১২ অক্টোবর ২০২০, সোমবার, ১১:১০

নারী নির্যাতন এবং ইন্টারনেট

আশিকুল হামিদ : ইদানীং সবকিছু দেখে-শুনে বারবার ঘুম পাড়ানো গানের কথা মনে পড়ছে। আমাদের মায়েরা শিশুদের ঘুম পাড়ানোর জন্য এখনও গুনগুন করে নানা ধরনের গান গেয়ে থাকেন। এসব গান শুনতে শুনতেই শিশুরা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

গানের কথাটা অবশ্য অকারণে মনে পড়েনি। বর্তমান পর্যায়ে আমার কাছে ‘মা’ হিসেবে এসেছে সরকার। শুনে পাঠকরা অবাক হতে পারেন। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন, ধর্ষণ ও ছিনতাই-ডাকাতি থেকে পণ্যমূল্য পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়েই সরকার ওই মায়েদের মতো জনগণকে কেবল ঘুম পাড়ানো গানই শুনিয়ে চলেছে। যেমন এই সময়ে সারাদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে ধর্ষণের এবং ধর্ষণের পর নিষ্ঠুর হত্যার বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে, যার সঙ্গে জড়িত রয়েছে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির প্রশ্ন।

আলোচনায় আসছে আইন-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর ভূমিকার দিকটিও। অন্যদিকে এসব বাহিনী কিন্তু ঘোষণা দিয়ে বেড়াচ্ছে, এখন নাকি ‘আগের মতো’ অপরাধ হয় না! অপরাধ না হলেও ধর্ষণ যে কল্পনার সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে সে কথাটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও স্বীকার না করে পারছেন না। এজন্যই তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের ঘোষণা দিতে হয়েছে। ওদিকে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জে একজন নারীকে তার নিজের বাড়িতে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরা বলেছেন, ওই ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের কোনো অবহেলা রয়েছে কি না তা অনুসন্ধান করা এবং প্রয়োজনে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। মাননীয় বিচারপতিরা বলেছেন, এটা মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধ এবং এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতেই হবে। এই ঘটনা তাদের ‘বিচারিক বিবেক’কে নাড়িয়ে দিয়েছে।

মাননীয় বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ ও আদেশসহ সব মিলিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি শুধু আশংকাজনক নয়, অত্যন্ত ভীতিকরও। বিশেষ করে নারী নির্যাতন এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা যেভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তা মোটেও পাশ কাটানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের নারীরা ৩৩ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ধরনগুলোর মধ্যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ তো রয়েছেই, রয়েছে যৌতুকের জন্য হত্যার মতো নিষ্ঠুরতাও। সব ঘটনাই অবশ্য প্রকাশ্যে আসে না। কারণ, লোকলজ্জার ভয়ে এদেশে বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনা গোপন রাখা হয়- যদিও সাম্প্রতিককালে সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না।

ধর্ষণ ও গণধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের সূত্র ধরেই সম্প্রতি প্রাধান্যে এসেছে ইন্টারনেট-যার মধ্যে ফেসবুক একটি অন্যতম মাধ্যম। এক কথায় একে ‘অনলাইন’ও বলা হয়। এই ইন্টারনেট বা অনলাইনের যন্ত্রণা কিন্তু সরকারকেও যথেষ্ট বিব্রত করে। যেমন আগে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের নানাদিক নিয়ে দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটি সংস্থা যেসব রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সেগুলো সম্পর্কেও আবার নেতিবাচক বক্তব্যই বেশি শুনতে ও পড়তে হয়েছে। ‘নৈশকালীন’ ভোট ডাকাতি কথাটার প্রচারণা বেশি চালানো হয়েছে ইন্টারনেটে- অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে। ওই নির্বাচন নিয়ে এখনও রিপোর্ট এবং পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য প্রকাশের পালা চলছেই।

আজকের নিবন্ধের প্রধান বিষয়বস্তু অবশ্য আমাদের একটি সামাজিক সমস্যা। ইন্টারনেটকে নিরাপদ করার উদ্দেশ্য থেকে মাস কয়েক আগে ঢাকায় প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, বাংলাদেশে ফেসবুকসহ ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণা ও হয়রানি বেড়ে চলেছে। এসবের শিকার হচ্ছে বিশেষ করে শিশু-কিশোররা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১০ থেকে ১৭ পর্যন্ত বয়সের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৩২ শতাংশই সহিংসতা, ভয়-ভীতি এবং ডিজিটাল নির্যাতন ও উৎপীড়নের শিকার হচ্ছে অথবা শিকার হওয়ার মুখে রয়েছে।

