১ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১১:৪৭

করোনার ছোবলে দেশের অর্থনীতি

বড় আশা নিয়ে ২০২০ সালের শুরু হলেও মহাসংকটের মধ্য দিয়ে শেষ হলো বছর। মার্চে শুরু হওয়া করোনা অর্থনীতিতে নতুন ছোবল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অর্থনীতির সবগুলো সূচক ঊর্ধ্বমুখীতা দিয়ে বছর শুরু হলেও নিম্নমুখীয় শেষ। বিনিয়োগ না বাড়াতে বেড়েছে বেকারত্ব। করোনা মোকাবেলায় প্রণোদনা ঘোষণা করলেও সংকট কাটিয়ে উঠেনি অর্থনীতিতে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এতে অর্থনীতিতে ক্ষত আরও বাড়ছে।

করোনায় বড় ধরনের ধস নামে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের উৎপাদনে। ধস নামে আমদানি ও রফতানি এবং রাজস্ব আহরণে। ফলে শেষ পর্যন্ত গেল অর্থবছরের শেষ তিন মাস (এপ্রিল-জুন) এই বিপর্যয়ের কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি।

অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। যা ২০০৮ সালের পর জিডিপিতে এত বড় আঘাত আর আসেনি। কিন্তু এবার কোভিড-১৯’র মহামারিতে অর্থনীতির বিপর্যয়ে বিশ্ব প্লাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশও। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার কারণে রফতানি পণ্যের অর্ডার বাতিল হয়। এতে রফতানি আয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প উৎপাদন হ্রাসের কারণে ধস নামে রাজস্ব আহরণে।

অপরদিকে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এ বছর স্বাস্থ্যখাতসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের অস্বাভাবিক ব্যয় বেড়েছে। আয় ও ব্যয়ের এই ভারসাম্যহীনতার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির ওপর। এই ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ঋণনির্ভর হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে অনেক বেশি মাত্রায় ঋণ নিয়েছে সরকার।

এদিকে করোনায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ২১টি প্যাকেজের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত সব খাতকে ঋণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

অক্টোবর পর্যন্ত এসব প্যাকেজের আওতায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। তবে ডিসেম্বর শেষ নাগাদ এটি ৬০ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। তবে অনেক উদ্যোক্তা মনে করছেন এই প্যাকেজ বাস্তবায়ন আরও দ্রুত করা দরকার।

এরই মধ্যে নবেম্বর থেকে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা শুরু হয়েছে। যা আবারও একটি অনিশ্চিত পরিবেশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

বিজিএমইএ’র প্রেসিডেন্ট ড. রুবানা হক একই সুরে বলেন, আরও একটি করোনা ধাক্কা এগিয়ে আসছে। এ নিয়ে শঙ্কিত তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা। ইতোমধ্যে ইউএস, জার্মান, জাপান, ইতালি, কানাডা, স্পেনে রফতানি কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রফতানি আয়ের বড় খাত পোশাক শিল্পের ওপর।

করোনার কারণে বছরজুড়ে চাপের মুখে রয়েছে সামষ্টিক অর্থনীতি। যে কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি আয় ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ, আমদানি ব্যয় কমেছে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এই ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নবেম্বর পর্যন্ত রফতানি প্রবৃদ্ধি কমেছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আয় কমেছে বৈদেশিক মুদ্রায় ২২৮ কোটি মার্কিন ডলার।

পাশাপাশি অর্থবছরের পাঁচ মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে মোট ২২২০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। গত বছর একই সময়ে ব্যয় হয় ২ হাজার ৩৪৩ কোটি ডলার। করোনায় আমদানি ব্যয় কমেছে ১২৩ কোটি ডলার।

এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মোট রাজস্ব আহরণ কমছে ২৫ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে আমদানি ও রফতানি খাতে রাজস্ব কমেছে ১০ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা, স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট খাতে আয় কমেছে ৯ হাজার ৮২ কোটি টাকা এবং আয় ও ভ্রমণ কর খাতে কমেছে ৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। একদিকে রফতানি আয় কমছে, অন্যদিকে কমছে রাজস্ব আহরণ। ফলে ব্যয় মেটাতে গিয়ে সরকারের ঋণনির্ভরতা বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর শেষে মোট ব্যাংক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭৮ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা, যা ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে ছিল এক লাখ ৭৭ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাই থেকে অক্টোবর এই চার মাসে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ মাত্র ৯৪৫ কোটি টাকা। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। বাজেটে ২০ হাজার কোটি টাকা বিক্রির লক্ষ্য থাকলেও প্রথম চার মাসেই নিট বিক্রি সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তবে এই সময়ে প্রবাসী আয় ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বৃদ্ধি আশার আলো জুগিয়েছে।

কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে মন্দা বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা আইএমএফ পূর্বাভাসে বলেছে, বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ হবে।

বিশ্বব্যাংক বলেছে, জ্বালানি মূল্যের দাম কমে যাওয়ায় দুনিয়াজুড়ে ২০ শতাংশ রেমিটেন্স আয় কমবে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) বলেছে, করোনার কারণে ১৩ থেকে ২০ শতাংশ হ্রাস পাবে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্য।

পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ এর কারণে ১৯ কোটি ৫০ লাখ লোক চাকরি হারাবে। এছাড়া উন্নত এবং উন্নয়নশীলসহ বিশ্বব্যাপী বিদেশি বিনিয়োগ ৫ থেকে ১৫ শতাংশ কমবে বলে আঙ্কটাড হিসাব দিয়েছে।

নতুন অর্থবছরে অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে আনতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ও দ্রুত টিকা বিতরণ হচ্ছে অর্থনীতি খাতে প্রধান চ্যালেঞ্জ।

আর এসব অর্জনের মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। যদিও বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে বহুজাতিক সংস্থাগুলো যে পূর্বাভাস দেয়, তার সঙ্গে সরকারের প্রাক্কলনের বড় ধরনের ফারাক রয়েছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনার প্রভাবে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ শতাংশের নিচে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, প্রবৃদ্ধি হবে ৪ শতাংশের কাছাকাছি। আরেক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অবশ্য বলছে, প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬.৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বি আইডিএস’র সাবেক ডিজি এমকে মুজেরী বলেন, চলতি বছর করোনার বিরূপ প্রভাব ছিল অর্থনীতিজুড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপে অনেকটা রক্ষা হয়েছে। এদিকে আরও যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আস্থাহীনতা দূর, মনিটরিং ব্যবস্থা চালু ও বিলম্বে বাস্তবায়নের কারণ শনাক্ত, রফতানি খাতে নজর ও শ্রমিকদের সহায়তা দেয়া।

পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাকে (এসএমই) আরও সহায়তা দেয়া, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে প্যাকেজের সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা, করোনায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ঋণের অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত, নতুন গরিবসহ দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করতে দেশব্যাপী ওএমএস কর্মসূচি চালু, কৃষিতে আগ্রহ বাড়াতে ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা ও প্যাকেজ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আরও সহজ করা।

https://dailysangram.com/post/439187