১৫ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৫:৫০

কাদের নিয়ন্ত্রণে আলুর বাজার

কেউ মানছে না নির্ধারিত দর

বাজারে আলুর দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যাওয়া এ দর নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্প্রতি সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করেছে প্রতি কেজি ৩০ টাকা। এ ছাড়া হিমাগার ও পাইকারি পর্যায়েও দর নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এই নির্ধারিত দর ব্যবসায়ীরা মানছেন না। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) হিসেবে গতকাল বুধবার বাজারভেদে আলুর দাম ছিল ৪৪ থেকে ৫০ টাকা।

দর নিয়ন্ত্রণে আনতে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী নির্ধারিত দর না মানলে এক বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা করা যেতে পারে। যৌক্তিক দামে পণ্যটি বিক্রির আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনও। তবুও সুফল মিলছে না। প্রশ্ন উঠেছে, আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কারা? গতকাল বাজারে খুচরায় প্রতি কেজি ডায়মন্ড ও গ্রানুলা জাতের গোল আলু ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাকড়ি জাতের ছোট লাল গোল আলু ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা যায়। টিসিবির হিসাবে সপ্তাহের ব্যবধানে আলুর দর বেড়েছে ২৫ শতাংশ। এক সপ্তাহ আগেও প্রতি কেজি আলু ৩৬ থেকে ৪০ টাকা ছিল।

গতকাল রাজধানীর পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি আলু ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়। হিমাগারে আলুর দাম কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা কমে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা, যা তিন দিন আগেও ৩৮ থেকে ৪০ টাকা কেজি ছিল। এক সপ্তাহ আগে আলুর দাম বেঁধে দেওয়া হলেও নির্ধারিত দর মানছেন না খুচরা, পাইকারি ও মহাজন ব্যবসায়ীরা।

জানতে চাইলে মিরপুরের ১নং বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন বলেন, হিমাগার থেকে ৪০ টাকা কেজি আলু কিনে ৪৫ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব নয়। একই কথা বলেন খুচরা ব্যবসায়ীরাও।

আলুর দাম :গত মে মাসে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় চাল-ডালের পাশাপাশি আলুর দামও কিছুটা বাড়ে। গত ৭ অক্টোবর আলুর দামে লাগাম টানতে দাম নির্ধারণ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। একই সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক, কৃষি বিপণনের জেলা বাজার কর্মকর্তা ও বাজার অনুসন্ধানকারীকে মনিটরিং ও নজরদারির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করা হয়। অধিদপ্তরের দেওয়া চিঠিতে জানানো হয়, আলুর ঘাটতির আশঙ্কা নেই। মৌসুমে হিমাগারে সংরক্ষণের সময় আলুর কেজি ছিল সর্বোচ্চ ১৪ টাকা। এখন হিমাগারে আলুর কেজি ২৩ টাকা বিক্রি করলে দুই টাকা মুনাফা হবে। পাইকারিতে সর্বোচ্চ দাম ২৫ টাকা এবং খুচরায় অর্থাৎ ভোক্তা পর্যায়ে ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এবার আলু উৎপাদনে কৃষকদের ব্যয় হয়েছে ৮ টাকা ৩২ পয়সা। চিঠিতে আরও বলা হয়, গত সপ্তাহে ৩৮ থেকে ৪২ টাকা দরে যে আলু বিক্রি হয়েছে তা অযৌক্তিক। ফলে সব পর্যায়ে নির্ধারিত দরেই আলু বিক্রি করতে হবে ব্যবসায়ীদের।

এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ সমকালকে বলেন, এটা যৌক্তিক দর। কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। কারণ কৃষকদের উৎপাদন খরচ ৮ টাকা ৩২ পয়সা। মৌসুমে সর্বোচ্চ দাম ছিল ১৪ টাকা কেজি। এই আলুতে ব্যয় কোনোভাবেই ২১ টাকার বেশি নয়। এখন বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে নির্ধারিত দর কার্যকর করতে হবে। বাজার মনিটরিং জোরদার হলে দাম কার্যকর হবে।

উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ে বিভ্রান্তি :কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে বিপণন অধিদপ্তর জানায়, চলতি বছর ১ কোটি ৯ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে, যার বিপরীতে বছরে চাহিদা ৭৭ লাখ ৯ হাজার টন। এ হিসাবে প্রায় ৩১ লাখ ৯১ হাজার টন আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা। এদিকে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন জানায়, এবার ৮৫ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। অন্য বছরের চেয়ে এবার আলু উৎপাদন ও হিমাগারে মজুদ কম হয়েছে। হিমাগারে অন্য বছর ৫৫ লাখ টন আলু মজুদ হলেও এবার ৪৫ লাখ টন হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোশারফ হোসেন জানান, এবার হিমাগার থেকে ইতোমধ্যে ৫৫ শতাংশ আলু বিক্রি হয়েছে। এখনও ২০ লাখ টনের বেশি আলু মজুদ আছে। এর মধ্যে ১০ লাখ টন বীজ আলু। বাকি আলু বাজারে বিক্রি করা হবে। তিনি দাবি করেন, এবার ফেব্রুয়ারিতে আলুর যে দাম ছিল, মার্চ শেষে সংরক্ষণ মৌসুমে তা বেড়ে যায়। তখন ১৪ থেকে ১৮ টাকা কেজিতে কিনতে হয়েছে। এতে আলু সংরক্ষণে ২৪ থেকে ২৫ টাকা খরচ হয়। ওই আলুর যৌক্তিক মূল্য হিমাগার থেকে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা ও খুচরায় ৩৫ থেকে ৪০ টাকা হওয়া উচিত। তিনি আরও জানান, কৃষি বিপণন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই দর নির্ধারণ করেছে সরকার। তবে যৌক্তিক দামে আলু বিক্রির বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন থেকে ব্যবসায়ীদের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বৃষ্টির কারণে এখন আগাম আলুর মৌসুম মার খেয়েছে। এতে আলু উৎপাদন পিছিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য দুই মাসের মজুত আলু দিয়ে চাহিদা মেটাতে হবে। প্রতি মাসে আলুর চাহিদা ৮ লাখ টন। এখন হিমাগারের আলু এ চাহিদার চেয়ে ঘাটতি রয়েছে।

বাজার অভিযান জোরদার ও জরিমানা :আলুর অস্বাভাবিক দামের কারণে গতকাল রাজধানীর পাইকারি আড়ত কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও মিরপুর-১নং শাহআলী মার্কেটে অভিযান চালিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকারের টিম। এই অভিযানে ৭টি প্রতিষ্ঠানে অস্বাভাবিক দামে আলু বিক্রির অপরাধে ৭২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান আলু কেনার দামের রসিদ বা প্রমাণ দেখাতে পারেনি। এদিকে অধিদপ্তর আলুর হিমাগার ও বাজার পর্যায়ে মনিটরিং বাড়িয়েছে। সারাদেশে সব পর্যায়ে আলুর দাম তদারকি করা হচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবুল কুমার সাহা বলেন, অসাধু ও অনৈতিক কোনো কাজের ক্ষেত্রে অধিদপ্তর জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করবে। ভোক্তার স্বার্থে দেশব্যাপী অভিযান চলছে। আগামী দিনে তা অব্যাহত থাকবে।

https://samakal.com/economics/article/201040212