৮ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১১:১৮

সভ্যতা এখন চোখ রাঙায়

‘কথা’ ও ‘কাজ’। শব্দ দু’টির সাথে জড়িয়ে আছে মানুষ। কথা ও কাজে মিল থাকলে মানুষ হয়ে যায় ‘প্রকৃত মানুষ’। আর ব্যত্যয় ঘটলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। বিষয়টি বিবেচনায় আনলে প্রশ্ন জাগে, বর্তমান সভ্যতায় প্রকৃত মানুষের সংখ্যা কত? মানুষের রাষ্ট্রতো বড় প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে কথা হয়, চুক্তি হয়, কিন্তু সেই চুক্তি কতটা বাস্তবায়িত হয়? সাম্প্রতিক এমন একটি চুক্তি প্রসঙ্গে কথা বলেছে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

৪ অক্টোবর তুর্কী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরাইল আরব বিশে^র সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের নামে নিছক প্রতারণা করেছে। এছাড়া দখলকৃত পশ্চিম তীরে নতুন করে অবৈধভাবে ইসরাইলী বসতির অনুমোদন দেয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে তুরস্ক। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনী ভূমিতে নতুন করে ইহুদি বসতি নির্মাণে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর অনুমোদন আবারো প্রমাণ করলো যে, দখলদারিত্বই দেশটির আদর্শ। অথচ এমন আদর্শ আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের রেজ্যুলেশনের প্রতি অসম্মান। আর এতে প্রমাণিত হয়, ইসরাইল তার সংযুক্তকরণ নীতি পরিত্যাগ করেনি। অথচ সম্প্রতি দাবি করা হয়েছিল, ইসরাইলের সাথে কয়েকটি আরব দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের চুক্তির ফলে ইসরাইলের ‘সংযুক্তকরণ নীতি’ স্থগিত থাকবে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এটি একটি প্রতারণা। ইসরাইলের এমন অবৈধ পদক্ষেপ তুরস্ক সমর্থন করে না। বিবৃতিতে ফিলিস্তিনী জনগণের অধিকার ও তাদের স্বাধীনতার ওপর ইসরাইলের আক্রমণের ব্যাপারে সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি আরব দেশের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চুক্তি হয়, এতে মধ্যস্থতা করে ট্রাম্প প্রশাসন। তখন হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ফিলিস্তিনের বিষয়ে ইসরাইল তার ‘সংযুক্তিকরণ নীতি’ স্থগিত করেছে। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে সবই প্রতারণা।

সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত রয়েছে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত। কত আলোচনা, কত আশ্বাস কিন্তু নেই দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি। বরং দিনে দিনে বেড়েছে ইসরাইল কর্তৃক দখলকৃত ভূমির পরিমাণ। বেড়েছে ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনীদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নের মাত্রা। তবে আজ পর্যন্ত সংঘাত নিরসনে যতগুলো প্রস্তাব এসেছে, তন্মধ্যে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে ‘অ্যারাব পিস ইনিশিয়েটিভ’ তথা আরব শান্তি উদ্যোগ- যার উদ্যোক্তা ছিলেন সৌদি আরবের তৎকালীন ক্রাউনপ্রিন্স ফাহাদ। ১৯৮১ সালের ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকৃত আরব ভূমি থেকে ইসরাইল পুরোপুরি চলে যাবে। বিনিময়ে আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। এটি ছিল আরব শিবির থেকে উত্থাপিত প্রথম কোনো প্রস্তাব। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে ওই প্রস্তাব সফলতার মুখ দেখেনি। এরপরের ঘটনা প্রবাহ তো স্পষ্ট। সভ্যতা হয়ে ওঠে আগ্রাসী। ন্যায় ও মানবিকতা লোপ পেতে থাকে। আর মুসলিম বিশে^ নেতৃত্বের দুর্বলতার পাশাপাশি বাড়তে থাকে অনৈক্যের মাত্রা। এমন পরিস্থিতিতে বৃহৎ শক্তিবর্গের সমর্থনে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাত্রা চরম আকার ধারণ করে। ফলে বর্তমান সভ্যতা পরিণত হয়েছে এক প্রহসনের সভ্যতায়। সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ সবই আছে এই সভ্যতায়। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রত্যাশী দুই নেতার মধ্যে প্রথম বিতর্কটি অনুষ্ঠিত হয় গত ২৯ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার। ওই বিতর্ক চলাকালে প্রতিদ্বন্দ¦ী জো বাইডেন ও মডারেটরকে বারবার থামিয়ে দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বর্ণবাদী ও মিথ্যাবাদী আখ্যা দেন বাইডেন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মধ্যে যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় তার দিকে দৃষ্টি থাকে গোটা বিশে^র। কারণ ওই বিতর্কের বক্তব্য থেকে শুধু মার্কিন নেতাদের বোঝা যায় না, বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রকেও। যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়গুলোও স্পষ্টভাবে উঠে আসে বিতর্কে। এমন বিতর্কে যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বর্ণবাদী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়, তখন সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, বর্ণবাদ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় সমস্যা। বর্ণবাদ শুধু আমেরিকার নয়, বৃটেনেরও একটি বড় সমস্যা। আসলে যতই আধুনিকতা ও বিজ্ঞান মনস্কতার কথা বলা হোক না কেন, পাশ্চাত্য মানস এখনো বর্ণবাদের অন্ধকার থেকে মুক্ত হতে পারেনি।

লন্ডন থেকে রয়টার্স পরিবেশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কাঠামোগত বর্ণবাদ’-এর ইতি ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রিন্স হ্যারি ও তাঁর স্ত্রী মেগান মার্কেল। তাঁরা বলেছেন, এটা শুধু গায়ের চামড়ার রঙের কারণে তরুণদের পিছিয়ে দেয়। বর্ণবাদের মতো রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়গুলো সাধারণত এড়িয়ে চলেন যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের সদস্যরা। সেই রেওয়াজ থেকে সরে এসে আগেও বর্ণবাদ নিয়ে কথা বলেছেন হ্যারি ও মেগান। দ্যা ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রিন্স হ্যারি বলেন, সাদা চামড়ার লোকজন যদি ভিন্ন রঙের চামড়ার মানুষকে আরও বেশি বুঝতেন, তাহলে বৃটেন আরও ভালো জায়গা হিসেবে বিবেচিত হতো।

এমন বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এত চর্চার পরও বর্তমান সভ্যতার স্বরূপ কেমন। আসলে বর্তমান সময়ে বর্ণবাদের চেতনায় এক ধরনের অমানবিক-সাম্প্রদায়িকতা মানব জাতিকে চোখ রাঙাচ্ছে। মানব মুক্তির স্বার্থে এর অবসান প্রয়োজন।

https://dailysangram.com/post/429916