২৩ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৩

পাঠ্যবইয়ের বিষয় নির্বাচন (১)

ইতিহাসে ভারী বাংলা বই

ইতিহাস, জীবনী আর সাহিত্যধর্মী নয় এমন সব গদ্য লেখায় ভারী করে ফেলা হয়েছে বাংলা পাঠ্যবই। বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরের কোনো কোনো শ্রেণীর বাংলা বইয়ে এত বেশি ইতিহাস, জীবনীনির্ভর ও গদ্য লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যে, তাকে আর সাহিত্য বই বলে মনে করা যাচ্ছে না। যেমন পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যবইয়ে গদ্য ও পদ্য মিলিয়ে মোট সাতটি ইতিহাসভিত্তিক লেখা রয়েছে। অন্য দিকে শিশুরা গল্প খুব ভালোবাসলেও প্রাথমিক স্তরের বাংলা বইয়ে খুবই কমসংখ্যক গল্প রাখা হয়েছে। আবার সামান্য সংখ্যক যেসব গল্প রাখা হয়েছে তাতে যেমন নেই কোনো শিক্ষণীয় বিষয়, তেমনি তা শিশুদের কাছে খুব একটা আকর্ষণীয় নয় বলে জানিয়েছেন অনেক শিক্ষক ও অভিভাবক।


পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে গদ্য-পদ্য মিলিয়ে মোট ২৪টি লেখা রয়েছে। এর মধ্যে ইতিহাসকেন্দ্রিক গল্প ও কবিতা রয়েছে মোট সাতটি। সেলিনা হোসেনের ‘অপেক্ষা’ ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি গল্পধর্মী লেখা। এটি ছাড়া বাকি লেখা ঠিক গল্পের মতো নয়, ইতিহাসের মতো।


মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্বের-অহঙ্কারের। আমাদের চেতনার মর্মমূলে এর স্থান। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনেক গল্প আছে, যা বাংলা বইয়ে স্থান দিলে শিক্ষার্থীরা ভাষা শিক্ষার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হতে পারে।
পঞ্চম শ্রেণীর গদ্য অংশে আর যেসব লেখা রয়েছে সেগুলো হলো এই দেশ এই মানুষ, সুন্দরবনের প্রাণী, শখের মৃৎশিল্প, মাটির নিচে যে শহর (নরসিংদীর উয়ারী বটেশ্বর প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে লেখা), ভাবুক ছেলেটি (স্যার জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে), বিদায় হজ ও দেখে এলাম নায়াগ্রা।


গদ্য অংশে মাত্র দু’টি গল্প রয়েছে। এগুলো হলো ‘হাতি আর শিয়ালের গল্প’ ও ‘কাঞ্চনমালা আর কাঁকনমালা’। এ ছাড়া ‘অবাক জলপান নামে’ একটি রম্য লেখা রয়েছে। হাতি আর শিয়ালের গল্পে কোনো লেখকের নাম নেই। কাঞ্চনমালা আর কাঁকনমালা মূলত বিখ্যাত রূপকথা কাজলরেখা থেকে ধারণা নিয়ে রচিত একটি গল্প।


অনেক অভিভাবক জানান, শিশুরা খুবই গল্পপ্রিয়। তারা গল্প শুনতে ভালোবাসে। কিন্তু বাংলা পাঠ্যবইয়ে মাত্র দু’টি গল্প রয়েছে। এর মধ্যে হাতি আর শিয়ালের গল্প তেমন আকর্ষণীয় নয়। তা ছাড়া শেখারও তেমন কিছু নেই এতে।
চতুর্থ শ্রেণীর বাংলা বইটিও গদ্য এবং জীবনীনির্ভর লেখায় ভারী। চারটি জীবনীনির্ভর লেখা রয়েছে বইটিতে। হাত ধুয়ে নাও, মোবাইল ফোন প্রভৃতি লেখা বাংলা বইয়ে না রেখে অন্য কোনো বইয়ে রাখা যেত অথবা এসব না থাকলেও তেমন ক্ষতি হতো না বলে মনে করেন অনেক শিক্ষক ও অভিভাবক। এর পরিবর্তে শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় গল্প, নামকরা সাহিত্যিকদের কোনো গদ্য রচনা রাখা হলে বইটি আরো সমৃদ্ধ হতো বলে মনে করেন অনেকে।


দ্বিতীয় শ্রেণীর বইতে ‘জলপরি ও কাঠুরে’ নামে শুধু একটিমাত্র গল্প রয়েছে। তবে এটিরও কোনো লেখক নেই। প্রচলিত নীতিকথাকে গল্পে রূপ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর বইতেও রয়েছে বেশ কয়েকটি গদ্য লেখা। তার স্থলে শিক্ষণীয় গল্প রাখা হলে বইটির প্রতি শিশুদের আকর্ষণ বাড়ত বলে অনেকের অভিমত।