বাংলাদেশসহ ১৬০টিরও বেশি দেশে প্রায় ১০ লাখ শিশু-কিশোর অর্থাৎ তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর পাঁচ সপ্তাহ ধরে পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে প্রণীত ইউনিসেফের এই রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ১৬ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত বয়সীরাই অন্যদের তুলনায় উসকানিমূলক হয়রানি ও উৎপীড়নের শিকার বেশি হচ্ছে। ইউনিসেফের সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু ১১ বছর বয়সের আগেই ইন্টারনেট বা ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করতে শুরু করে। তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ অর্থাৎ প্রায় ৬৩ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারের স্থান হিসেবে প্রাথমিকভাবে বাসাবাড়িতে নিজেদের ব্যক্তিগত কক্ষকে ব্যবহার করে। পরবর্তীকালে এই গন্ডির ক্রমাগত সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। তারা বাইরের বিভিন্নস্থানেও ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত ও পারদর্শী হয়ে ওঠে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ছেলেদের মধ্যে যেখানে ৬৩ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে সেখানে মেয়েদের সংখ্যার হার ৪৮ শতাংশ। ইন্টারনেটে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে করা হয় অনলাইন চ্যাটিং বা মেসেজ আদান-প্রদান। এজন্য ব্যয় করা হচ্ছে ৩৩ শতাংশ সময়। এর পর রয়েছে ইন্টারনেটে ভিডিও দেখাÑ যেগুলোর বেশির ভাগই অশ্লীল। এজন্য ৩০ শতাংশ সময় ব্যয় করা হচ্ছে।

সমীক্ষায় কিছু বিচিত্র বা অস্বাভাবিক তথ্যও উঠে এসেছে। এরকম একটি তথ্য হলো, ছেলেদের ৭০ শতাংশ এবং মেয়েদের ৪৪ শতাংশ অনলাইনে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের পাঠানো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট বা বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করে থাকে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের একটি বড় অংশ স্বীকার করেছে, তারা শুধু বন্ধুত্বের অনুরোধই গ্রহণ করে না, তাদের অনেকে এসব সদ্য পরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতও করতে যায়। জানা গেছে, এভাবেই উসকানি ও যৌন হয়রানি থেকে সহিংসতা পর্যন্ত প্রায় সবকিছুরই সূচনা হয়ে থাকে। একযোগে শুরু হয় মাদক এবং যৌন সামগ্রীর লেনদেনও। অনেকেই মাদকাসক্ত ও যৌনকর্মে অভ্যস্ত হতে থাকে।

বন্ধুত্বের আড়ালে ছেলেমেয়েরা যৌনকর্মসহ অসামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ডেও জড়িয়ে পড়ে। যারা সম্মত হয় না কিংবা অনলাইন বন্ধুর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাদের ভয়ভীতি দেখানো এবং হুমকি দেয়া হয়। বন্ধু নামের অনেকে এমনকি প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি অশ্লীল বিভিন্ন ছবিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যেই সেগুলো ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়। তখন শুরু হয় ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ভয়ংকর কর্মকান্ড। আর এ ব্যাপারে বেশি আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেয়েরা। এমন বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা মোকাবেলা ও প্রতিরোধ করার আহবান জানিয়ে ইউনিসেফ বলেছে, এ উদ্দেশ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

ইউনিসেফের জরিপের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা তথ্য-পরিসংখ্যানগুলো নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আশংকাজনকও। কারণ, এটাই স্বাভাবিক যে, তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশের এই যুগে ছেলেমেয়েরা কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করবে। ফেসবুক, ইউটিউব, মেসেঞ্জার, টুইটার ও হোয়টসঅ্যাপসহ নানা যোগাযোগ মাধ্যমে তারা শুধু অন্যদের সঙ্গে পরিচিত হবে না, বন্ধুত্ব গড়ে তোলার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে শিখবেও অনেক কিছু। ইন্টারনেটের এমন ব্যবহারই উন্নত ও সভ্য বিশ্বের দেশে দেশে হয়ে আসছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে ঘটছে উল্টো রকম। এখানে শিক্ষার চাইতে অশ্লীল উস্কানি ও বিনোদনের ব্যাপারেই সুচিন্তিতভাবে বেশি আগ্রহ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ছেলেমেয়েরাও নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতিই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। এভাবে তাদের মধ্যে অশ্লীলতা যেমন ছড়িয়ে পড়ছে তেমনি এর সুযোগ নিচ্ছে অনলাইনে তৎপর দুর্বৃত্তরা। বন্ধুত্বের ছদ্মাবরণে ছেলেমেয়েদের তারা মাদকের ব্যবসা থেকে যৌন হয়রানি পর্যন্ত নানা অপরাধে জড়িয়ে ফেলছে।

