১৩ অক্টোবর ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:৩১

ধর্ষণে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নিয়ে বিভিন্ন মহলের অভিমত

দ্রুত বিচার নিশ্চিত না করে সাজা বৃদ্ধিতে কাজ হবে না

দেশে সম্প্রতি ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার কথা বলা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করতে সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর খসড়া গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সংসদ অধিবেশন না থাকায় রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিয়ে আজ মঙ্গলবারই এ বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হবে বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন। তবে আইনবিদ ও মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, বিদ্যমান আইনে যেভাবে ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচার করার কথা বলা হয়েছে, তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে শাস্তি বৃদ্ধি করে লাভ হবে না। আইন পরিবর্তন করে সর্বোচ্চ সাজা দেয়ার ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। তবে এতে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে না যদি না দ্রুতগতিতে ধর্ষণ মামলাগুলোর বিচার হয়। তাদের মতে ১৫ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার তদন্ত এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এটা নিশ্চিত না করা গেলে শুধু সাজা বৃদ্ধি করেই সুফল পাওয়া যাবে না।

ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও প্রবীণ আইনবিদ খন্দকার মাহবুব হোসেন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করার বিষয়ে বলেন, আইন পরিবর্তন করে সর্বোচ্চ সাজা দেয়ার ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। তবে এতে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে না যে পর্যন্ত না মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি, অর্থাৎ যারা ধর্ষক এবং যারা এই ধরনের উচ্ছৃঙ্খল কাজ করে তারা ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে করে। তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে অপরাধ করতে হলে সে যে দলেরই হোক না কেন সাজা পেতে হবে। এই আস্থা যে পর্যন্ত তাদের মনে আসবে না সে সময় পর্যন্ত সাজা বৃদ্ধি ফলপ্রসূ হবে বলে আমি মনে করি না।

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, দ্রুতগতিতে ধর্ষণ মামলাগুলোর যেন বিচার হয়। মামলাগুলোর যাতে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। এটা নির্ভর করে দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তার ওপর। আধুনিক পদ্ধতিতে অতিদ্রুতগতিতে প্রকৃত যারা অপরাধী তাদের শনাক্ত করা যায়। এসব মামলায় অতিদ্রুতগতিতে চার্জশিট দেয়া উচিত। দ্রুতগতিতে বিচার হওয়া উচিত। বিচারে যে সাজা হয় সেই সাজাটা ব্যাপকভাবে গণমাধ্যমে প্রচার হওয়া দরকার, যাতে অপরাধীরা বুঝতে পারে যে এখন থেকে আর প্রশাসনের আওতায় থেকে বা প্রশাসনের সুদৃষ্টিতে থেকে অপরাধ করে ক্ষমা পাওয়া যাবে না।

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ধর্ষণ মামলা বেড়ে যাওয়ার কারণ যারা স্থায়ীভাবে ক্ষমতাসীন দলের সাথে থাকে এবং যারা তাদের ক্যাডার রয়েছে, তারা মনে করে তারা আইনের ঊর্ধ্বে। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুঃখজনকভাবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও যেকোনো কারণেই হোক তাদের প্রতি নমনীয়। এ কারণে তারা ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না এবং সঠিক তদন্ত করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারে না। মূল বিষয় হলো আইনে যে সাজাটাই থাকুক না কেন, সেই সাজা যাতে বাস্তবায়ন হয়। ত্বরিত গতিতে যাতে বিচার হয়, আইনের আওতায় যাতে আপরাধীদের আনা হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

এ বিষয়ে নবনিযুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা খুবই ইতিবাচক হবে। সমাজে মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, মৃত্যুদণ্ড করার পরে আমার মনে হয় যারা এ ধরনের অপরাধ করে তারা সাবধান হবে। এ অপরাধ করতে অনেকবার ভাববে। আমার মনে হয় সরকারের এ উদ্যোগটা যখন আইনে পরিণত হবে তখন কিন্তু এ ধরনের ঘটনা অনেকখানি কমে যাবে।

এ বিষয়ে মানবাধিকার ও নারী অধিকার কর্মী এবং বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফৌজিয়া করিম ফিরোজ ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ২০০০’-এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়াকে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ উল্লেখ করে বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে বিদ্যমান যে আইন রয়েছে, সেই আইনটাকে কিভাবে ইনফোর্স করা যায়। তা না হলে শাস্তি বৃদ্ধি করে লাভ হবে না। আইনে যেমনটা বলা হয়েছে, এত দিনের মধ্যে তদন্ত করতে হবে এবং বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, এ বিষয়গুলোর প্রতি আমরা যদি লক্ষ না করি তা হলে দেখা যাবে বছরের পর বছর মামলা ঝুলতে থাকবে এবং যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হচ্ছে তা হচ্ছে না। তিনি বলেন, আইনে যেভাবে বলা আছে, সেভাবে এই মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত করা এবং বিচার করা উচিত। আইনে বলা হয়েছে, পুলিশ যদি ১৫ দিনের মধ্যে আসামি ধরে ফেলে তা হলে ১৫ দিনের মধ্যে আর যদি এ সময়ের মধ্যে আসামি ধরতে না পারে তা হলে যে বর্ধিত সময় লাগবে তা আদালতে জানাবে কেন তদন্ত করতে পারছে না। তদন্ত শেষ হওয়ার পরে বিচার কার্যক্রম শুরু হবে এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে এবং একটানা মামলা চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, আপনারা কি দেখেছেন ১৫ দিনের মধ্যে এসব মামলার তদন্ত হয়েছে কি না এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার হয়েছে কি না। যদি না হয়ে থাকে কেন হয়নি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার করতে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, যৌন নির্যাতনের মামলাগুলো ক্যামেরা ট্রায়ালের কথা বলা হয়েছে। যদি ক্যামেরা ট্রায়াল হয় তা হলে এক একটি আদালতে কয়টি ক্যামেরা ট্রায়াল হয়েছে। এগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর না করেন তা হলে শাস্তি দিতে পারবেন না। এসব মামলার সঠিক তদন্ত হচ্ছে কি না। অনেক সময় মিথ্যা মামলা হয় সে ক্ষেত্রে সঠিক তদন্ত হচ্ছে কি না? মামলার সঠিক অনুসন্ধান থাকতে হবে। এরপর প্রসিকিউশনের একটি ভূমিকা থাকে। সেটা যথাযথভাবে পালন করছেন কি না? প্রসিকিউটরের সাথে তদন্ত কর্মকর্তার সমন্বয় আছে কি না। যে এভিডেন্সগুলো আনা হয়েছে, তা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে কি না? তিনি আরো বলেন, সাক্ষী ও ভিক্টিমের সুরক্ষার জন্য অবশ্যই একটা আইন করা দরকার। এটা না হলে সাক্ষী আসবে না। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। আর ভিক্টিম তো আসবেই না। সে তো অলরেডি ভিক্টিম হয়েছে, আসতে আরো ভয় পাবে। পারিবারিকভাবে ভয় পাওয়ার কারণে সে আসবে না। সাক্ষীদের সেফ হোমে রাখতে হবে, তাদের আসা-যাওয়ার খরচ দিতে হবে। এগুলো না দিলে সাক্ষী আসবে না। এ বিষয়গুলো আমাদের দেখতে হবে। এ ছাড়া সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি সহায়তা নেয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হলে; ডিজিটাল এভিডেন্স কেন আমরা নেবো না।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/534883