১ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১১:৪৪

করোনায় সবকিছু তছনছ করে দেওয়ার বছর ২০২০

ইবরাহীম খলিল: ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে ২০২০ সাল বিদায় নিল মানুষের কাছ থেকে। বছরটি ছিল মানুষের জন্য আতংকের বছর। বিশ্ববাসীর জন্য এ বছরটি অন্য সব বছরের থেকে আলাদা হয়েই থাকবে। কারণ প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস তছনছ করে দিয়েছে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে। করোনার শুরুর দিকে আক্রান্তরা চিকিৎসার জন্য হাহাকার করে মারা গেছেন বহু মানুষ। এমনকি মারা যাওয়ার পরও স্বজনরা ছুঁয়ে দেখতে পারেননি প্রিয়জনটিকে।

এদিকে মহামারি করোনা ভাইরাসে পুরো বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত ঠিক তখন আশার আলো হিসেবে ৯ নভেম্বর আমেরিকান কোম্পানি ফাইজার ও জার্মানির বায়োএনটেক যৌথভাবে টিকা উদ্ভাবনে তাদের সাফল্য ঘোষণা করে। তারা জানায়, তাদের উদ্ভাবিত করোনা টিকা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে করোনা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর। ডিসেম্বরের শুরুতে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ফাইজার/বায়োএনটেকের করোনা ভাইরাস টিকার অনুমোদন দেয় যুক্তরাজ্যে এবং শুরু হয় তাদের টিকাদান কার্যক্রম।

চীনা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে। সেখানকার একটি সামুদ্রিক খাবার ও পশুপাখির বাজারে থেকে প্রথম সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার খবর জানা যায়।

প্রথমদিকে এই ভাইরাসটিকে বিভিন্ন নামে ডাকা হচ্ছিল যেমন, ‘চায়না ভাইরাস’, ‘করোনা ভাইরাস’, ‘২০১৯ এনকভ’, ‘নতুন ভাইরাস’, ‘রহস্য ভাইরাস’ ইত্যাদি। পরে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয় কোভিড-১৯ যা করোনা ভাইরাস ডিজিজ ২০১৯- এর সংক্ষিপ্ত রূপ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চলতি বছরের ১১ মার্চ কোভিড-১৯ ভাইরাসকে বিশ্ব মহামারি ঘোষণা করে। এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করা হয় লকডাউন ও নিষেধাজ্ঞা। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৮ কোটি এবং এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১৮ লাখের বেশি। ব্যস্ত সব শহর শুনশান, বেশিরভাগ মানুষ ঘরবন্দী, জরুরি প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বেরোনো মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্ক; চলছে না গাড়িঘোড়া, ট্রেন-বিমান নিশ্চল, হাসপাতালে উপচে পড়া রোগীর ভিড়, মর্গে সারি সারি লাশ। করোনা ভাইরাস মহামারি বিশ্বের অসংখ্য দেশ, শহর-নগরকে নতুন এ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

প্রাণঘাতী, ছোঁয়াচে ভাইরাসের দাপটে ত্রস্ত পৃথিবীতে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে বিভিন্ন দেশের সরকার ও কর্তৃপক্ষকে হতে হয়েছে কঠোর; ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে হয়েছে, অবরুদ্ধ করে দিতে হয়েছে একের পর এক এলাকা। তবু কোনও কিছুতেই থামানো যায়নি মৃত্যুর মিছিল।

বছরের শেষদিকে বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিষেধক আসার খবর খানিকটা স্বস্তি দিলেও বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে সংক্রমণের নতুন নতুন ঢেউ, তা ঠেকাতে ফের বিধিনিষেধ, সঙ্গে করোনা ভাইরাসের আরও আক্রমণাত্মক নতুন ধরনের প্রাদুর্ভাব বিশ্বজুড়ে এখনও কোভিড-১৯ এর আতঙ্ক জারি রেখেছে।

সব মিলিয়ে ২০২০সালকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বছর বলছেন সাংবাদিক নিক ব্রায়ান্ট। কেউ কেউ আবার ২০২০ কে চিহ্নিত করতে চাইছেন আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা আর তটস্থ একটি বছর হিসাবে।

