১০ অক্টোবর ২০২০, শনিবার, ১০:২৬

মধ্যম আয়ের ‘ফাঁদে’র ঝুঁকিতে দেশ

মধ্যম আয়ের ‘ফাঁদে’র ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। এই শঙ্কা প্রকাশ করেছে খোদ সরকারের থিংকট্যাংক খ্যাত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। এজন্য নীতি নির্ধারকদের সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদি বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০২১-২০৪১) বিষয়টি তুলে ধরে এ সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি পরিকল্পনাটি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনাটি তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, উন্নয়নশীল দেশ থেকে উচ্চ আয়ের কাতারে যেতে কোনো কোনো দেশের দুই যুগেরও বেশি সময় লেগেছে। মালেয়শিয়ার মতো দেশের সময় লেগেছে ২৭ বছর। এ সময়ে এক ধরনের ফাঁদে আকটা পড়েছিল ওইসব দেশ। কেননা উন্নয়নশীল দেশ হলে বৈদেশিক সহায়তা অনেক কমে যায়। তাছাড়া বৈদেশিক সম্পদ সংগ্রহের খরচও বাড়ে। আর্ন্তজাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা একেবারেই কমে আসে। সেই সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতিও কমে যেতে পারে। এ ধরনের শিক্ষা নিয়ে আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উচ্চ আয়ের অর্থনীতির দেশে যাওয়ার জন্য এই প্রেক্ষিত পরিকল্পনাটি তৈরি করেছি। মধ্য আয়ের ফাঁদে আটকা না পড়তে চাইলে রফতানি বাড়াতে হবে। সম্পদ বাড়ানোর কার্যকর প্রয়াস নিতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে ড. আলম বলেন, কোভিড-১৯ বাংলাদেশের মধ্য আয়ের ফাঁদে আটকে পড়ার শঙ্কাকে ত্বরান্বিত করবে না। কেননা বর্তমানে দ্রুতই দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, এদেশে ওইভাবে আর কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়বে না। শীতে সংক্রমণ বাড়ার যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেটি নাও হতে পারে। কেননা এর আগে অনেক পক্ষই নানা রকম ধারণা করেছিল। বলা হয়েছিল ঈদুল ফিতরের পরে এদেশে ব্যাপক করোনার সংক্রমণ ঘটবে। সেটি হয়নি। তারপর বলা হলো, কোরবানি ঈদের পর সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসবে। করোনার সময় যখন পোশাক শ্রমিকদের দুই দফা ঢাকায় আনা-নেওয়া করা হলো তখন বলা হয়েছিল করোনার ব্যাপক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে দেখেন, এসব ধারণার কোনটিই সঠিক হয়নি। তাই আশা করা যাচ্ছে, করোনায় খুব বেশি সমস্যা হবে না।

পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণে অতীত সাফল্য অনেক বেশি আশাবাদী করে তুলেছে। কিন্তু উচ্চ আয় পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পথে অর্থনীতির মধ্যম আয়ের ফাঁদে (এমআইটি) আটকা পড়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে নীতি-প্রণেতাদের সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। একটি দ্রুত বর্ধনশীল উন্নয়নকামী অর্থনীতির জন্য মধ্য আয় কোনো গন্তব্য হতে পারে না। বরং অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০২১-৪১ মেয়াদে বাংলাদেশের গড় জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি হবে বার্ষিক ৮-১০ শতাংশ। গড়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে প্রায় ৯ শতাংশ। যদি কোনো কারণ প্রবৃদ্ধির এই দ্রুত গতিকে ব্যাহত করে তবে সেটি হতে পারে মধ্যম আয়ের ফাঁদের সূত্রপাত, যা উচ্চ আয়ের মর্যাদা অর্জনকে বিলম্বিত করবে।

দীর্ঘ মেয়াদি এই পরিকল্পটিতে আরও বলা হয়েছে, উদ্ভাবন ও আধুনিক প্রযুক্তিতে ক্রমবর্ধনশীল উন্নত অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশ যদি মানসম্মত ম্যানুফ্যাকচারিং পণ্য রফতানিতে সস্তাশ্রম ব্যবহারকারীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে না পারে, তবে মধ্য আয়ের ফাঁদে আটকে পড়ার সম্ভবনা প্রবল হবে। এছাড়া উন্নত অর্থনীতিতে উত্তীর্ণ দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরের মতো এশীয় অর্থনীতির দেশগুলো কখনই মধ্যম আয় পর্যায়ে মুখ থুবরে পড়েনি। মালেয়শিয়া খুব শিগগিরিই ১২ হাজার ৫৫ ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। অথচ থাইল্যান্ড বহুবছর ধরে উচ্চ মধ্যম আয়ের পর্যায়ে (২০১৮ সালে মাথাপিছু আয় ৬ হাজার ৩৭৫ ডলার) আটকা পড়ে আছে।

থাইল্যান্ডের অবস্থা সম্পর্কে পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, থাইল্যান্ডের অর্থনীতি দেশটির রফতানি প্রবণতায় মন্দাগতির কারণে যাবতীয় ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ভারে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন দক্ষতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ১৯৬০ সালের ১০১টি মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে ২০০৮ সালে মাত্র ১৩টি উচ্চ আয়ের অর্থনীতি হওয়ার মর্যাদা লাভ করে। এটি এমন একটি বাস্তবতা যা হালকাভাবে নেওয়া ঠিক হবে না।

প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশরই অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি পৃথক চরিত্র রয়েছে। তাই মধ্য আয় ফাঁদ পরিহারের জন্য কোন একক নীতি গ্রহণ করা হয় না। এই ফাঁদ পরিহারের জন্য তাই প্রতিটি দেশকে চাহিদা ও সরবরাহ সংশ্লিষ্ট নীতিমালার সঠিক মিশ্রণ খুঁজে পেতে হবে। যা তাদের মাথাপিছু আয় বাড়াতে গতি সঞ্চারসহ দেশজ ও বৈদেশিক বাজার থেকে উৎসারিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১-এ মধ্য আয় ফাঁদ পরিহারের কার্যকর ব্যবস্থাসহ উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য শক্ত ভিত্তি নির্মাণ এবং পথনকশার কথা বলা হয়েছে।

https://dailysangram.com/post/430133