১৬ অক্টোবর ২০২০, শুক্রবার, ১:১৫

ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ

করোনাকালে মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। এটি সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিবিএসের হিসাব। আবার সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাব বলছে, প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যারা বাজারে যাচ্ছেন জিনিসপত্র কিনতে, তাদের মুখে হাসি নেই। মুখ গোমড়া করে বাজার থেকে ফিরছেন অধিকাংশ মানুষ। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে মানুষের আয়-ব্যয়। ফলে ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে নিম্ম ও মধ্য আয়ের মানুষরা।

আয় দিয়ে সংসারের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। মাছ, মাংস তো দূরে থাক, সংসারের চাহিদা অনুযায়ী সবজিও কিনতে পারছেন না অনেকে। এক বছর আগে ২০০ টাকায় যে পরিমাণ সবজি পাওয়া যেতো, এখন সেই সবজি কিনতে ৬০০ টাকা লাগছে। এক বছর আগে যে আলু ২০ টাকায় পাওয়া যেতো, সেই আলু কিনতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। যে চাল ৪০ টাকায় পাওয়া যেতো, তা কিনতে ৬০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার বাসিন্দা খন্দকার হাসান শাহরিয়ার বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম শুনলে সবারই রাগ ওঠে। কিন্তু চুপচাপ থাকতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে সীমিত আয়ের মানুষ অচিরেই পুষ্টিহীনতায় ভুগতে শুরু করবে। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের দাম এভাবে বেড়ে যাওয়ায় আয় কমে যাওয়া মানুষের বেশি সমস্যা হচ্ছে। বাজার থেকে ফেরার পথে অনেককেই বাজার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বকাঝকা করতেও শোনা যায়।

দরিদ্র মানুষের দৈনিক আয়ের বড় অংশ খরচ হয় চাল কিনতে। সরু ও মাঝারি চালের মূল ভোক্তা মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা। সবাই চাপে রয়েছেন।

বাজারের তথ্য বলছে, দরিদ্র মানুষের নিত্যদিনের বাজারের তালিকায় থাকে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ ও আলু। এখন সব কটির দামই বাড়তি। মোটা চালের দাম এখন গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দুই মাসে অনেকটা লাফিয়ে বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা। লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে আলুর দাম, যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।

টিসিবির তথ্য বলছে, গত বছরের তুলনায় এবার আলুর দাম বেড়েছে ১১১ শতাংশের বেশি। শুধু আলুর দামই যে বেড়েছে তা নয়, বাড়ছে অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও। সবজিসহ বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ। জিনিসপত্রের বাড়তি এই দাম নিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে অনেকেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। একজন লিখেছেন কাঁচা বাজারে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে খোলা বাজারে। অপূর্ব রানা লিখেছেন, কাঁচা বাজারের কী একটা অবস্থা!!! কীভাবে চলছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের দিনকাল? কারও কোনও ভাবনা নেই, কারও কোনও দায়িত্ব নেই। আহারে সোনার বাংলা। এছাড়া অনেকেই আলু নিয়ে, নিত্যপণ্যের বাজারের মূল্য নিয়ে বিদ্রƒপ করে পোস্ট দিচ্ছেন।

বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে বাসায় ফিরে আসার পর অনেকের সংসারে অশান্তি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাজধানীর মানিক নগর এলাকার বাসিন্দা গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেন, দুই হাজার টাকা নিয়ে এত কম সদায় আনার কারণে বউ অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে বাজারে মুখের হাসি বন্ধ হয়, বাসায় এসেও হাসি আসে না। একই এলাকার বাসিন্দা আবদুর রশিদ বলেন, যা আয় হয়, তার সবই চলে যায় নিত্যপণ্যের বাজার করতেই। জিনিসপত্র কেনার পর হাতে আর কোনও টাকা থাকে না বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, এত খারাপ সময় এর আগে কখনও আসেনি তার।

বাজারের তথ্য বলছে, শিম, টমেটোসহ সাত ধরনের সবজির দাম শতকের ঘরের ওপরে রয়েছে। বাজারে ভালো মানের বেগুন কিনতে লাগছে ১৪০ টাকা কেজি, উচ্ছে বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা কেজি। কাঁচামরিচের কেজি ৩০০ টাকার ওপরে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি চাকরিজীবী আশিকুর রহমান ইসলাম বলেন, বৃষ্টির অজুহাতে সবজির দাম বেশি। চালের দাম বেশি কারণ ছাড়াই। তার আয়ের চেয়েও ব্যয় বেশি করতে হচ্ছে বলে জানান। নিত্য পণ্যের দাম এতই বেশি যে আর সংসার চলছে। প্রতি মাসেই ঋণের জালে আটকে যাচ্ছি। কিন্তু এভাবে আর কত দিন।

প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের ধাক্কায় দোকানপাট, শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই না করলেও কমিয়েছে কর্মীদের বেতন। ফলে করোনার আগে মানুষের যে আয় ছিল, করোনার প্রভাবে সেই আয় কমে গেছে। আয় কমে যাওয়ায় শহর ছেড়ে গ্রামমুখী মানুষের স্রোতও দেখা গেছে গত কয়েক মাসে।

বেসরকারি দুটি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গর্ভন্যান্স এন্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে দেশের ৭০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় কমে গেছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালে দেশে নতুন করে এক কোটি ৬৩ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।

বিআইডিএসের তথ্য বলছে, একজন দরিদ্র মানুষ যদি ১০০ টাকা আয় করে, তার মধ্যে ৬০ টাকাই খরচ হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পেছনে।

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বৃষ্টি, বন্যা ও ফেরি বন্ধ হওয়াসহ নানা কারণে সবজির দাম অস্বাভাবিক। দাম অস্বাভাবিক হওয়াতে সবার নাভিশ্বাস উঠেছে। তিনি বলেন, করোনার কারণে যখন সবার আয় কমেছে, তখন সব জিনিসের দাম বেড়েছে। এটা মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। অতি মুনাফাখোরদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনও ব্যবস্থা না থাকার কারণে সীমিত আয়ের মানুষ কষ্টের মধ্যদিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

https://dailysangram.com/post/430839