মহামারি আর নানান বিধিনিষেধের কারণে বেড়ে যায় ছাঁটাই, চাকরিচ্যুতি। আয় বৈষম্য বাড়ায় কোটি কোটি লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে; উল্টোদিকে সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকে বাড়িয়ে নিয়েছেন সম্পদের পরিমাণ। প্রাণঘাতী এই কোভিড-১৯ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দগদগে ঘা উন্মোচন করে; সুরক্ষা উপকরণ সংক্রান্ত নানান দুর্নীতিও অনেক দেশের রাজনীতিতে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে। বছরের শেষদিকে এসে বেশ কয়েকটি দেশে টিকার প্রয়োগ আশা জাগালেও ধনীদের টিকার মজুদে দরিদ্র দেশগুলোর বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।

এখন পর্যন্ত পাওয়া কোনও টিকাই দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা দিতে সক্ষম প্রমাণিত না হওয়ায় হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, ভিড় এড়িয়ে চলার মতো নির্দেশনায় তাই শিথিলতা দেখানো যাচ্ছে না। সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি বিবেচেনায় নানামাত্রিক বিধিনিষেধ আরোপের পথও তাই আরও অনেকদিনই খোলা থাকছে।

মহামারি আতঙ্কে গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে পড়ায় বছরের শুরুতেই বিশ্ব অর্থনীতি পড়ে তুমুল চাপে। বিভিন্ন দেশ সেসময় লকডাউন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ সব বন্ধ করে দিলেও পরে মহামারির মধ্যেই ধীরে ধীরে জরুরি সব কার্যক্রম চালু করতে বাধ্য হয়। এপ্রিলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জানায়, মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়ে পড়বে বলে তারা আশঙ্কা করছে। ১৯৩০-র মহামন্দার পর এমনটা আর হয়নি।

মহামারিতে অর্থনীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত খাতের মধ্যে অন্যতম ছিল বিমান যোগাযোগ ও পর্যটন। মে’তে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় ¬এয়ার ক্যারিয়ার ল্যাটাম এয়ারলাইন্স নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করে। অসংখ্য কোম্পানিতে বিপুল সংখ্যক ছাঁটাই ও চাকরিচ্যুতি দেখা দেয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৮ মার্চ প্রথম তিনজন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় বলে জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

শুরুর দিকে করোনার সংক্রমণ কমের দিকে থাকলেও মে মাসের মাঝামাঝি থেকে করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে। ওই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই রোগী শনাক্তের হার চলে যায় ২০ শতাংশের ওপরে। চলতে থাকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। তবে তার পর থেকে শনাক্তের হার কমতে থাকে। প্রায় এক মাসের বেশি সময় থেকেই শনাক্তের হার ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে ছিল। তবে গত ২ নভেম্বর থেকে ফের বাড়তে শুরু করে করোনার সংক্রমণ। এখন পর্যন্ত সংক্রমণের এ ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত অবস্থায় রয়েছে।

করোনার সংক্রমণ রুখতে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার ১৮ দিন পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি (অঘোষিতভাবে লকডাউন) ঘোষণা করে সরকার। বন্ধ থাকে সরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যান চলাচল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, হাট-বাজার, আমদানি-রফতানি, পর্যটন স্পটসহ সবকিছু। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অফিস বন্ধ রেখে বাসা থেকে কর্মীদের কাজ করার সুযোগ করে দেয়।

শুরু হয় মানুষের এক দুর্বিষহ জীবন। করোনার ভয়ে প্রথম দিকে আতঙ্কে কেউ জরুরি কাজ ছাড়া বাসা থেকে বের হয়নি। এমনভাবে করোনার আতঙ্ক ছড়িয়েছিল যে, কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে শুনলে মানুষ ওই বাড়ির পাশ দিয়েও যেত না। করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ছাড়া অন্য হাসপাতালে জ্বর-সর্দি, কাঁশির রোগী গেলে কর্মকর্তারা ভয়ে দৌড় দিত। করোনার আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে ভয়ে লাশ দেখতেও আসত না কেউ। এরপর ধীরে ধীরে একসময় তা কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তবে করোনা আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হলেও পিছু ছাড়ছে না অন্য রোগগুলো। নানা নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে এখনো ভুগছেন তারা।

