১৬ অক্টোবর ২০২০, শুক্রবার, ১:৪০

সরকারি নির্দেশনার পরও কমেনি আলুর দাম

ভোক্তা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। দাম নির্ধারণ করে সম্প্রতি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠিও দেয়া হয়। একই সঙ্গে খুচরা পর্যায়ে আলুর কেজি ৩৮ থেকে ৪২ টাকায় বিক্রিকে অযৌক্তিক আখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু খুচরা বাজারে এখনো আলুর কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। সরকারের কোনো নির্দেশকে তোয়াক্কা করছেন না ব্যসায়ীরা। হিমাগার ও পাইকারি পর্যায়েও আলুর দর নির্ধারণ করে দেয়া হলেও কেউ মানছেন না। বরং দাম না কমাতে আড়তদারদের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারি নির্দেশনার পরও ব্যবসায়ীদের এমন বেপরোয়া আচরণে আড়তদাররাও অবাক।

আর কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন এবং বাস্তবে এটা করা যায় না। এ অবস্থায় বাধ্য হয়েই বেশি দামে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানায় আড়তদাররা। ওদিকে আলুর মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিপাকে পড়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরাও। বেশি দামের কারণে খুচরা বাজারে ক্রেতা কমেছে। এ কারণে খুচরা ব্যবসায়ীরাও আড়ত থেকে আগের তুলনায় খুবই কম করে আলু নিচ্ছেন। এতে তাদের মুনাফা যেমন কমে গিয়েছে, তেমনি বিক্রি কমায় আড়তগুলোতে আলুর স্তূপ জমেছে; পচে নষ্টও হচ্ছে।

আলুর দাম নির্ধারণ করে সম্প্রতি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। এতে প্রতিকেজি আলুর দাম হিমাগারে ২৩ টাকা, পাইকারিতে ২৫ টাকা এবং খুচরা বাজারে ৩০ টাকা দরে বিক্রি নিশ্চিত করতে কঠোর মনিটরিং ও নজরদারির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। চিঠিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানায়, বাংলাদেশে গত আলুর মৌসুমে প্রায় ১.৯ কোটি টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। দেশে মোট আলুর চাহিদা প্রায় ৭৭.৯ লাখ টন। এতে দেখা যায় যে, গত বছর উৎপাদিত মোট আলু থেকে প্রায় ৩১.৯১ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকে।

কিছু পরিমাণ আলু রপ্তানি হলেও ঘাটতির আশঙ্কা নেই। অধিদপ্তরের হিসেবে, এ মৌসুমে একজন চাষির প্রতিকেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৮ টাকা ৩২ পয়সা। আর মৌসুমে যখন হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে তখন প্রতিকেজি আলুর সর্বোচ্চ দাম ছিল ১৪ টাকা। প্রতিকেজি আলু হিমাগার ভাড়া বাবদ ৩.৩৬ টাকা, বাছাই খরচ ০.৪৬ টাকা ও ওয়েট লস ০.৮৮ টাকা, মূলধন সুদ ও অন্যান্য খরচ বাবদ ২ টাকা ব্যয় হয়।

অর্থাৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে অন্য খরচ ধরে এক কেজি আলু হিমাগার পর্যন্ত সংরক্ষণে সর্বমোট ব্যয় হয়েছে ২১ টাকা। এক্ষেত্রে হিমাগার পর্যায়ে বিক্রিমূল্যের ওপর ২-৫ শতাংশ লভ্যাংশ, পাইকারি পর্যায়ে ৪-৫ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ১০-১৫ শতাংশ লভ্যাংশ ধরে হিমাগারের আলু দাম ২৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে আলু সংরক্ষণকারীর লাভ হয় কেজিপ্রতি ২ টাকা। অন্যদিকে আড়তদারি, খাজনা ও লেবার বাবদ ৭৬ পয়সা খরচ হয়। সেক্ষেত্রে পাইকারি পর্যায়ে দাম পড়ে ২৩.৭৬ টাকা। এর সঙ্গে মুনাফা ধরে ২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ভোক্তা পর্যায়ে সেটা ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দেয় অধিদপ্তর।

কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব করে সরকারের এমন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার পরও কেন আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না? এমন প্রশ্ন সাধারণ ভোক্তাদের। তাদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট ব্যসায়ীরা প্রভাবশালী হওয়ায় তারা সরকারে কোনো নির্দেশনাকে তোয়াক্কা করছে না। কিন্তু সরকার চাইলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে অদৃশ্য কারণে সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনসাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী সম্পাদক পলাশ মাহমুদ মানবজমিনকে বলেন, সরকার দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পরও কেন ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না। প্রথমত, এর দায় হলো ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। তারা যদি এদেরকে ধরে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতো তাহলে অন্য ব্যবসায়ীরাও সতর্ক হয়ে যেতো। কিন্তু সরকারের কোনো নির্দেশনায় তারা কর্ণপাত না করে পণ্যের অতিরিক্ত দাম নিয়ে ভোক্তার পকেট কাটছে ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, কেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না? এর কারণ হলো এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের কোনো না কোনভাবে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা ব্যবসা করে। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

