১১ অক্টোবর ২০২০, রবিবার, ১০:০৬

ধর্ষণের বিরুদ্ধে সারাদেশে ব্যাপক গণজাগরণ

আসিফ আরসালান : গত দুই সপ্তাহ হল জনগণের মধ্যে একটি জাগরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেটি হল ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে। এটি প্রথমে শুরু হয় সিলেট এমসি কলেজে বেড়াতে আসা এক নববধূকে গ্যাং রেপ বা গণধর্ষণ ঘটনার প্রতিবাদে। নব বিবাহিত এক তরুণ দম্পতি বিকেল বেলা সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজ ঘুরে দেখছিলেন। তখন কলেজ হোটেলে অবস্থানরত ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা ঐ দম্পতিকে আটক করে। স্বামীকে একটি কক্ষে আটকে রেখে তরুণী স্ত্রীকে ছাত্রলীগের নেতারা একের পর এক পালাক্রমে ধর্ষণ করে। সুখের বিষয়, খবরটি বাইরে প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই সাধারণ ছাত্র এবং জনতা প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। ছাত্র জনতার এই ক্ষোভের আগুন শীঘ্রই শুধুমাত্র সিলেট নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। সিলেটে ছাত্রলীগের গণধর্ষণের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার প্রতিবাদের আগুন প্রজ্জ্বলিত থাকা অবস্থাতেই অগ্নিতে ঘৃতাহুতির মতো আরেকটি পাশবিক ধর্ষণের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেটি হল, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের এক বয়স্ক গৃহবধূকে দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের এই নারকীয় দৃশ্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়। একে তো সিলেট এমসি কলেজে গৃহবধূকে ছাত্রলীগের গণধর্ষণে জনতার ক্ষোভের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিল, তার ওপরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের পৈশাচিক ঘটনা ধিকি ধিকি আগুনকে দাউ দাউ করে জ¦ালিয়ে তোলে। মহামারি করোনাকালেও এই জঘন্য ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রথমে মাঠে নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য। তাদের মানববন্ধনে বিপুল জনসমাবেশ হওয়ায় গত বুধ ও বৃহস্পতিবার বিশাল মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিএনপির দুইটি অঙ্গসংগঠন। শুক্রবার বিএনপি আরেকটি অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। এই কর্মসূচিতেও বেশ লোক সমাগম হয়।

ছিনতাই, চাঁদাবাজি, গুম, খুন এবং ধর্ষণের মত অপরাধের বিরুদ্ধে এমনিতেই মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও ক্রোধ পুঞ্জিভূত হচ্ছিল। ইতোপূর্বে সুবর্ণচরে আওয়ামী লীগের মাস্তানরা প্রথমে ৪ সন্তানের জননীকে এবং পরে ৬ সন্তানের জননীকে ঘর থেকে বের করে ফাঁকা মাঠে গণধর্ষণ করে। ধর্ষকদের জনগণ ঠিকই চিহ্নিত করে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তারা প্রতিপ্রত্তিশালী হওয়ায় জনগণ রুখে দাঁড়াতে সাহস পায়নি। সুবর্ণচরের ঐ দুই গৃহবধূকে ধর্ষণের পর ধর্ষকদের কোনো শাস্তি হয়েছে কিনা সেটি জনগণ জানে না। কিন্তু সিলেট ও বেগমগঞ্জের নারকীয় ঘটনার পর মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। তাই এবার তারা রাস্তায় নেমেছেন। ঢাকার সাথে সাথে মফস্বলের অনেক জেলাতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সারাদেশ ধর্ষণের প্রতিবাদে উত্তাল। বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু এই শাস্তিই বা কয়জনকে দেয়া হয়েছে? ধর্ষণের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, এই রকম কেস জনগণের জানা নাই। এখন সারাদেশ উত্তাল। সেই উত্তাল, জনগণের দাবি ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড চাই। এই দাবি এখন এত উচ্চকন্ঠ যে সেটি আইনমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কর্ণকুহরেও পৌঁছেছে। বাংলাদেশে ধর্ষণ এমন বল্গাহীন গতিতে চলছে সেটা বহির্বিশ্বেও দেশের কপালে কলঙ্ক তিলক এঁটে দিয়েছে।

