১৮ অক্টোবর ২০২০, রবিবার, ৫:০৩

বিদেশী সহায়তার অর্থ ছাড় করাতে পারছে না সরকার

প্রকল্পের কাজ সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় বিদেশী সহায়তার অর্থ ছাড় করাতে পারছে না সরকার। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। আর বিদেশী সহায়তার অর্থ পাইপলাইনে আটকে আছে ৪ লাখ ২১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। সে হিসাবে দাতাদের কাছ থেকে পাইপলাইনে পড়ে থাকা অর্থ বাংলাদেশের এক বছরের বাজেটের প্রায় কাছাকাছি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার দাতাদের সঙ্গে যেসব ঋণ চুক্তি করেছে, সেসব প্রকল্প নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে না পারায় বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড়ও দাতারা সময়মত করছে না।

জানা গেছে, বাংলাদেশকে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা মিলে বিভিন্ন সময়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেখান থেকে ৪ হাজার ৯৫৪ কোটি ডলার পাইপলাইনে আটকে আছে। বর্তমান বিনিময় হার (১ ডলারে ৮৫ টাকা) অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এই অর্থের পরিমাণ ৪ লাখ ২১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দাতাদের কাছে বাংলাদেশের পাওনা হিসেবে ধরা হয়। দাতাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত এই অর্থের সার্ভিস চার্জও পরিশোধ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ এই বিপুল অর্থ বাংলাদেশের সম্পদ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

এদিকে বিশ্বব্যাপী মহামারি ‘কভিড-১৯’-এর প্রাদুর্ভাব দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে- এ আশঙ্কা থেকেই গত অর্থবছরে বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে স্বল্প সুদে দ্রুত বাজেট সহায়তা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। সেই উদ্যোগের ফলে গত জুন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার সহায়তা পাওয়া গেছে। এবার উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে একইভাবে আরও প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এখনো পর্যন্ত সহজ শর্তে যারা বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক ৫ মিলিয়ন ডলার, এডিবি ৫০০ মিলিয়ন ডলার, এআইআইবি ৩০০ মিলিয়ন ডলার, ফ্রান্স ১৩০ মিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে পারে। এ ছাড়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ৯০ মিলিয়ন মার্কিন এবং জার্মানি ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অনুদান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জানান, সরকারের বাজেটে বৈদেশিক ঋণের টার্গেট দেওয়া আছে প্রায় ৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আগে গৃহীত ঋণের আসল ফেরত দিতে হবে আরও প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। ফলে নিট বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজন পড়বে মোট সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে পাইপলাইনে আছে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে থেকে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার হয়তো এ বছর পাওয়া যেতে পারে। বাকি ২ বিলিয়ন ডলার দ্রুত বাজেটারি সহায়তা নিলেও নিট বৈদেশিক সহায়তা আরও প্রায় ১ থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার ঘাটতি থাকবে। বৈদেশিক সহায়তার এই ঘাটতি পূরণ করতে হলে অনেক খাতে সংস্কারের শর্ত রয়েছে যেগুলো পূরণ করতে হবে সরকারের। বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ উদাহরণ দিয়ে বলেন, কর্মসংস্থানের ওপর উন্নয়ন সহায়তা (ডিপিসি) হিসেবে গত অর্থবছরে দুটো কিস্তি ছাড় করেছে বিশ্বব্যাংক। তৃতীয় কিস্তির ২৫০ মিলিয়ন ডলার নিতে হলে অনেক সংস্কার কার্যক্রম আছে, যেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদে শুল্ক আইন ও কোম্পানি আইন পাস, ইজি অব ওয়ান স্টপ সার্ভিস দেওয়ার যে ৫৪টি প্রক্রিয়া রয়েছে সেটি সহজীকরণ, ডে কেয়ার আইন, ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট-এর সংঘবিধি কার্যকর করার বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