এজন্যই ইউনিসেফ তার রিপোর্টে যৌনতা ও মাদকাসক্তিসহ সহিংসতার ঘটনা মোকাবেলা ও প্রতিরোধ করার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানিয়েছে। এই আহবান ও পরামর্শের গুরুত্ব অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে শুরু করতে হবে পরিবারের ভেতর থেকে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের জন্য শিশু-কিশোরদের দাবি ও আবদার পূরণ করার পাশাপাশি তাদের প্রতি নজরদারিও বাড়াতে হবে। প্রত্যেকের কার্যক্রমের প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখতে হবে, তারা যাতে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে না পড়তে পারে। সময়ে সময়ে ইন্টারনেটের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে তাদের যুক্তি দিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে বোঝাতে হবে। অপরিচিত ব্যক্তিদের বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করার ব্যাপারে যেমন নিরুৎসাহিত করতে হবে তেমনি বুঝিয়ে বলতে হবে, তারা যেন অনলাইন চ্যাটিংয়ের কোনো পর্যায়ে কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না যায়। যাতে মাদক এবং যৌনতা ও যৌন সামগ্রীর বিষয়ে সতর্ক থাকে এবং অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে না পড়ে।

এ ব্যাপারে প্রাথমিক দায়িত্ব পরিবারের হলেও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। সরকারের উচিত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মাধ্যমে অনলাইনের হয়রানি ও উৎপীড়ন বন্ধ করার জন্য অবিলম্বে তৎপর হয়ে ওঠা। প্রসঙ্গক্রমে নারী নির্যাতনের অন্য কিছু ধরন সম্পর্কে উল্লেখ করা দরকার। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে জানানো হয়েছে, রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারীই যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। গবেষণা জরিপে অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানা গেছে, হয়রানি ও নিপীড়ন যে পুরুষেরা করে তাদের মধ্যে ৬৬ শতাংশের বয়স ৪১ থেকে ৬০ বছর। ষাটোর্ধ পুরুষেরাও পিছিয়ে থাকে না, তারাও সুযোগ পেলে সুযোগের ‘সদ্ব্যবহার’ করে! তবে নারীদের জন্য বেশি বিপদজনক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে কম বয়সী যুবক ও পুরুষেরা, যাদের বয়স ২৬ থেকে ৪০-এর মধ্যে। সাধারণ বাসের পাশাপাশি রিকশা এবং সিএনজির ক্ষেত্রেও নারীদের অভিজ্ঞতা কমবেশি একই রকম।

অর্থাৎ সব যানবাহনেই তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। যাত্রীদের পাশাপাশি রয়েছে যানবাহনের চালক, কন্ডাক্টর ও হেল্পারসহ অন্যরাও। তারাও নারীদের নির্যাতন ও উত্ত্যক্ত করে যথেচ্ছভাবে। চলন্ত বাসের ভেতরে ধর্ষণ শুধু নয়, হত্যার ঘটনাও ঘটে মাঝে-মধ্যেই। প্রকাশিত পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ২০১৮ সালে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার ৭৩২ জনের মধ্যে ৬৩ জন ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছে। এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যার পাশাপাশি নারী ও শিশু ধর্ষণও অনেক বেড়ে গেছে। এখনও বাড়ছেই।