॥ দুই ॥
বিশ্বসংস্থা জাতিসংঘ বাংলাদেশে ধর্ষণের বেপরোয়া গতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত ৭ অক্টোবর বুধবার বাংলাদেশে নারীদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান নির্যাতনে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং নারীদের প্রতি ন্যায়বিচারের আহ্বান জানিয়েছে। সারাদেশব্যাপী ধর্ষণের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদের মধ্যে জাতিসংঘ এক বিবৃতিতে বলে, “এগুলো জঘন্য অপরাধ। এগুলো মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন।” ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিঞা সেপ্পো বাংলা এবং ইংরেজিতে জারিকৃত এক টুইট বার্তায় এই মন্তব্য করেন। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নোয়াখালীর ঐ মহিলার যে কাহিনী সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশের সমাজ, আচরণ ও কাঠামোতে কি প্রচণ্ড নারী বিদ্বেষ রয়েছে।” বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “বাংলাদেশের জনগণ এবং নাগরিক সমাজ ন্যায়বিচারের জন্য যে আওয়াজ তুলেছেন, তার সাথে জাতিসংঘ একাত্মতা ঘোষণা করেছে। তবে আমরা মনে করি যে এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নারীর অধিকার জোরদার করার জন্য আমরা (জাতিসংঘ) একটি সুসংগঠিত পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে চাই। ফৌজদারী- অপরাধ বিধি সংস্কারের জন্য জাতিসংঘ জোর সুপারিশ করছে। এই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে মন্থর বিচার পদ্ধতিতে গতি সঞ্চার এবং ভিক্টিম ও তার পক্ষের সাক্ষীগণকে সমর্থন দেয়া ও তাদের নিরাপত্তা বিধান করা”
গত শুক্রবার পর্যন্ত খবরে দেখা যাচ্ছে যে সারাদেশ ধর্ষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে। এর আগে কয়েকটি সংগঠনের নাম বলেছি। শুক্রবার এ সম্পর্কে আরও খবর পাওয়া গেছে। ঐসব খবর থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, সেভ আওয়ার উইমেন, বাংলাদেশ নারী আইনজীবী সমিতি প্রভৃতি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বগুড়া, চাঁদপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ অনেক জেলা শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এসব সমাবেশ থেকে যে অভিন্ন দাবি উত্থিত হয়, তার মধ্যে রয়েছে (১) মৃত্যুদণ্ডসহ ধর্ষণের বিরুদ্ধে নতুন আইন প্রণয়ন। (২) দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণ মামলার বিচার (৩) ভিক্টিমদেরকে দ্রুত সেবা দানের জন্য হট লাইন প্রতিষ্ঠা। (৪) ধর্ষণের প্রতিটি কেস রেকর্ড করার জন্য থানায় একজন নারী পুলিশ অফিসার নিয়োগ। (৫) ধর্ষণের কেসের তদন্ত টীমে একজন নারী সদস্যের অন্তর্ভুক্তি এবং (৬) অপরাধীদেরকে যে সব অফিসার মদদ দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। ছাত্র অধিকার পরিষদের দাবির মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ।

॥ তিন ॥
আমি আগেই বলেছি যে এবার ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে সেটিকে রীতিমত গণজাগরণ বলা যায়। এবার জনগণের আওয়াজ ক্ষমতার করিডোর পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে মনে হয়। কারণ এবার সরকার একটু নড়ে চড়ে বসেছে বলে মনে হয়। গত শুক্রবারের পত্র পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে প্রচলিত আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আগামী সোমবার এ সংক্রান্ত প্রস্তাব মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পত্রিকান্তরে তিনি বলেন, বুধবার আমি বলেছিলাম, আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি বিবেচনার কথা। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে অনুরূপ নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। আইনমন্ত্রী বলেন, নিশ্চয়ই সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করার চিন্তা করেই এই আইন সংশোধন করা হবে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২০০০ সালে প্রণীত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। আর ধর্ষণের ফলে নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনও বলেছেন যে এখন সারাদেশেই নারীদের এত নির্যাতন হচ্ছে যে সরকার পর্যন্ত বিব্রত। সরকারের মন্ত্রী পর্যন্ত বলেছেন যে আমরা ক্ষমতায়। আর আমরা এটার দায় এড়াতে পারিনা। আমরা জুডিশিয়ারীতে আছি। আমরাও চাই এর উপযুক্ত বিচার হোক।

গত শুক্রবার ঢাকার একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের খবরে প্রকাশ, ঢাকার ৯টি সহ দেশের ১০১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দুই লক্ষাধিক। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন মামলা ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে দেড় বছর আগে উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সেই নির্দেশ অধস্তন আদালতে পালিত হয়নি। শুধু তাই নয়। উচ্চ আদালতেও এই ধরণের মামলা ঝুলছে বছরের পর বছর। ফলে আইনের ফাঁক ফোকর গলিয়ে জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে অনেক আসামী। বিচারের গতি আনতে এবং ঝুলে থাকা মামলার বোঝা কমাতে দেড় বছর আগে উচ্চ আদালত ৭ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। এই ৭ দফার মধ্যে ছিল ৬ মাসের মধ্যে দ্রুত বিচার আদালত কর্তৃক মামলা নিষ্পত্তি।

ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সারাদেশব্যাপী আওয়াজ উঠেছে। এটা অত্যন্ত ভাল লক্ষণ। সরকার ধর্ষণের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করছে, সেটিও ইতিবাচক দিক। কিন্তু একটি দিকে কেউ কথা বলছেনা। অথচ সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হল, মানুষের মধ্যে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করা। আর নৈতিকতা বোধ জাগ্রত হয় ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি স্কুল কলেজে ধর্মীয় মূল্যবোধকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ধর্ষকের মধ্যে এই বোধ আনতে হবে যে তারও তো মা, বোন ও কন্যা রয়েছে। যদি তারা ধুুুর্ষিত হয় তাহলে তার কেমন লাগবে?
asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/430234