তৃতীয় শ্রেণীর বইয়ে রাজা ও তার তিন কন্যা এবং কুঁজো বুড়ির গল্প নামে মাত্র দু’টি গল্প রয়েছে। এরও কোনো লেখক নেই। প্রচলিত কাহিনীনির্ভর করে রচনা করা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর বইয়ে গদ্য অংশে যেসব লেখা রয়েছে সেগুলো হলো রাজা ও তার তিন কন্যা। ভাষাশহিদদের কথা, স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে, কুঁজো বুড়ির গল্প, একাই একটি দুর্গ, পাখিদের কথা, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, একজন পটুয়ার গল্প, স্টিমারের সিটি, পাল্লা দেওয়ার খবর, নিরাপদ চলাচল, খলিফা হজরত আবু বকর।


ষষ্ঠ শ্রেণীর বাংলা বইয়ের নাম চারুপাঠ। এতে গদ্য অংশে ইতিহাস নিয়ে তিনটি লেখা রয়েছে। এগুলো হলো তোলপাড়, অমর একুশে ও কতকাল ধরে। ষষ্ঠ শ্রেণীর গদ্য অংশে সততার পুরস্কার ও মিনু নামে দু’টি গল্প রয়েছে। ইতিহাস ছাড়া গদ্য অংশে আর যেসব লেখা রয়েছে তা হলো মাদার তেরেসা, নীল নদ আর পিরামিডের দেশ, আকাশ, কত দিকে কত কারিগর।
ষষ্ঠ শ্রেণীর কবিতা অংশে যেসব কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো হলো জন্মভূমি, সুখ, মানুষ জাতি, ঝিঙে ফুল, আসমানি, মুজিব, বাঁচতে দাও, পাখির কাছে ফুলের কাছে, ফাগুন মাস।


সপ্তম শ্রেণীর গদ্য অংশে লেখাগুলো কাবুলিওয়ালা, লখার একুশে, মরু-ভাস্কর, শব্দ থেকে কবিতা, পাখি, পিতৃপুরুষের গল্প, ছবির রং, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সেই ছেলেটি, বাংলাদেশের ুদ্র জাতিসত্তা। লখার একুশে ও পিতৃপুরুষের গল্প ইতিহাসভিত্তিক লেখা।


সপ্তম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে কবিতা অংশে যেসব কবিতা রয়েছে তা হলো নতুন দেশ, কুলি-মজুর, আমার বাড়ি, শোন একটি মুজিবরের থেকে, সবার আমি ছাত্র, শ্রাবণে, গরবিনী মা-জননী, সাম্য, মেলা, এই অক্ষরে।
অষ্টম শ্রেণীর গদ্য অংশে রয়েছে অতিথির স্মৃতি, ভাব ও কাজ, পড়ে পাওয়া, তৈলচিত্রের ভূত, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, আমাদের লোকশিল্প, সুখী মানুষ, শিল্পকলার নানা দিক, মংডুর পথে, বাংলা নববর্ষ, বাংলা ভাষার জন্মকথা।


অনেক শিক্ষক ও অভিভাবকের মতে, শিশুদের ইতিহাসের জ্ঞান বিশেষ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনসহ ইতিহাসের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অনেক আগে থেকেই বাংলা বইয়ে ইতিহাস বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অন্তত একটি করে লেখা থাকত। ইতিহাসের ঘটনা নিয়ে রচিত কবিতাও থাকত। সেটা মানানসই পর্যায়ে ছিল। কিন্তু বর্তমানে কোনো কোনো শ্রেণীর বাংলা বইয়ে ইতিহাসবিষয়ক লেখা বেশি থাকার কারণে বাংলা বইটি তার সাহিত্য চরিত্র অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের মতে, তৃতীয় শ্রেণী থেকে বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় নামে একটি বই রয়েছে। সামাজিক বিষয়ের সাথে ইতিহাস বিষয়েও লেখা রয়েছে এই বইয়ে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের মতে, বাংলা পাঠ্যবই থেকে ইতিহাসবিষয়ক লেখা কিছু কমিয়ে বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে নেয়া যেতে পারে। তাদের মতে, শিশুদের বাংলা পাঠ্যবইয়ে শিশুতোষ গল্প, কবিতা ও খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের গদ্য লেখা থাকা উচিত, যা পড়ে শিশুরা যেমন আনন্দ পাবে তেমনি নেবে শিক্ষণীয় বিষয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের অন্য বিষয়কেন্দ্রিক গল্পও স্থান পেতে পারে পাঠ্যবইয়ে; যেখানে গল্পের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কোনো ঘটনা বা ইতিহাসের কোনো চরিত্র তুলে ধরা হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/205976