এদিকে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন এবং বাস্তবে এটা করা যায় না। মন্ত্রী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসন চেষ্টা করে, তবে বাস্তবে এটা করা যায় না। বাজারে চাহিদা ও তাদের ব্যবসায়ী নানান কারসাজির কাছে এটা করা খুব কঠিন একটা কাজ। তবে আমরা চেষ্টা করছি। আমরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছি না।

সরজমিন গতকাল রাজধানীর কাওরান বাজার আড়তসহ কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, আলুর বাজার আগের মতোই গরম। কাওরান বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা প্রকারভেদে প্রতিপাল্লা (৫ কেজি) আলু বিক্রি করছেন ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়। আর পাইকারিতে রাজশাহীর আলু ৪৩ টাকা এবং বগুড়ার লাল আলু ৪৪ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। অন্যদিকে হাতিরপুল কাঁচাবাজার, মগবাজার, শান্তিনগরসহ অন্য খুচরা বাজারগুলোতে আগের মতোই ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।

কাওরান বাজারে পাইকারিতে আলু নিতে এসেছিলেন মগবাজারের খুচরা বিক্রেতা শাহাদাৎ হোসেন। তিনি মানবজমিনকে জানান, আড়তে এর আগে কখনো একবারে এতো আলু দেখেননি তিনি। বলেন, দাম বাড়তে শুরু করায় ব্যবসায়ীরা এতো আলু আড়তে আনছেন। কিন্তু বিক্রিতো কম হচ্ছে, তাই আলুর স্তূপ জমেছে, পচে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমি আগে একসঙ্গে ৪-৫ বস্তা করে আলু নিতাম। যা দুইদিনে বিক্রি করে শেষ করে ফেলতাম। কিন্তু এখন এক বস্তা নিয়ে একদিনে শেষ করতে পারছি না।

কাওরান বাজারের ২৭ নং আলুর আড়তের কর্মচারী রতন বলেন, ব্যবসায়ীরা কড়া নির্দেশ দিয়ে গেছেন যেন দাম কমানো না হয়। আলু যদি পচে নষ্ট হয়েও যায় তবুও যেন না কমানো হয়; এভাবেই ব্যবসায়ীরা বলে গেছেন। এতে আড়তদারদের কিছু করার নাই। বরং আমাদের আরো সমস্যা কারণ বিক্রি কম হচ্ছে। আর বিক্রি কম হলে আমাদের মুনাফাও কম হয়। ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করলেও আমাদের যে লাভ ৩০ টাকায় বিক্রি করলেও একই লাভ। কাওরান বাজার সোনার বাংলা ট্রেডার্স এর কর্মচারী মুসলেহ উদ্দিন পচা আলুগুলো কেটে আলাদা করছিলেন। এ সময় তিনি বলেন, সরকার যদি সরাসরি কোল্ড স্টোরেজে গিয়ে তাদের ধরতে পারে, কড়া নির্দেশ দেয় এবং জরিমানা করে তবে দাম কমাতে তারা বাধ্য।

কিন্তু যারা অভিযান চালায় তারাতো ঘুষ খায়। বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে তাদের ছেড়ে দেয়। আর আমাদের যেখানে কিছু করার নাই সেখানে আড়তে এসে এবং খুচরা বাজারে ছোট ব্যবসায়ীদের জরিমানা করে। তিনি বলে, কোল্ড স্টোরেজে তাদের আলুর কেজিতে মাত্র ১৫ টাকা খরচ হয়। তারা যদি কেজিতে ৫ টাকাও লাভ করে তাও কতো টাকা। কিন্তু তাদের এ লাভে হয় না, আরো চায়। মাঝখানে আমরা পড়েছি বিপদে। বিশেষ করে খুচরা ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। তারা আগে যে পরিমাণ আলু নিতো তার থেতে ৩ ভাগের এক ভাগ নিচ্ছে এখন। কারণ মানুষ আলু কম কিনছেন। এ কারণে আড়তে আলু পচে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছে বিক্রি না হলেও কিংবা পচে নষ্ট হলেও আলুর দাম কমানো যাবে না। এখানে আসলে আড়তদারদের কিছু করার থাকে না। তারা কমাতে বললে আমরাও কমে বিক্রি করবো।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=246978&cat=2