১ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১১:৪৯

চ্যালেঞ্জ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের

অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আজ থেকে শুরু হলো নতুন বছর। কোভিড-১৯ এর কারণে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো এখন বেশ খানিকটা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে, রফতানি-আমদানির চিত্র অনেকটা স্থবির অবস্থায় রয়েছে। রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। আমদানি কমে গেছে ১৩ শতাংশের বেশি। বেসরকারি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়ন চিত্রও হতাশাব্যঞ্জক। রাজস্ব খাতের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। পরপর দুই অর্থবছরে এ খাতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে (এনবিআর অংশে)। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে প্রবৃদ্ধি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ হলেও এখন টার্গেটের চেয়ে আদায় ঘাটতি ২৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
শুধু কি তাই, সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস বলছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০ শতাংশ হয়েছে। নতুন করে গরিব হয়েছেন এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। আগে থেকেই আরো সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্র্যসীমার নিচেই বসবাস করত। ফলে সে সময় (জুলাই) মোট দরিদ্রের সংখ্যা পাঁচ কোটি ওপরে ছিল। হিসাব করলে দেখা যাবে এর পরের মাসে গরিব মানুষদের সংখ্যা আরো বেড়েছে।
এর প্রমাণ পাওয়া যায়, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জরিপে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, করোনায় দারিদ্র্য হার ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত জুন মাসে পিপিআরসি ও বিআইজিডির যৌথ গবেষণায় এসেছে, দারিদ্র্য হার দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্য দিকে, পুরোপুরি সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তো হিসাব কষে দেখিয়ে দিয়েছে, করোনায় মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে যাদের আয় ছিল প্রতিদিন ১০০ টাকা। করোনার কারণে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকায়।
তবে অর্থনীতিতে কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। এই খাতে ঊর্ধ্বগতি এই করোনাকালেও অটুট রয়েছে। আমদানি কম হয়েছে তাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ভালো অবস্থায় রয়েছে। তা এখন ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। তবে এরপরও নতুন বছরে ক্ষয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করাই সরকারের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয় নিয়ে গতকাল নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হয়। নতুন বছরের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ বিষয়ে তিনি মোটা দাগে তিনটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- কর্মসংস্থান বাড়িয়ে বেকারত্ব কমানো। প্রবৃদ্ধি বাড়ানো। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার অনেক কমে গেছে। তবে অনেক প্রবৃদ্ধি হার আমাদের চেয়ে কমে গেছে। তাদের চেয়ে আমরা ভালো থাকলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমাদের অনেক কমে গেছে। সেটিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের এই কথারই সত্যতা পাওয়া যায় সরকারি পরিসংখ্যানে। সেখানে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেখানে প্রাক্কলন করা ছিল আট দশমিক ৫০ শতাংশ, সেখানে অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। একইভাবে চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধির হার আট দশমিক ২০ শতাংশ নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে কো-অর্ডিন্যান্স কাউন্সিলের বৈঠকে অর্থ সচিবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, চলতি অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে বড়জোর সাত দশমিক ৪ শতাংশ। আর আগামী অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে সাত দশমিক ৭ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি বলেছে, এবার প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে নেমে যাবে।

নতুন বছরে অর্থনীতির আরেক চ্যালেঞ্জ হিসেবে বেকারত্ব কমিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে দেখছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি এ সম্পর্কে বলেন, অনেক লোক বেকার হয়ে গেছে। তাদের কর্মসংস্থান সরকারকে নতুন বছরে করতে হবে। চাকরি হারানোর কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে অনেক মানুষ চলে গেছে। ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে দারিদ্র্যসীমা ২০১৯ সালে ১৯ শতাংশে নেমে এসেছিল। সেখানে অনেকে বলেন, তা এখন ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে।

বেসরকারি খাতে কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। সেটা কিছু কোভিড-১৯ কারণে আর কিছুটা অন্য কারণে। এটিই বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে প্রণোদনাগুলো দেয়া হয়েছে তা অনেকে পায়নি। ব্যবসায়ীর জন্য যে প্যাকেজ দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়, বড় বড় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে প্যাকেজ বাস্তবায়ন হার ৮০ শতাংশ হলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ। এটি প্রোপার টার্গেটিং করে এর গতি বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, ব্যবসা বাণিজ্য হয় বলে রাজস্বও বাড়ছে না। আমদানিতে ব্যাপক ধস নেমেছে তাই শুল্ক আদায় হচ্ছে না। বিক্রি বাড়ছে না, তাই ভ্যাট আদায় হচ্ছে না। তাই নতুন বছরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা ও জবাবদিহিতাও আশা করে বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ।

মানুষের আয় কমেছে : করোনায় মানুষের আয়-ব্যয়ে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা জানতে গত সেপ্টেম্বরে একটি জরিপ করে বিবিএস। সেই জরিপে দেখা গেছে, করোনায় আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চে প্রতি পরিবারে মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকা। পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় কমেছে প্রায় চার হাজার টাকা।

অন্য দিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি ও বিআইজিডি গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনার প্রথম দিকে অর্থাৎ এপ্রিল-জুন মাসে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দীর্ঘ মেয়াদে ছুটি ও লকডাউনের প্রভাবে গত এপ্রিল মাসে গরিব মানুষের আয় কমেছে ৭৫ শতাংশ । আর গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের আয় ৬৫ শতাংশ কমেছে।

অর্থনীতি গতি ফিরিয়ে আনতে সরকার বাস্তবায়ন করছে সোয়া লাখ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ। এতে বড় ব্যবসায়ীরা সুবিধা পেলেও ছোটরা প্যাকেজ থেকে ঋণ পেতে বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার গত ৩ ডিসেম্বরে বলেছেন, ‘যেমনটা প্রত্যাশা করা হয়েছিল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং মাঝারি শিল্পে (সিএমএসএমই) তেমন ঋণ বিতরণ হয়নি। এমনকি, ছোট ঋণের ঝুঁকির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক নেয়ার পরও এ খাতের ঋণ বিতরণ বাড়েনি। এটা খুবই দুঃখজনক।’ এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সহযোগিতা করছে না বলেও তিনি অভিযোগ করেন। এর বাইরে ছোট উদ্যোক্তাদের অন্য পাঁচটি প্যাকেজের ঋণ বিতরণের চিত্রও হতাশাজনক। কোনো কোনো প্যাকেজের এক শ’-দেড় শ’ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র। তবুও আশাবাদী অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। তিনি গত বুধবার জানিয়েছেন, নতুন বছরেও অর্থনীতি ভালো অবস্থায় থাকবে। অর্থমন্ত্রীর কথায় আমরা ভরসা রাখতেই পারি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/552750