এদিকে পাইপলাইনে আটকে থাকা সহায়তার অর্থ সম্পর্কে ইআরডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রতি বছর যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকার দাতাদের সঙ্গে যেসব ঋণ চুক্তি করেছে, সেসব প্রকল্প নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে না পারায় বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড়ও দাতারা সময়মত করছে না। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে গত পাঁচ বছর ধরে দাতাদের সঙ্গে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার কোটি ডলার করে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। অথচ ছাড় করতে পেরেছে মাত্র ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার। এভাবে একদিকে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্থ ছাড় করতে না পারা, অন্যদিকে বেশি পরিমাণে চুক্তি স্বাক্ষর করার ফলে প্রতি বছর নতুন করে পাইপলাইনে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার। এসব মিলে পাইপলাইনের আকার প্রতিবছরই বড় হচ্ছে।

ইআরডির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ জুন বা গত ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দাতা দেশ ও সংস্থার সঙ্গে চুক্তির অর্থ থেকে ৪ হাজার ৯৫৪ কোটি ডলার পাইপলাইনে আটকা পড়েছে। গেল অর্থবছর সরকার দাতাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে ৯৫৫ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের। সেখানে ছাড় হয়েছে ৭২৭ কোটি ১৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে যত প্রতিশ্রুতি আদায় করা গেছে তার চেয়ে ২২৮ কোটি ২৫ লাখ ডলার কম ছাড় হয়েছে। ফলে ওই অর্থ দাতাদের কাছে পুঞ্জিভূত পাওনার খাতায় যুক্ত হয়েছে।

একইভাবে তার আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকার দাতাদের সঙ্গে চুক্তি করে ৯৯০ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের। কিন্তু ছাড় হয়েছে মাত্র ৬৫৪ কোটি ২৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ ওই অর্থবছরেও প্রতিশ্রুতির তুলনায় ৩৩৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলার কম ছাড় হয়েছে। ফলে ওই অর্থ দাতাদের কাছে পুঞ্জিভূত পাওনা বা পাইপলাইনে চলে যায়। এভাবে প্রতি বছর দাতাদের কাছ থেকে ছাড়ের তুলনায় বেশি প্রতিশ্রুতি আদায় করে চুক্তি করার ফলে পাইপলাইনের আকার দিন দিন বড় হচ্ছে।

এ বিষয়ে ইআরডির ফরেন এইড বাজেট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস (ফাবা) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব পিয়ার মোহাম্মদ জানান, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থ ছাড় বাড়ানোর জন্য ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের তালিকা করে ইআরডি ওই সব প্রকল্পের বাস্তবায়ন মনিটর করছে। এছাড়াও বাস্তবায়নকারী সংস্থা, ইআরডি এবং দাতা সংস্থা মিলে প্রতি তিন মাস পরপর ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করা হয়। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এই পাইপলাইনের অর্থ ব্যয়ে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে আমাদের কাছে তথ্য চেয়েছে। এ বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। ওই কমিটি পরিকল্পিত উপায়ে পাইপলাইনের অর্থ ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেবে। বিশেষ করে যেসব প্রকল্পের গতি নেই সেসব প্রকল্পে গতি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করে পাইপলাইনের অর্থ ব্যয় করা হবে।

বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জানান, পাইপলাইনের প্রায় সকল অর্থই আসলে প্রকল্প সহায়তার। তাই পাইপলাইন কমাতে হলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পগুলোকে বাছাই করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে। একইসঙ্গে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আবার সংশ্লিষ্ট লোকবল সংক্রমিত হলে দাতারা আপত্তি করতে পারেন। বৈদেশিক সহায়তা বেশি এমন প্রকল্প বাছাই করে বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে সরকারকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনেরও পরামর্শ দেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দুটি উদ্দেশে সরকার এই সহায়তা নেওয়ার বিষয়ে জোর দিচ্ছে। এক. বাংলাদেশের রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে হবে, যাতে চাহিদা বাড়ার পর আমদানিজনিত চাপ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে হঠাৎ কোনো সংকট সৃষ্টি করতে না পারে; দুই. বাজেট বাস্তবায়নে মধ্যমেয়াদি ঝুঁকি মোকাবিলা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত দুই মাসে রেমিট্যান্স আয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রেকর্ড পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করার পরও সরকারের মধ্যে উৎকণ্ঠা রয়েছে। কারণ প্রবাসীরা যেভাবে দেশে ফিরে আসছেন, তাতে রেমিট্যান্স আয়ের এই ধারা সামনের দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে কি-না সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় সরকার।

https://dailysangram.com/post/431035