১৪ অক্টোবর ২০২০, বুধবার, ১১:৩৮

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জনদুর্ভোগ

ইবনে নূরুল হুদা : দেশে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি এখন লাগামহীন হয়ে পড়েছে। কোনভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিমূল্য রোধ করা যাচ্ছে না। একদিকে করোনা মহামারিতে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা সংকোচিত হয়ে এসেছে, অপরদিকে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সৃষ্টি করেছে রীতিমত জনদুর্ভোগ। সরকার বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে ছেলে ভোলানো কথা শোনালেও বাজারে তার কোন ইতিবাচক প্রভাব নেই।

পেঁয়াজ-সবজির দাম তো এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চালের দামও। আলুর মত নিত্যপ্রয়োজনীয় সবজিও এখন সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নেই। ভোজ্যতেল, ডিম, আদা, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য সার্বিক পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতি ঘটিয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনজীবিকা এখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সরকারও পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

বাজারে এখন ৫০ টাকা কেজির নিচে কোন সবজিই পাওয়া যাচ্ছে না। করলা ১শ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ঢ্যাঁড়স, লাউ, কাঁকরোল ও কচুতেও লেগেছে আগুন। বেগুন ও চিচিঙ্গার দাম অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রতি কেজি ৮০ টাকায় এসে ঠেকেছে। পটল ৬০ ও কাঁচা পেঁপে ৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। কাঁচা মরিচ বাজার ভেদে ২৪০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি। টমেটো প্রতি কেজি ১১০ ও শসা ৮০ থেকে ১০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।

বাজারে ভালো মানের মোটা চালের কেজিতে দর উঠেছে ৫০ টাকায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবেই দর ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগেও ৪৪ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে ছিল। খুচরা দোকানে আলু ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা হালি দরে। সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে পাঁচ টাকা। দেশি পেঁয়াজ ৯০ এবং দেশি পেঁয়াজ ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি ১২০ টাকা। রসুন ৮০ থেকে ১০০ টাকা ও চীনা আদা ২৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে। যা মূল্যবিস্ফোরণের দিকেই ইঙ্গিত করে।

রাজধানী ঢাকাতেও বাজার পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে উঠেছে। ঢাকায় ১৮-২০ টাকার আলু এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, তারা যেভাবে কিনছেন বিক্রিও করছেন একই ভাবে। পেঁয়াজ এক শ’ টাকার নিচে নামছে না কোনভাবেই। নিম্নমানের পেঁয়াজও বিক্রি হচ্ছে এক শ’ টাকায়। অপেক্ষাকৃত ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে এক শ’ ১০ টাকায়। খুচরা বিক্রেতারা এ বিষয়ে নানা কথা বললেও বাস্তবতার সাথে তার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি বাজার সূত্র বলছে, পাইকারি যে দামে বিক্রি হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি দাম রাখছেন খুচরা বিক্রেতারা। ফলে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। আর আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা।

রাজধানীতে সবজির দামে ঊর্ধ্বগতি নতুন কিছু নয়। মাঝে কেজি প্রতি ৫-১০ টাকা কমলেও চলতি সপ্তাহে তা আবারো বেড়েছে। বাজারে সব ধরনের সবজির দামই এখন বেশি। প্রতি কেজি ৫০ টাকায় শুধু পেঁপে এবং কচু মিলছে। এর বাইরে ৮০ টাকার নিচে ভালো কোনো সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। শিমের কেজি ১২০ থেকে ১৬০ টাকা। ছোট আকারের ফুলকপি, বাঁধাকপির পিস বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা। প্রতি হালি কাঁচাকলা বিক্রি হচ্ছে ৪০/৫০ টাকায়। পাকা টমেটোর কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৪০ টাকা। গাজর বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকা কেজি। করলা কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-১২০ টাকায়। বরবটি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি। পটোল, ঝিঙা, কাঁকরোল, চিচিঙ্গা, বেগুন ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজার নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং দিন যতই যাচ্ছে সার্বিক পরিস্থিতির ততই অবনতি হচ্ছে। কেউ কেউ আবার এজন্য সরকার সংশ্লিষ্ট একাংশকে দায়ি করছেন। তাই বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার নেতিবাচক প্রভাবে সাধারণ মানুষের আয় স্বাভাবিকভাবেই কমেছে। কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কারও ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি হয়েছে। কর্মসংস্থানে সৃষ্টি হয়েছে নানাবিধ জটিলতা। এমতাবস্থায় জীবনযাত্রায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মূলত খাদ্যপণ্য কিংবা খাদ্যবহির্ভূত; সবকিছু ভোগের ক্ষেত্রেই আগের তুলনায় বাড়ছে ব্যয়। বন্যা, পণ্য সরবরাহে বিঘ্নতা এবং বিশ্ববাজার থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে নানাবিধ জটিলতায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে এবং বর্তমানে তা অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও বিবিএসের মাসওয়ারি পর্যালোচনায়ও এর সত্যতা মিলেছে। সংস্থাটির গেল জুনের মূল্যস্ফীতি হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- চাল, ডিম, ব্রয়লার মুরগি, শাকসবজি, মশলার মূল্য মে মাসের তুলনায় জুনে বেড়েছে। জুলাই এবং আগস্ট মাসেও মূল্যবৃদ্ধির এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল। অক্টোবর মাসে এসে তা একেবারে প্রান্তিকতায় নেমে এসেছে। যা সাধারণ মানুষের জন্য রীতিমত অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