করোনার ব্যাপক প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতেও। থমকে যায় অর্থনীতির চাকা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় চাকরি হারায় লাখ লাখ শ্রমিক। দীর্ঘদিন বেকার থাকার কারণে জমানো শেষ সঞ্চয়টুকুও খরচ করে পথে বসে বহু মানুষ। অনেকে বাসা ভাড়া দেয়ার সক্ষমতা হারিয়ে আসবাবপত্র নিয়ে চলে যান গ্রামের বাড়িতে।

করোনার ব্যাপক প্রভাব পড়ে প্রবাসী শ্রমবাজারেও। করোনাকালে দেশে দেশে আরোপিত লকডাউন ও শাটডাউনের ফলে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরেছেন দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক। এ ছাড়া এই সময়ে নতুন করে কোনো শ্রমিক বিদেশে যেতে পারেননি। দেশে ছুটিতে এসে আটকে পড়াদের অনেকেই এখনো কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারেননি। অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে ৩১ মে সীমিত পরিসরে খুলে দেয়া হয় অফিস-আদালত। এর পর একে শুরু হয় যান চলাচল, হাট-বাজার, দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ সবকিছুই।

একে একে সবকিছু খুলে গেলেও এখনো বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনার কারণে এইচএসসি, জেএসসি ও পিএসসি সমমানের পরীক্ষাগুলো নেয়া সম্ভব না হওয়ায় সবাইকে দেয়া হয় অটোপাস। এ ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের অটোপাস দিয়ে পরবর্তী ক্লাসে তোলা হয়। বছরের শেষ দিকে এসে জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে ঘর থেকে বের হতে শুরু করে মানুষ। একপর্যায়ে জীবনযাত্রা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। মানুষ ভুলতে বসে স্বাস্থ্যবিধিকে। স্বাস্থ্যবিধি না মানায় এখনো করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। তবে সরকার সর্বসাধারণকে ঘরের বাইরে মাস্ক পরে চলতে এবং স্বাস্থ্যবিধি মানাতে এখনো অনেকটা কঠোরভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। মাস্ক না পরে বাইরে বের হলে জেল-জরিমানা করছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

২০২০ সালে বিভিন্ন অঙ্গনের আরও অনেক সুপরিচিত ব্যক্তির মৃত্যুরও সাক্ষী হয়েছে। এ বছরই বিশ্ব হারিয়েছে কিম কি দুকের মতো অসাধারণ চলচ্চিত্রনির্মাতাকে; না ফেরার দেশে চলে গেছেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। জেমস বন্ডের চরিত্রে অভিনয় করে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক তারকাখ্যাতি পাওয়া শন কনরিও মারা গেছেন ২০২০ সালে। বছরের মাঝামাঝি অল্প সময়ের ব্যবধানে ভারত হারায় দুই শক্তিমান অভিনেতা ঋষি কাপুর ও ইরফান খানকে। তরুণ অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যাও দেশটিতে ঝড় তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, লিঙ্গ সমতার দৃঢ সমর্থক রুথ বেডার গিন্সবার্গকেও এ বছরই হারিয়েছে বিশ্ব।

এ বছর আরও মারা গেছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব হাভিয়ের পেরেজ। মিশরের সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসনি মোবারক, ভারতীয় অভিনেতা ও রাজনীতিক তাপস পাল, প্রথম বাঙালি ক্যাবারে নৃত্যশিল্পী মিস শেফালি, বাস্কেটবল খেলোয়াড় কোবি ব্রায়ান্ট, ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যান এভারটন উইকস, পশ্চিমবঙ্গের কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তও ২০২০ সালে নিয়েছেন চিরবিদায়।

https://dailysangram.com/post/439185