বলার অপেক্ষা রাখে না, যানবাহনে নির্যাতন ও হয়রানির এই খবর সকল বিচারেই অগ্রহণযোগ্য। গবেষণা রিপোর্টে বিশেষজ্ঞদের অভিমতের উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, বেশি বয়স ও শারীরিক কারণে অক্ষমতা, অতৃপ্তি এবং স্ত্রী বা নারী সঙ্গী না থাকাই নাকি প্রধান কারণ। রিপোর্টে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছে আইনের বিষয়টি। বলা হয়েছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও দেশে এখনো যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। এর ফলে যৌন নিপীড়নসহ নারী নির্যাতন শুধু বেড়েই চলছে না, সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতনের রেকর্ডও স্থাপিত হয়েছে। ধর্ষণ ও গণধর্ষণ থেকে হত্যা ও নানামুখী নির্যাতন পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে এত বেশি ও ভয়ংকর ধরনের নির্যাতনের শিকার নারীরা অতীতে আর কখনো হয়নি। শিশুরাও যে বাদ যাচ্ছে না বরং তাদের ওপর চালানো নির্যাতনও যে ক্রমান্বয়ে আশংকাজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে- সে সম্পর্কেও গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। সংক্ষপে বলা যায়, দেশে নারী নির্যাতন আসলে সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এসব বিষয়েই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা রিপোর্টে।

বলা দরকার, সবই সম্ভব হয়েছে ও হচ্ছে আসলে দেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে। মেয়েরা, এমনকি শিশুরা পর্যন্ত নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারবে না, তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে, তারা ধর্ষণেরও শিকার হবেÑ এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে দেয়া যায় না। শুধু তা-ই নয়, বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো লাঞ্ছিত হতে হবে, তার ওপর নেমে আসবে নির্যাতনের খড়গ এবং তাকে ও তার পরিবারকে এমনকি গ্রাম ও এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়ারও চেষ্টা চালানো হবে- এসবের কোনো একটিও সভ্য সমাজের লক্ষণ নয়।

নারীর ওপর এই সর্বাত্মক নির্যাতন ও সহিংসতায় আপত্তির কারণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, কারণ আসলে আইন-শৃংখলা বাহিনীর উদ্যোগহীনতা ও নিষ্ক্রিয়তা। অনেক থানা এমনকি ধর্ষণের মামলা পর্যন্ত নিতে চায় না। মামলা করতে গিয়ে উল্টো হুমকি-ধামকি খেয়েছে এমন নারী ও তাদের স্বজনদের সংখ্যাও কম নয়। একই কারণে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে নালিশ জানানোর বা বিচার চাওয়ার ব্যাপারেও মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। যেন সবাই ‘নিয়তি’র ওপর ছেড়ে দিয়েছে সবকিছু! এভাবে অসংখ্য নারীর জীবন নষ্ট হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে বহুজনের সাধের সংসার। যৌন নির্যাতনের শিকার কত নারী যে বাধ্য হয়ে বিপথে গেছে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি তারও কোনো হিসাব নেই।

বলা দরকার, ধরন যেমনই হোক, নারীর ওপর নির্যাতনকারীদের কোনোক্রমেই ছাড় দেয়া যায় না। এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা অবশ্যই সরকারকে পালন করতে হবে। শুধু ‘ঘুম পাড়ানো গান’ শোনালে চলবে না, সরকারের উচিত অবিলম্বে এই জঘন্য কর্মকান্ড প্রতিহত করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠা। কঠোর হওয়া। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে একটি আইনের খসড়ার কথা বহুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। মাঝখানে প্রধানমন্ত্রী এমনকি মৃত্যুদন্ডের কথাও বলেছেন। আইনটিকে অবিলম্বে প্রণয়ন ও কার্যকর করা দরকার। নারীদের জন্য তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার, যাতে নির্যাতিত নারীরা আইনের আশ্রয় নিতে এবং সুবিচার পেতে পারে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস আদালত ও শিল্প-কারখানাসহ কর্মস্থলেও নারীদের জন্য সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, লাফিয়ে বেড়ে চলা নারী নির্যাতনের ঘটনায় আর যা-ই হোক, সরকারের ভাবমর্যাদা অন্তত বাড়ছে না।

পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন তথা নারীর ওপর নির্যাতনের অবসান ঘটাতে হলে নির্যাতনকারী সকলের বিরুদ্ধেই আইনত ব্যবস্থা নেয়া দরকার। একথা বুঝতে হবে যে, দেশে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় এবং যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে বলেই এমন ঘটনা ঘটতে পারছে। সুতরাং সবার আগে দরকার যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা- যার দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই সরকারের। জনাকয়েক ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করাই সমাধান হতে পারে না। ব্যবস্থা নেয়া দরকার সামগ্রিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে-যেখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দেয়া চলবে না।

https://dailysangram.com/post/430324