পরিসংখ্যান বলছে, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের তুলনায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। যে পণ্যগুলোর দাম বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয়, তার মধ্যে খাদ্যপণ্যই ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে চালের অংশ ২৩ শতাংশ। চালের দাম এখন বেশ ঊর্ধ্বমুখী। অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়ছে অবলীলায়। এতে নিম্ন এবং মধ্যবিত্তের মধ্যে বড় ধরনের সংকটের জন্ম দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন, বন্যার কারণে আমনের উৎপাদন কম হওয়ার অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি, ইতিবাচক রেমিট্যান্স প্রবাহ, মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ার সম্ভবনাও রয়েছে বলে দাবি করছে সরকারি সূত্রগুলো। চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সরকারি খাতের ঋণ। এসব কারণে মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ পড়বে বলে আগেই ধারণা করা হয়েছিল। আর বাস্তবেও তাই হয়েছে এবং সে ধারা এখনও চলমান। কিন্তু সমস্যা হলো এতে শ্রেণিবিশেষ সুবিধা পেলেও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মোটেই বাড়েনি। ফলে আগামী দিনগুলোতে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে সমস্যায় পড়বেন দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। আর এসব সমস্যা সমাধানে সরকারকে কোন প্রাক-প্রস্তুতি আছে বলে মনে হয় না। ফলে আগামী দিনে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি আরও বড় ধরনের অবনতি ঘটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

মূলত, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় স্বাভাবিকভাবেই। এবারও তার কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে এবারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বন্যা, করোনা, বিশ্ববাজারে টালমাটাল অবস্থা এবং আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কারোপ দাম বাড়ার প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ফলে আয় সংকুচিত হওয়া মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় অবস্থায় রাখার তাগিদ এসেছে বিভিন্ন মহল থেকেই। এক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাজারের কারসাজি নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকর বাজার মনিটরিংএর উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি খাদ্যবহির্ভূত পণ্য যেমন চিকিৎসা সামগ্রী, যাতায়াত ব্যয়, বাড়িভাড়া ইত্যাদি মানুষের সক্ষমতার মধ্যে রাখার পরামর্শ এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে সমস্যা সমস্যায় থেকে যাচ্ছে।

সরকার সবসময়ই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের পক্ষে কথা বলে আসছে। কিন্তু বাজারে সে কথার কোন প্রতিফলন নেই। সঙ্গত কারণেই বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারিব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করা আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। চাহিদা ও সরবরাহে সামঞ্জস্য রাখার বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং পদ্ধতি যুগোপযোগী ও আধুনিকীকরণের কোন বিকল্প নেই । তবে সবার আগে ভাঙ্গতে হবে বাজার সিন্ডিকেট। পণ্যবাহী ট্রাক থেকে অসাধু পুলিশ সদস্যদের বখরা আদায় বন্ধ করতে হবে। পথে পথে মাস্তানদের চাঁদাবাজিও বন্ধ করতে না পারলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণ। সার্বিকভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটালেই চলবে না বরং বিশ্ববাজারে নিজেদের পণ্য বা সেবা ছড়িয়ে দিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদন এবং চাহিদার সামঞ্জস্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকাও দরকার। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আমদানির পাশাপাশি রপ্তানির ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। এতে শুধু ভোক্তা বাজার নয়, আর্থিক বাজারেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বাজার নিয়ন্ত্রণ যেকোনো রাষ্ট্রের সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে সরকার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাইকে অনেক বেশি কৌশলী ও আন্তরিকতা দেখাতে হবে। এ বিষয়ে গণসচেতনতার বিষয়টিও উপেক্ষা করার মত নয়।

তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। দেশের সিংহভাগ মানুষই দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বহুল আলোচিত বিষয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। কালোবাজারি, মুনাফাখোরী, মজুতদারীসহ নানা কারণে চাল, ডাল, তেল, লবণ, মরিচ, চিনি, দুধ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যা সাধারণ মানুষের জীবনকে অস্থির ও অশান্ত করে তুলেছে।

দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার সম্পর্ক খুবই নিবিড়। একটি পরিবার কিভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় ও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তখন তাদের জীবন হয়ে ওঠে স্বাচ্ছন্দময়। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায় তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে দুর্ভোগের শেষ থাকে না। মূলত দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি জনদুর্ভোগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে মূল্য পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতি ঘটলেও সরকার বা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। সবকিছুই কথামালার ফুলঝুড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। ফলে কালোবাজারী, মুনাফালোভী, মজুতদারেরা আস্কারা পেয়ে পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাচ্ছে। পণ্য ক্ষেত থেকে শহরের বাজার পর্যন্ত আসতে কৃষককে চাঁদা, দালালী, মধ্যস্বত্বভোগী, পরিবহন খরচ প্রভৃতি বাবদ প্রচুর অর্থ গুনতে হয়। কৃষকের পক্ষে তখন সাশ্রয়ী মূল্য পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী পণ্য মজুত রেখে অপ্রত্যাশিতভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। অনেক সময় আমদানী পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে বিক্রয় করে ব্যবসায়ীরা। এছাড়া মাথাপিছু ফসলি জমির পরিমাণ কমে যাওয়া, জমির অনুর্বরতার দরুণ উৎপাদন কম হওয়া, অনুন্নত পরিবহন ব্যবস্থার কারণে পর্যাপ্ত পণ্য বাজারজাত না হওয়া, চোরাচালান ইত্যাদি কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে ইতোমধ্যেই সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এমতাবস্থায় মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান চাপ কার্যকর ও সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। আর এ জন্য দেশের কালোবাজারী ও চোরাচালানী রোধ করার কোন বিকল্প দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। এবিষয়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো কঠোর ও দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ এসেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষকদের ঋণদানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পরামর্শ এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যাতে সহজে এবং অল্প সময়ের মধ্যে বাজারজাত করা যায় এজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থায় আধুনিকতা আনার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। সরকারের পক্ষে থেকে প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া দরকার যাতে কেউ ক্রেতাদের কাছ থেকে অধিক মূল্য গ্রহণ করতে না পারে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই ক্রান্তিকালে সরকারের পক্ষে কিছু ইতিবাচক কথা বলা হচ্ছে। বাজার যাতে বিক্রেতারা ইচ্ছামতো বাড়াতে না পারে তার জন্য দোকানে পণ্যের নির্ধারিত মূল্য তালিকা টানানোর নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। আর এ বিষয়টি মনিটরিং করার জন্য ‘টিসিবি’কে (Trading Corporation of Bangladesh) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে স্পর্শকাতর পণ্যের খুচরা ও পাইকারি মূল্যের তালিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ এসেছে। বর্তমানে আইন অনুযায়ী দোকানে দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা টানানো বাধ্যতামূলক।

কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার শুধু নির্দেশনা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। কিন্তু এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কি না তা যথাযথভাবে তদারক করা হচ্ছে না বলে সাধারণ মানুষ অভিযোগ করছেন। সঙ্গত কারণে মূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কোন ভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাজার সিন্ডিকেট বন্ধ করাও সম্ভব হচ্ছে না।

অবশ্য সব দায় সরকারের উপর চাপিয়ে দিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বরং এ বিষয়ে গণসচেতনাও জরুরি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির নানাবিধ কারণ থাকলেও ব্যবসায়িদের সিন্ডিকেট ও অতি মুনাফাখোরী প্রধানত দায়ি। তাই মূল্য বৃদ্ধি রোধের জন্য সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন দেশের আত্মসচেতন মানুষ। এজন্য অসৎ ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। এক্ষেত্রে চাইলে সরকার ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা নিতে পারে। অন্যথায় দ্রর্বমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ ও জনদুর্ভোগ নিরসন করা যাবে না।

https://dailysangram.com/post/430585