১০ অক্টোবর ২০২০, শনিবার, ১০:৪৩

চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড

লাফিয়ে বাড়ছে খরচ

৪ বছরের কাজ শেষ হয়নি সাড়ে ৯ বছরেও; ৮৫৬ কোটি টাকা থেকে ব্যয় এখন ২ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকায়

প্রকল্প অনুমোদনের পর সেগুলো যেন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। দেখা যায়, কাজের গতি নিয়ে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করে। ঢিলেমির কারণে প্রকল্পের খরচ ও মেয়াদ বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পটি প্রায় ১০ বছর ধরে চলছে, যা ৪ বছরে সমাপ্ত করার কথা ছিল। ব্যয় কয়েক দফায় বেড়েছে মোট এক হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। সাড়ে ৯ বছরে প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি হলো ৮৭ শতাংশ, যা সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, ২০১১ সালের ২৯ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) উপকূলীয় বাঁধ শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে বাঁধের ওপর চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড নির্মাণের জন্য ৮৫৬ কোটি ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, ৪ বছরে অর্থাৎ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (চউক) প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ সমাপ্ত করবে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, বন্যা ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে চট্টগ্রাম শহর, বিমানবন্দর, ইপিজেডসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো রক্ষা করা, ওই বাঁধের ওপর রাস্তা নির্মাণ করে চট্টগ্রাম শহর এবং চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারী যানবাহন এই বাইপাসের মাধ্যমে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাথে সংযোগ স্থাপন করে যাতায়াতের সুবিধা করে চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসন। শহর ও উপকূলীয় বাঁধের মধ্যস্থিত এলাকাগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে আবাসন, বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পকে উৎসাহিত করা এবং যাতায়াত সুবিধা বৃদ্ধি করে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে শিল্পের প্রসার ঘটানো ইত্যাদি। এ ছাড়া কর্ণফুলী নদীর মোহনায় প্রস্তাবিত টানেলের সাথে রাস্তার সংযোগ প্রদান। এতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। উপকূলীয় বাঁধ শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে বন্যা ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে চট্টগ্রাম শহর রক্ষা পাবে।

প্রকল্পের আওতায় মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছেÑ ১৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ কোস্টাল রোড, ১ দশমিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার রোড-১ এবং শূন্য দশমিক ৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার রোড-৩ নির্মাণ। ৯টি রাউন্ড অ্যাবাউট। ৩টি ইন্টারচেঞ্জ। বিভিন্ন পয়েন্টে বেরিয়ার, গার্ড রেল, সাইন সিগন্যাল এবং লাইন মার্কিং। পুনর্বাসন স্থান-১ এবং ২ উন্নয়ন, সি বিচ এলাকায় সৌর্ন্দয্যবর্ধন কাজ ও ঢেউ প্রতিরোধক দেয়াল নির্মাণ।

দফায় দফায় মেয়াদ ও খরচ বাড়ানো
প্রকল্পের বাস্তবায়নপর্যায়ে জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি, মৌজা দর বৃদ্ধি এবং স্ট্রাকচারের ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ২ বছর পরই ব্যয় এক হাজার ৪৯৬ কোটি ৩৫ লাখ ৭১ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়। যা একনেক ২০১৩ সালের ১৪ নভেম্বর অনুমোদন দেয়। তখন বাস্তবায়ন মেয়াদ আড়াই বছর বাড়িয়ে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। তাতেও প্রকল্প সম্পন্ন হয়নি। পরে আবারো জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বাড়িয়ে সে খাতে খরচ বৃদ্ধি, মাটি ভরাটের পরিমাণ বৃদ্ধি, প্রকল্পে ১০.২০ কিলোমিটার বাঁধের ঢাল বরাবর সিসি ব্লক দ্বারা পিচিং কাজ যুক্ত করা, নির্মীয়মান রাস্তার মধ্যে সমুদ্র সংলগ্ন অংশে ওয়েভ ডিফ্লেকটেড ওয়াল নির্মাণ, সড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণ এবং সমুদ্রতীরে সৌন্দর্য্যবর্ধন অন্তর্ভুক্ত করায় খরচ আরো বৃদ্ধি পায়। আর একনেকে ২০১৬ সালে এই ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। একই বছর ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় সেটাও অনুমোদন দেয়া হয়। মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি কাজ শেষ করার জন্য বলা হয়। তাতেও প্রকল্পটি সমাপ্তির মুখ দেখে না। এরপর আরো দুই দফা খরচ বাড়ানো ছাড়া মেয়াদ বাড়ানো হয়। ফলে বাস্তবায়নকাল সাড়ে ১০ বছরে উন্নীত হয়।

চউক এখন মেয়াদ না বাড়িয়ে প্রকল্পের খরচ আরো ১০.২৩ শতাংশ বা ২৪৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা বাড়িয়ে বাস্তবায়ন ব্যয় ২ হাজার ৬৭৪ কোটি ২৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকায় উন্নীত করার বিষয়টি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পাঠিয়েছে। এখন জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ৪৫.৯৬ হেক্টর থেকে ৬৭.০৭৬ হেক্টরে উন্নীত, ওয়েভ ডিফ্লেকটেড ওয়ালের দৈর্ঘ্য সাড়ে ৫ কিলোমিটার থেকে ১২০ মিটার বাড়ানো হয়েছে। রাউন্ড অ্যাবাউট নির্মাণ ৯ থেকে ৭টিতে কমানো হয়েছে। এক কিলোমিটার দীর্ঘ প্লাজা, ৫.৬২০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ইপিজেড সংযোগসড়ক নির্মাণ নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বলছে, ইপিজেড সংযোগ সড়কের কারণে ৪০ কোটি ৫৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, বাড়তি ১২০ মিটার ওয়েভ ডিফ্লেকটেড ওয়ালের কারণে ১২৩ কোটি ৬ লাখ টাকা, ঠিকাদারের ভ্যাট-ট্যাক্স ফেরত ও মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয়ে ১৩৭ কোটি ৮ লাখ টাকা, কংক্রিট প্লাজা ও ওয়াকওয়েতে ৬৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, বক্স কালভার্ট নির্মাণে ৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ঋণের টাকা ছাড় না করায় সরকারি খাত থেকে ৫৭ কোটি ৭৬ লাথ ৫১ হাজার টাকা বাড়তি খরচ যুক্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয় তৃতীয় সংশোধনীতে।

অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, যে প্রকল্পটি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা, সেটি ২০১৯ সালের জুনে, সাড়ে ৯ বছরে অগ্রগতি হয়েছে ৮৭ শতাংশ। আর চউকের ওয়েব সাইটের তথ্যানুযায়ী এই অগ্রগতি আগস্ট পর্যন্ত ৯২ শতাংশ।

পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টরা বলছে, সমীক্ষা সঠিকভাবে করা না হলে প্রকল্পের অগ্রগতি দফায় দফায় বাধাগ্রস্ত হবে। প্রকল্পের খরচও অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়বে। নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্পকে সমাপ্ত করা না গেলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি কম হতে পারে। প্রকল্পে মাটি ভরাটের কাজ রয়েছে। পর্যবেক্ষণ দেখা যায়, ভরাট কাজের জন্য সাগর পাড়ের মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। সাগর পাড়ের মাটি সহজেই ধসে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা এই প্রকল্পের জন্য ঝুঁকি বলে পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি মনে করছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/534243