১ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১১:৪৯

মৃত্যুদণ্ডেও কমেনি পাশবিকতা

বিদায়ী বছরে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হলেও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৬২৭ নারী। ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছে ৫৩ নারী। ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ নারী। ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১৪১৩ নারী, ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭৩২। এ দিকে এ সময়ের মধ্যে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ২০১ নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন ১০৬ পুরুষ, আত্মহত্যা করেছেন ১৪ নারী, খুন হয়েছে তিন নারীসহ ১৪ জন।

ধর্ম অবমাননার গুজব রটিয়ে, মিথ্যা ট্যাগ দিয়ে জনসম্মুখে আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহীদুন নবী জুয়েল নামে এক ব্যক্তিকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যার মত নৃশংস ঘটনা ২০২০ সালে দেখেছে দেশের মানুষ। এই নৃশংসতাকে মধ্যযুগের বর্বরতার সাথে তুলনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। বীভৎস এ ঘটনাটি হতবাক করেছে দেশের সাধারণ মানুষকে। বছরের বছরের মাঝামাঝিতে কক্সবাজারে চেকপোস্টে পুলিশের হাতে মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যাকাণ্ড সারা দেশকে থমকে দিয়েছিল। সিনহা হত্যার পর ক্রসফায়ারের ঘটনা কমে যায় নাটকীয়ভাবে। তবে হত্যাকাণ্ড থেমে থাকেনি। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন এএসপি আনিসুল, সিলেটে পিটিয়ে রায়হানকে হত্যার পর পুলিশের এসআই এর গণপিটুনির নাটক সাজানো ছিল আলোচিত।

বেসরকারি মানবাধিকার আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কামিটির মহাসচিব মো: নূর খান লিটন বলেছেন, অবসরপ্রাপ্ত সেনা মেজর সিনহা মো: রাশেদ খানকে হত্যার পর ক্রসফায়ারের সংখ্যা কমেছে। তবে দেশে সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। করোনা মহামারীর কারণে অনেকে চাকরি ও আয়ের উৎস হারিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে খুন, ধর্ষণ, পারিবারিক সহিংসতা, চুরি ও অলিগলিতে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার অভাব ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর না হওয়ায় খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনা বাড়ছে। বছরের পর আদালতের মামলা চলায় ভুক্তভোগীরা বিচার পাওয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়ছে। মামলার সাক্ষী হাজিরে অনীহা এবং আলামতও নষ্ট হওয়ার ফলে সাজা পাওয়ার হার খুবই কম। দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচারহীনতার কারণে ভুক্তভোগীরা বেশির ভাগ মামলা করতেই চায় না। এসব ঘটনার দ্রুত বিচার হয়ে দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে অপরাধীরা ভয় পেত এবং খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধ কমে যেত। মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বলছে, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৭৩২ জন। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৮১৮ জন নারী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন সাত বছর বয়স থেকে ১৮ বছরের শিশু ও কিশোরীরা। কিন্তু ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৬২৭ নারী। ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছে ৫৩ নারী। ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ নারী। গতকাল বৃহস্পতিবার ভার্চুয়াল মাধ্যমে মানবাধিকার পরিস্থিতি-২০২০ নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসকের সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ২০২০ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সাথে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ১৮৮ জন। এর মধ্যে মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে ১১২ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে (গ্রেফতারের পর) নিহত হয়েছে ১১ জন। গ্রেফতারের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে মারা গেছে পাঁচজন এবং গুলিতে নিহত হয়েছে আটজন। কারাগারগুলোতে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছে ৭৫ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হয়েছে ছয়জন। এর মধ্যে নিখোঁজ রয়েছেন দু’জন। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ও নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ৪৯ জন। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫৫৪ নারী।

যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা গেছে ৩৬৭ জন এবং আত্মহত্যা করেছে ৯০ জন। সালিশের মাধ্যমে আট নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ৪৫ নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ২৭ নারী। বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৭১৮ শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় ১০১৮ শিশু, ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয় ২৭৯ শিশু। বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৫২ ছেলে শিশু, বলাৎকারের পর তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গণপিটুনির ঘটনায় ৩৫ জন নিহত হয়েছেন।

তিনি আরো বলেন, বছরটিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৩০টি মামলা হয়েছে এবং এসব মামলায় ২৭১ জনকে আসামি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতন, হামলা, মামলা, হুমকি ও হয়রানিসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৪৭ সাংবাদিক। এর মধ্যে দু’জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন।

বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ৬৭টি প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দির ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ১১টি বাড়িঘর ও তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ৭১ জন আহত হয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে গার্মেন্ট শিল্পের ৬০ থেকে ৬৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন এবং ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ না করার খবর পাওয়া গেছে। এ বছরের মার্চ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের ২১টি দেশে দুই হাজার ৩৩০ জন বাংলাদেশী অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আসকের পক্ষ থেকে ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।

মেজর সিনহা হত্যা : বিদায়ী বছরের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের চেকপোস্টে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে গাড়ি থেকে বের হলে তাকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। পরে আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব। এই হত্যার ঘটনায় ৫ আগস্ট নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার কক্সবাজারের আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলায় ওসি প্রদীপসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সময় সিনহার সাথে কক্সবাজারে ডকুমেন্টারি তৈরির কাজ করছিলেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির তিন শিক্ষার্থী শিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত এবং তাহসিন রিফাত নূর। পরে পুলিশ তাদেরকেও গ্রেফতার করে। পুলিশ বাদি হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করে। গত ১৩ ডিসেম্বর একই আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাবের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। মামলায় যে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয় তার মধ্যে ১৪ জন গ্রেফতার আছে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।

সিলেটে পুলিশের হাতে রায়হান হত্যা : বিদায়ী বছরের ১১ অক্টোবর ভোরে সিলেট মেট্রোপলিটনের আখালিয়া এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় যুবক রায়হানকে। এ ঘটনায় নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদি হয়ে পরের দিন ১২ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। রায়হান হত্যাকাণ্ডে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ পাঁচজনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপরে সর্বশেষ গত ১৮ নভেম্বর রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক সৌমেন মিত্র এবং এসআই আবদুল বাতেন ভূঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুলিশের সদর পুলিশের সদর দফতরের তদন্ত দলের প্রতিবেদনের পর তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সদর দফতরের তদন্ত দলের প্রতিবেদনের পর তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে বলে জানা গেছে। এর আগে গত ৯ নভেম্বর দুপুরে কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে মামলার প্রধান আসামি এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

ধর্ম অবমাননার গুজবে পুড়িয়ে হত্যা : বিদায়ী বছরের ২৯ অক্টোবর কুরআন মাজিদ ‘অবমাননার’ গুজব ছড়িয়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে আবু ইউনুস মো: শহিদুন্নবী জুয়েল (৪৫) নামের এক মুসল্লিকে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের ওপর পুড়িয়ে দেয়া হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, ঘটনার দিন ওই মসজিদে আসরের নামাজের পর জুয়েল নামের ব্যক্তি ধর্মের অবমাননা করেছেন, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে শত শত মানুষ জড়ো হয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা এবং তার রক্তাক্ত মরদেহ আগুন দিয়ে পোড়ানোর ভিডিও সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে দেশ-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
পুলিশের এএসপি আনিসুল হত্যা : মানসিক সমস্যার চিকিৎসায় সিনিয়র এএসপি আনিসুলকে ৯ নভেম্বর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান স্বজনরা। এরপর সেখান থেকে তাকে আদাবরের মাইন্ড এইড নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের মারধরের শিকার হন। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সিসিটিভির ফুটেজে এই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য ছড়িয়ে পরলে সারা দেশে আলোচিত হয়। এ ঘটনায় আসামিদের মধ্যে ১২ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/552748/