যা ভবিষ্যতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

এখন ঘোষিত প্রণোদনা শতভাগ বাস্তবায়ন করা উচিত। এছাড়া ব্যাংকগুলোকেও গ্রাহকের পাশে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ২০২০ সাল ছিল ব্যাংকিং খাতের জন্য দুর্যোগপূর্ণ বছর। ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে।

এতে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে থাকা খেলাপি ঋণ এক সময় বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। এছাড়া করোনার অজুহাতে কাউকে খেলাপি করা হয়নি। এটা যখন বিস্ফোরণ ঘটবে। পুরো খাতের পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শেষে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি ৪৭ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণ।

যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। তবে আগের অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন) তুলনায় এক হাজার ৭২৬ কোটি টাকা কম। সে প্রান্তিকে খেলাপি ছিল ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা।

আর ২০১৯ সালের তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শেষে এ খেলাপির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ ২১ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা কমেছে।

পলিসি রিচার্স ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক, অর্থনীতির বিশ্লেষক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, প্রণোদনায় কলকারখানা সচল হয়েছে। অর্থনীতিও কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া বছরজুড়ে কাউকে খেলাপি করা হয়নি। তারল্য ঠিক রাখতে অনেক নীতিসহায়তা দেয়া হয়েছে। তবে আপাত দৃষ্টিতে ব্যাংকিং খাতকে ঠিক দেখালেও ভেতরের অবস্থা ভালো না। সেজন্য সজাগ থাকতে হবে। দুর্বল প্রতিষ্ঠান পড়ে যেতে পারে।

২০২০ সালের মার্চ থেকে দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। এ সংকটকালে ঋণ গ্রহীতাদের বিশেষ সুবিধা দিয়েছে সরকার। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও কাউকে খেলাপি করা যাবে না।

সে সুযোগ ঋণখেলাপিরাও পেয়েছেন। অর্থাৎ ২০২০ সালজুড়ে কোনো ঋণের শ্রেণিমান পরিবর্তন করা যাবে না। যে ঋণ যে শ্রেণিতে আছে, সে অবস্থাতেই থাকবে।

যদি কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো ঋণের কিস্তি বা খেলাপি ঋণ পরিশোধ করতে চান, তাহলে করতে পারবেন।

সব ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশ : ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে সব ধরনের ঋণ ও বিনিয়োগের ওপর সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশের বেশি না নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরই মধ্যে বেশির ভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের ঋণ ও বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট (এক অঙ্ক) কার্যকর করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় আরও বলা হয়, গ্রাহক কোনো কারণে খেলাপি হলে ওই সময়ের জন্য ঋণের স্থিতি বা কিস্তির বিপরীতে ৯ শতাংশের বাইরে অতিরিক্ত আরও ২ শতাংশ দণ্ডসুদ আরোপ করা যাবে।

এর বাইরে ঋণের বিপরীতে অন্য কোনো সুদ বা মুনাফা আরোপ করা যাবে না।

প্রিমিয়ার লিজিংয়ে প্রশাসক নিয়োগ : ব্যাংকবহির্ভূত কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে ডিসেম্বরের শুরুতে প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের ঘটনা এটাই প্রথম। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ২০১৯ সালের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের পরিমাণ কমে গত বছর শেষে এক হাজার ৬৯৮ কোটি টাকায় নেমেছে।

২০১৭ সালে যা এক হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা ছিল। প্রতিষ্ঠানটির আমানত তিন বছর আগের ৯৬৭ কোটি টাকা থেকে কমে ৮১৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এ আমানতের ৯০ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক।

যার বেশির ভাগই ফেরত দিতে পারছে না প্রিমিয়ার লিজিং। আর ঋণের পরিমাণ চার বছর আগের এক হাজার ৪১৬ কোটি টাকা থেকে কমে এক হাজার ২৫১ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

পিকে হালদারকাণ্ড : নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত থেকে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা কানাডায় পাচার করে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের বিরুদ্ধে।

এ নিয়ে কোম্পানি আইনে একাধিক মামলা হয়েছে। দুদকেও তার বিরুদ্ধে মামলা আছে। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা তার ২৭৫ কোটি টাকা জব্দ করেছে দুদক। আরও কিছু সম্পদ জব্দ করা হলেও তার আর্থিক মূল্য এখনও নির্ণয় করেনি দুদক।

অন্যদিকে হাইকোর্টের আদেশের পরও নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) অর্থপাচারের ঘটনায় এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পিকে হালদার দেশে ফেরেননি।

দুদকের মতে, হাইকোর্টের আদেশের পরও দেশে না ফেরার ঘটনা আদালত অবমাননার শামিল। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে গ্রেফতার করতে পুলিশের আইজির কাছে অনুরোধ জানানোর কথাও জানিয়েছে দুদক।.

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানকে অপসারণ : ৮ জুন মানবপাচার, অর্থপাচার ও ঘুষ দেয়ার অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার হন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।

তার বিরুদ্ধে কয়েক হাজার বাংলাদেশিকে টাকার বিনিময়ে কুয়েতে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। কুয়েতে আনার বিনিময়ে জনপ্রতি প্রায় এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার কুয়েতি দিনার নিয়েছেন তিনি।

বিভিন্ন ব্যাংকে তার প্রায় ৪৪টি হিসাব পাওয়া গেছে। যেখানে শুধু এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে রয়েছে ৩৪টি এফডিআর। ইতোমধ্যে তাকে ব্যাংকের পরিচালক এবং ভাইস চেয়ারম্যানের পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে।

প্রণোদনা প্যাকেজ : অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে করোনার সময়ে ২১ প্রকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। করোনা সংক্রমণের কারণে মার্চ থেকে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সরকারি সাধারণ ছুটিতে জনজীবন ছিল স্থবির।

বেশির ভাগ শিল্পকারখানা এবং অন্যসব প্রতিষ্ঠান ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও বিশ্ববাণিজ্য বন্ধ থাকায় চাপে পড়ে যান ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।

এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে কোনো প্রতিষ্ঠান যেন বন্ধ না হয়, সেজন্য এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। পুরো প্যাকেজ ব্যাংক ঋণভিত্তিক।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ : মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ৩১ ডিসেম্বর দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৩ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার।

প্রবাসী আয়ে উল্লম্ফন : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে প্রবাসীরা প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা ২০১৯ সালের পুরো সময়ের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি।

এর আগে এক বছরে বাংলাদেশে এত রেমিটেন্স আর কখনো আসেনি। ২০১৯ সালে ১৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

২০০ টাকার নোট : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে দেশে প্রথমবারের মতো ২০০ টাকা মূল্যমানের নতুন নোট বাজারে ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

১৭ মার্চ এ নোট চালু করা হয়। ২০০ টাকার নোটের ওপর মুজিববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ নোট কথাটি লেখা রয়েছে।

নতুন দুই ডেপুটি গভর্নর : বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক কাজী ছাইদুর রহমান এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম সাজেদুর রহমান খান।

বাংলাদেশ ব্যাংকে ডেপুটি গভর্নরের পদ চারটি। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির পর দুই ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানাকে অপসারণ করা হয়।

এরপর থেকে ডেপুটি গভর্নরের দুটি পদ খালি ছিল। নতুন নিয়োগে ডেপুটি গভর্নরের চার পদ পূর্ণ হল।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/379554